Monday, 14 December 2015

অবলায়ন


উন্মাদীয় সোমরস

(উন্মাদীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্নিত প্রতি সোমবারের জন্য নতুন সিরিজ)

অবলায়ন


নারী।

নারী মা, নারী স্ত্রী, নারী কন্যা, নারী ভগিনী, প্রকৃতিকেও আমরা নারী রুপেই পূজিত করিইয়া থাকি। কিন্তু আজিকের যুগে নারী মানে রক্তমাংসের ভোগ্যসামগ্রী। কর্মরত চাকুরীজিবী মহিলা বা উদ্যোগপতি থেকে বারবনিতা হয়ে নিতান্ত গৃহবধু, প্রায় সকলেই অধিকাংশ পুরুষের চোখে জৈবিক লালসা চরিতার্থ করিবার জীবন্ত যন্ত্র।
নারী মাত্রেই অবশিষ্ট মানবকুলের নিকটে সৌন্দর্যাভিমানিনী কামিনীকুল। গরবিনী আবেগিনি স্ত্রী রত্ন ললিতলবঙ্গলতা। ধর্ম মানবকে ধারন করুক বা মানবকুল ধর্মকে আহোরন করিয়া থাকুক, ধর্মচরিতানুসারে প্রায় সকল ধর্মেই নারী মানেই অবলা, প্রায় করুনার পাত্র, এবং তাহাদিগকে লইয়া ভাবনার অন্ত নাই। নিজ নিজস্ব সংবিধানানুসারে নারী মাত্রেই অশান্তির কারকের সহিত সমান্তরালভাবে দেবী রুপেও পূজিতা।
শারীরিক ক্ষমতার বিচারে প্রাকৃতিক নিয়মেই রমণীকুল পূং জাতি হইতে সামান্য পিছিয়ে। আর ইহা লইয়া দ্বন্দের অবকাশ নাই। আর বিভেদের বিষবৃক্ষ এই জমিতেই খুব সম্ভবত অঙ্কুরোগমিত হইয়াছিল। রমনী পেলব, মোহিনী শক্তিধারী, কৌমুদীয় রসময়ী, শরীরিসঞ্চালক লাবণ্যলীলাময়ী, সর্বপরী নারীই একমাত্র প্রজননক্ষম। সুতরাং মমত্ব নারীত্বের অন্যতম গুন, কিন্তু সবথেকে বৃহৎ গুনপনা সহ্যশক্তিতে। জীবজগতের সর্বাপেক্ষা সহ্য ও ধৈর্যশীলা জীব।
কবিগন যুগে যুগে নারী কে লইয়া কাব্যরচনা করিয়াছেন, কেহ সিন্ধুহিল্লোল চন্দ্রিকার সহিত, তো কেহ প্রভাকিঙ্করি উচ্ছলাভানুমতী, কোথাও রুপ হংসগামিনী তো কেহ গজেন্দ্রগামিনীর সহিত তুলনা করিয়াছে মৃগনয়নাদিগকে। সাহিত্যিক, ভাষ্কর, চিত্রকরেরা নারী শরীরকে মনুধ্যায়ের ছুরিকাঘাতে ভিন্নভিন্ন অংশে কর্তিত করিয়া সুললিত কাব্যে রসসঞ্চার করিয়াছেন যুগে যুগে। নারীই ভাবনার উৎস। শিল্পসাহিত্যের ভাণ্ডার উচ্ছলিত চিররঙ্গীনি তরঙ্গনী রসবতী দ্বারাই সজ্জিত, কখনো যদি তাহা মানসে তো কখনো প্রতীয়মানে।
কিন্তু ক্ষমতার প্রশ্নে অবলায়নের ইতিহাস অত্যন্ত দ্বীনদরিদ্র। নিতান্তই ব্যাতিক্রম কিছু অধ্যয় ব্যাতিরেকে রমনীদের সহিত রমনীমোহনদের দুরত্ব বেশ কয়েক আলোকবর্ষের। হাতসেপসু, নেফারতিতি, ক্লিওপেট্রা, ইসাবেলা, এলিজাবেথ, ভিক্টোরিয়া, আফ্রিকার আমিনা বা জিঙ্গা, রাশিয়ান এম্পেয়ারের ক্যাথরিন, চাইনিস তু-সাই, বা হাওয়ায়ের লিলিউকালানি হয়ে আমাদের দেশের সুলতানা রিজিয়া বা ইন্দিরা গান্ধী। আর কতিপয় ইতিইতি বিক্ষিপ্ত নাম ব্যাতিত এই তালিকা প্রায় সমাপ্ত। কথিত প্রচলন আমাদিগকের সমাজব্যাবস্থা নাকি ‘পূরুষশাষিত’। কিন্তু সৃষ্টির আদিতে শুধুমাত্র পুরুষ তো আর একা তো এই সমুদায় মানবজাতির বংশবিস্তার ঘটাইতে পারেনি, প্রথম মানবের আবির্ভাবের সাথে সাথেই প্রথম নারীরও নিশ্চিত আগমন ঘটিয়াছিল। নতুবা এই বংশবিস্তার সম্ভবপর হইতো না।
সুতরাং একই সাথে যাত্রা শুরু করিয়াও, স্ত্রীজাতি ক্রমপশ্চাদাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে বা বলা ভাল প্রায়ংশে পত্তনাঘটেই রহিয়া গিয়াছে। কেহ বলিবে স্বল্পবুদ্ধাঙ্কের কারনে বা কেহ বলিবে পুরুষের সমকক্ষ দৈহিক বলশালিতা না রহিবার হেতু এই পশ্চাদবিলাশ তথা স্থবিরতা। কারন সে যাহাই হউক এই বর্তমান প্রযুক্তি বিজ্ঞানের যুগেও, যেখানে মঙ্গলকাব্য মঙ্গলগ্রহের লালমাটিতে বসিয়া রচিত হয়, সেই যুগেও সামাজিক বিন্যাসের প্রতি পদক্ষেপে নারীশক্তি কে আলাদাভাবে উল্লেখ করিতে হয়। নারী ক্ষমতায়নের জন্য পৃথকভাবে ভাবনা করিতে হয়।এবং তাহা পুরুষ জাতিই করিয়া থাকেন, অনেকটা দাক্ষিণ্য হিতৈষিতাবৎ।
ক্ষমতা কাহাকে বলে? সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় ও রাজনৈতিক মতানুযায়ী, নিজস্ব পরিমণ্ডলে কতৃত্বের অধিকারকে ক্ষমতা বলিয়া গন্য করা হয়। বৈধ সামাজিক পরিকাঠামোতে কতৃত্ব সাধনের পথটি একাকি সংগঠিত হইবার পরিসর অত্যন্ত ঋজু। কতিপয় ব্যাতিক্রম ব্যাতিরেকে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই কতৃপক্ষ নামের একটি সমবায় ক্ষমতার ব্যাবহারিক প্রয়োগগুলি করিয়া থাকেন সদস্যদিগের যোগ্যতার বিন্যাসানুসারে।
এবার যোগ্যতা। যোগ্যতা হইল একটি অতি আপেক্ষিক বিষয়। কোন একটি ধ্রুবক যোগ্যতাস্থানে অন্য একটু উচ্চমার্গীয় যোগ্যতার আবির্ভাব হইলে, সেই ক্ষনেই সেই ধ্রুবক যোগ্যতার পদাবনতি ঘটে। অপরপক্ষেও উচ্চযোগ্যতার অপসারনের সাথে সাথেই, নিম্নযোগ্যতা ধ্রুবক মান হিসাবে পরিগনিত হয়। সুতরাং ক্ষমতার কক্ষকেন্দ্রও যে কোন মুহুর্তে পরিবর্তিত হয়। এখন এই যোগ্যতা মান নির্ধারন হইয়া থাকে বলের উপরে ভিত্তি করিয়া। বাহুবল, বুদ্ধিবল আর অর্থবলই যাহার মধ্যে মুখ্য।
নারীকে সন্তানের জন্মদান থেকে তাহাদের লালনপালন করার হেতু, কর্মজীবনের এক বৃহৎ অংশ গৃহুভ্যন্তরেই অতিবাহিত হয়। অরণ্য বাসী জনগোষ্ঠীতে স্ত্রীজাতীও পুরুষদিগের সহিত স্কন্ধ্যে স্কন্ধ জুরিয়া শিকার হইতে যুদ্ধ সকল দৈন্দদিন কর্মই করিত, যাহা আজও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান। এবং যাহা একমাত্র শিশু ব্যাতিত সকল সদস্যদের জন্যই অবধারিত। প্রাচীনকালে একাধিক সন্তান সন্ততি জন্মদান ও পালনের হেতু যৌবনের এক বিস্তৃত অধ্যায় পক্ষান্তরে অধিকাংশ অধ্যয়ই কোথাও বা সমস্ত যৌবনই স্বামী-পরিবার পরিজনের উপরে নির্ভরশীল হইতে হইতেই আজকের রমনী বহুলাংশে কেবলমাত্র গৃহিণী রুপেই রহিয়া যান। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষাই নারীর ক্ষমতায়নের মূল অংশ, যাহা তাহাদের মৌলিক অধিকারও বটে। তাহাদের ব্যাক্তিগত সমস্ত কিছুই স্বামী-সন্তান- আর পরিবার পরিজনদিগকে আবর্ত করিয়া সংগঠিত হইয়া থাকে। বর্তমান সভ্যতাতেও নারী কেবলিমাত্র পুরুষের ভোগ্যবস্তু, সন্তানজন্মদাত্রী ও গৃহকর্মের জন্য বিশ্বস্ত অবৈতনিক সেবিকা রুপেই স্বীকৃতি লভিয়াছে।
এই অবনতির পিছনে প্রধান দায়ী প্রকৃতি, নারীকে সৃষ্টিগত ভাবেই বেশ খানিকটা দুর্বল রুপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। যাহার কৌশলগত লাভ পুরুষজাতী চতুরতার সহিত করায়ত্ব করিয়াছে। এই ভাবেই ধীরে ধীরে ক্ষমতার মূলস্রোত হইতে বিচ্ছন্ন হইতে হইতে , রমণীকুল নিজ স্পর্ধাকে প্রায় ভুলিয়া পুরুষের পদতলে নিজেকে সঁপিয়া দিয়াছে। অভ্যাস বড় বিষম বস্তু। সুতরাং শত সহস্র বৎসরের যুগাভিযোজনের মধ্যদিয়ে এই স্ত্রীস্বত্তা অতিবাহিত হইতে হইতে বর্তমানে অন্তঃপুরের বস্তুসামগ্রীতে পরিনত হইয়াছে, যাহার নিজস্ব মত প্রকাশের সেরুপ স্বাধীনতা নেই। লৌহখণ্ড নির্মিত ধারালো তরিবারিও অব্যাবহারে মরিচা ধরিয়া চূর্নবিচূর্ন হয়। স্ত্রীশক্তিও বর্তমানে সেই ক্ষয়িষ্ণু দশায় উপনীত।
আমরা দেবীরুপে স্ত্রী জাতির পূজা অর্চনা করিয়া থাকি। শক্তির প্রতিক রূপে মান্যতা দিই। কিন্তু ব্যাবহারিকি ক্ষেত্রে এই প্রয়োগ উল্লেখযোগ্য ভাবেই অন্তর্হিত। ইহার কারন নিশ্চিত রুপেই সেই ‘কতৃপক্ষ’ নাম্নী প্রতিষ্ঠান। কারন মানব সমাজবদ্ধ জীব। কতিপয় ক্ষমতাবান ব্যাক্তি, পূর্বে উল্লেখিত ক্ষমতার উৎপত্তি ও বিন্যাস অনুসারে তাহাদের সংবিধান রচনা করিয়া আসিয়াছে। মানব চরিত্রে স্বার্থ ও তৎসম্বলিত অধ্যয় বিচিত্র বিন্যাসে সজ্জিত। আর এই স্বার্থ চরিতার্থ করিবার উদ্দেশ্যে ও অযোগ্যকে যোগ্য করিয়া তুলিবার অভিপ্রায়ে রাজনীতির ছল-চাতুরীর প্রনয়ন ঘটে। সাংসারিক ও প্রাকৃতিক বাধ্যবাধকতার কারনে সৃষ্ট অনুপস্থিতি হেতু কতৃপক্ষ নামক সমিতিতে, মহিলা সদ্যসের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। নীচস্বার্থের কায়ীমি রাজত্ব রক্ষার্তে অযোগ্য পুরুষ কতৃপক্ষ গন, কখনো সামাজিক বিধান, কখনো ধর্মীয় বিধান বা কখনো নিতান্তই বলপূর্বক, ক্ষমতার অপব্যাবহার করিয়া নারীকে যোগ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করিতে করিতে, সেই চলমান ঘরানাকেই বিধান রূপে স্থাপনা করিতে সক্ষম হইয়াছে।

বিজ্ঞানের নিয়মেই, কেহ মূলকক্ষপথ থেকে বিচ্ছিন্ন হইয়া গেলে পুনরায় নতুন কোন বল ব্যাতিরেকে সেই পুরাতন কক্ষপথে পুণঃস্থাপিত হইবার আশা নাই বলিলেই চলে। এক্ষনে এই বল বাহ্যিক বা আভ্যন্তরিন, যেকোনটিই হইতে পারে। মাঝে মধ্যেই আমরা ইতিস্তত যে নারী শক্তির উত্থান পরিলক্ষিত করি তাহা নিতান্তই কোন এক বিশেষ ব্যাক্তির আভ্যন্তরিন বলের দ্বারা প্রাপ্ত শক্তির জয়। যাহা ওই নারীকে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে লব্ধপ্রতিষ্ঠ করিতে সক্ষম হইয়াছে।
আজিকে চতুর্দিকে একটা গুরুগম্ভীর ঢক্কানিনাদ, যে নারীকে ক্ষমতা প্রদান করিতে হইবে। বর্তমান বিশ্বলোকে ইহাই অন্যতম সার্বজনীন বিষয়। কিন্তু আমরা এই নির্লজ্জ উদযাপন করিয়া কি রমনীকুলকে অনুকম্পা দেখাইতেছি না! নারীর মৌলিক ক্ষমতা, তাহাদের জন্মগত অধিকার, বাকি সমাজ অনৈতিক উপায়ে যারা রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা সলজ্জ ও সসম্মানে নারীজাতিকে ফিরিইয়া দেয়ার মধ্যেই গৌরব, সলাঙ্কার অনুষ্ঠানের মধ্যে নহে। উন্মাদীয় মতে সেটা নিশ্চিত রুপেই স্ত্রীজাতীর অপমান। কারন নারী কখনই অনুগ্রহের পাত্র নহে। দান করা বস্তুর উপরে দাতার একটা আমিত্ব ভাব লুকাইয়া থাকিবেই। অনেক ক্ষেত্রে দানকৃত বস্তু কারিয়া বা ছিনিয়া লইবার নিকৃষ্ট উদাহরনেরও অভাব নাই। তাই ক্ষমতায়ন দান বা প্রদান নয়, নারীকে স্বীয় বলে তাহা অধিকার করিতে হবে। তবেই তাহা কায়েমি ও গরিমাময় হইবে।
নারীর ক্ষমতায়ন শুধুমাত্র নিজস্ব স্বার্থ বা স্ত্রীজাতীর স্বার্থ সুরক্ষিত করিবার উদ্দেশ্যে হইলে, তাহা অল্পদিনেই আবার হাতছারা হইতে বাধ্য। পরিবার ও সংসারই হইল রাজনীতির সুতিকাগৃহ, আর সেই সংসদের অধিপতি নিঃসন্দেহে রমনীগন। তাহা হইলে সঠিক শিক্ষা ও পরিচর্চা পাইলে স্ত্রী জাতির অসাধ্য কোন কোন কর্ম নাই এই ভূলোকে, যাহার সম্পাদন করিতে অক্ষম। ক্ষমতাবান নারীগনদিগকে গোটা সমাজের জন্য ভাবিবার অভ্যাস করিতে হইবে। এমন এক পরিবেশের জন্ম দিতে হইবে যেখানে প্রভুত্বের বদলে মমত্বের রাজত্ব চলিবে। উদাহরণস্বরূপ একজন মহিলা আরক্ষা কর্মীর পিছনে যেন তিন জন পুরুষ কর্মীকে পাহারা দেবার জন্য না থাকিতে হয়। উক্ত পেশায় যথেষ্ট পরিমানে প্রশিক্ষিত মহিলা কর্মীর সংস্থান থাকিলে তাঁহারা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করিবার পাশাপাশি সমাজকে সুরক্ষা প্রদান করিতে সক্ষম। কারন এই নারীই নিতান্ত অসহায় শিশুকে আপন ক্রোরে সুরক্ষা প্রদান করিয়া তাহাকে পৃথিবীর উপযুক্ত করিয়া তোলে। অন্যথায় এই দূর্দশাগ্রস্থ বৈষম্য ঘুচিবার নহে।
অনেক পন্ডিতগন সমাজের সর্বস্তরে নারীদের সমান অধিকারের দাবী উঠাইয়া থাকেন। কিন্তু তাহা সমাজের পক্ষে আরো ভয়াবয়। অধিকারের দাবি যদি তুলিতেই হয়, তাহা হইলে মহিলাদের জন্য উচ্চশিক্ষা আবশ্যিক করার দাবি করা হউক। প্রয়োজনে প্রকৃত দুঃস্থদের জন্য নিঃখরচায় তাহার বন্দ্যবস্ত করা হউক। স্বভিমান জাগ্রত না হইলে, সমান অধিকার কখনই রক্ষিত হইতে পারে না। আর স্বধিকারকে প্রকৃত শিক্ষা বিনা জাগ্রত করিবার দ্বিতীয় পন্থা নাই।
সরকার বাহাদুর আইন প্রনয়ন করিয়া, স্বীয় পছন্দ ও স্ববিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে নারীদের মধ্যে আনয়ন করিয়া, ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরনের একটা সৎ প্রয়াস চালাইতেছেন, নিঃসন্দেহে সাধু প্রয়াস, কিন্তু কতজন নারী সেই পর্যন্ত পৌছাইতে পারিতেছেন! ইহা কেবলিমাত্র কয়েক শতাংশ দপ্তরী রমনীকুলের ক্ষেত্রেই লাগু। বিভিন্ন সামাজিক , সরকারি ও ধর্মীয় মানদন্ডের যাঁতাকলে পিষ্ট, গৃহ ও কর্মস্থলের মধ্যেকার দুঢ়হ সমন্বয় রক্ষা করিবার কর্মটি অত্যন্ত বন্ধুর, তাহার উপরে চলমান লিঙ্গবৈষম্যের এক অলঙ্ঘ্যনীয় বেড়াজাল নাগপাশের ন্যায় বেশকয়েকটি প্রজন্মকে ঘিরিয়া রহিয়াছে, সেই প্রাচীরকে সকলের পূর্বে বিলীন করিতে পারিলে, তবেই কর্মস্থল কে নিরাপদ বানানো যাইতে পারে।
স্ত্রীলোকাদিগনে ক্ষমতাবান হইতে গেলে নিশ্চিত রুপেই সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী রুপে আত্মজাহির করিতে হইবে। এই সৌন্দর্য মোটেই রঙ ও প্রসাধন সর্বস্ব কোমোলাঙ্গী নহে, বিদ্যা বুদ্ধি ব্যাক্তিত্ব ও সুস্থ সক্ষম শরীর দ্বারা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাকে পরাক্রান্ত করিয়া সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটানোর নামই সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। এবং এই পদ্ধতিটিকে ব্যাক্তিকেন্দ্রিক আবদ্ধ না রাখিয়া সমাজের প্রত্যন্ত স্তরে পৌছাইইয়া দেবার মধ্যেই এর ক্ষমতায়নের সফলতা নির্ভর করিবে। কারন কতৃপক্ষ নামক সমিতিতে যতক্ষন না সমসংখ্যক বা পুরুষের অধিক স্ত্রী ক্ষমতার উপস্থিতি থাকিবে, ততক্ষন পর্যন্ত ক্ষমতায়নের বিন্যাস পরিষ্ফুটিত হইতে পারেনা। আর শিক্ষাই এই ক্ষমতায়নের প্রাথমিক শর্ত। কারন শিক্ষা ব্যাতিত জ্ঞানের উন্মোচন সম্ভবপর নহে। অধিকার বোধ সঞ্চারিত করিতে আত্মপ্রত্যয়ের প্রয়োজন, আর সেই শক্তি অবশ্যই মানসিক। যাহা চরিত্র গঠনের অনুশীলনের মাধ্যমে গঠিয়া উঠে। সহিষ্ণুতা নারী চরিত্রের অন্যতম গুন, যাহা পুরুষ অপেক্ষা কয়েকগুন বেশী। সতরাং সহিষ্ণু ব্যাক্তির নিকটে ক্ষমতা ন্যাস্ত থাকাটা, সকল ক্ষেত্রেই সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করিয়া থাকে।
শিশুর প্রথম শিক্ষা মাতৃক্রোড়েই। তাই স্ত্রীশক্তির জাগরন বিনা বীর জন্ম নিতে পারেনা, ব্যাতিক্রম রহিত। নারীর শৃঙ্গার নিশ্চই থাকিবে, সনাতনী ভ্রুপল্লবের ছুরিকাঘাতের সাথে সাথে অসিবিদ্যাতেও পারঙ্গম হইতে হইবে। স্তন- যোনী-নিতম্বের অধিকারিণীগন শুধুই শয্যাসঙ্গিনী নয়ে, তাহা প্রমানের দায়িত্বভার স্ত্রীজাতিরই। সলজ্জ অবগুণ্ঠন উঠাইয়া জ্ঞানের আলোককে প্রবেশের অধিকার দিতে হইবে। যে পুরুষ নারীকে অবদমিত করিয়া রাখিয়াছে, তাহারা ওই নারীর যোনীদ্বার হইতেই ভুমিষ্ট হইয়া স্তনযুগল হইতে অমৃত সুধা পানকরাইয়া দৈহিক শক্তি প্রদান করিয়াছে। সুতরাং যাহারা পুরুষের জন্ম দেন, তাঁহারা কোন অংশেই পুরুষ হইতে কম যোগ্যতার হইতে পারেনা। শুধু আত্মবিশ্বাসটুকু প্রয়োজন।
আমরা যারা নারী ক্ষমতায়নের জন্য চিৎকার করছি, তাঁহারা সর্বপ্রথমে নিজ গৃহের ভগিনী, কন্যা, ও স্ত্রীকে শিক্ষিত করিয়া তুলি। তাহার পর নিজ পড়শিগনকে, স্পম্ভপর হইলে আত্মীয়স্বজনদিগকে। এইভাবে সম্মিলিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সমবেত ভাবে শুভারাম্ভ করিলে অচিরেই নবরুপে ক্ষমতার বিন্যাস হইবে। যাহার প্রত্যক্ষ সুফল গোটা সমাজের সাথে সাথে বিশেষ করিয়া পুরুষ জাতিই উপভোগ করিবে। দায়িত্বের বাঁটোয়ারা হইবে। প্রদেয় ক্ষমতা হইতে স্বহস্তারোপিত ক্ষমতা অনেক অধিক ইজ্জতের।
কারন ক্ষমতা মানে শুধুই প্রভুত্ব নহে, ক্ষমতা মানে স্কন্ধে ভরষার হস্ত অর্পন করিয়া, সকল পরিস্থিতিতে সাথে থাকিবার আশ্বাস।
তবেই হইবে ক্ষমতার প্রকৃত অবলায়ন।
~~~~~~~~~
বিঃদ্রঃ- উন্মাদীয় বানানবিধি অনুসৃত।
উন্মাদ হার্মাদ
১৪/১২/২০১৫

Monday, 7 December 2015

পান্ডুরোগ


উন্মাদীয় সোমরস


(উন্মাদীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্নিত প্রতি সোমবারের জন্য নতুন সিরিজ)

পাণ্ডুরোগ 


আজ আলোচনা করবো আমাদের কোলকাতার নগরজীবনের এক বিলুপ্ত হতে চলা চলমান ইতিহাস নিয়ে।
শেষ দুই সপ্তাহ প্রায় হাসপাতাল আর নার্সিংহোমেই কেটে গেল। নিঃসন্তান মাসীমার মিনি স্ট্রোক দিয়ে শুরু, ন-কাকার ফার্ষ্ট এটাক দিয়ে এযাত্রায় আপাতত স্বস্তি। জানিনা আবার কেও অপেক্ষা করছে কিনা। এই বহুল বিজ্ঞাপিত “_সান হাসপাতাল” ঠিক কতটা জোচ্চোর বিপদে না পড়লে তো বোঝা যায় না। চিকিৎসার মান ওই তথৈবচ। খুড়তুতো ভাইএর সকলেই স্কুল পড়ুয়া। বাড়ীর বড় ছেলে হবার দরুন দায়িত্বগুলো অটোমেটিক আমার কাঁধেই এসে পরে। কার ছুটি জানিনা, তবে আমার সত্যিই ছুটি ছিলোনা।
তবে আমি যদি এড়িয়ে যেতাম , তাহলে হয়তো দ্বিতীয়বার কেও আসতোই না। তবে আমি সচেতনভাবে মোটেই সেটা করিনা। আত্মীয় বা বন্ধু দের বিষয়ে তো যেচে, দায়িত্ব না নেবার কোন প্রশ্নই নেই। সেটা কর্মচারী হোক বা পড়শি , নিজের সেরা টুকু দিয়ে চেষ্টা করি। যাতে সময়মত নুন্যতম চিকিৎসা টুকু তিনি পান। আমার মতে কাওকে সত্যিকারের সাহায্য করতে চাইলে, তার মূমূর্ষ পরিস্থিতিতে হাতটা বাড়িয়ে দিন।
বন্ধু বা শত্রু, আপনি চাইলেই ইচ্ছামত স্বার্থত্যাগ বা জোড়ের মাধ্যমে সেটার পরিবর্তন করতেই পারেন। কিন্তু প্রতিবেশী বদলানো যাইনা। একান্তই বদলাতে চাইলে নিজের মূলই উৎপাটন করতে হয়। তাই তাদের প্রতি সহযোগিতা মুলক দৃষ্টিভঙ্গী রাখা প্রয়োজন। যদিও সেই সম্পর্ক অপরপক্ষ থেকে প্রেরিত প্রত্যুত্তরের উপর ভিত্তি করে স্থায়িত্বের সীমারেখা নির্দেশ করে।
এরই মাঝে বিপত্তি। আমার গাড়ির সারথি, তারাহুরো করে যাবার ব্যার্থ চেষ্টার দরুন, পরমা আইল্যান্ডে- যেখানে বিশ্ব বাংলা টা ঘুরছে ঠিক সেইস্থানে একটা সরকারী বাস, মানে ওই বিশালদেহী গুলো, গা জোয়ারী ওভারটেক করতে গিয়ে, পিছনের বাম্পারের দিকথেকে বিপজ্জনক ভাবে দাঁত বেড় করে থাকা একটা লোহার এঙ্গেল দিলো আমার গাড়ির ভিতরে সেঁধিয়ে। বডির কিছুটা অংশ চামচের মত খাবলা করে তুলে নিয়ে যাবার যেন বরাত পেয়েছিল। এমনিতেই এই হ্যাচব্যাক বা সেডান কার গুলোকে আমার দেশলাইয়ের খোল ব্যাতিরেকে অতিরিক্ত কিছুই মনে হয়না। আশ্চর্যজনক ভাবে আমি, আমার দুই সাথী ও ড্রাইভার অক্ষত রয়ে গেলেও, বামপাসের বনেট থেকে প্রায় তিন হাত ও ৫ ইঞ্চি চওড়া গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে দিয়ে গেল। আর সামান্য হলে আমার বাম ঊরুও গেছিলো আর কি। এক নিমিষেই গাড়িটি লজঝড়ে হয়ে গেলো।
কাকে কি বলবো? পুলিশকে বলতে গেলাম। উলটে তেনারা কোলকাতার বাইরের গাড়ির নাম্বার দেখে, স্বউৎসাহে আমার ড্রাইভারের লাইসেন্স সিজ করে নিয়ে, একটা কেস ঠুকে দিল। লে হালুয়া। হঠাৎ খেয়াল পড়ল, আইন আইনের পথে চলবে। এখানে পুলিশই আইন। তাই তাঁর নিদানই বিধান। তাছারা আমি নিজেও জানিনা আসল দোষী ঠিক কোন জন!! আমি তো ফেসবুকে ব্যাস্ত ছিলাম, রক্ষে সিটবেল্ট বাঁধা ছিল। বিরস বদনে হাসপাতালের প্রাথমিক কাজকর্ম ও আমার ব্যাবসায়িক কাজকর্ম আপাত সমাপ্ত করে পুনরায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
তবে এটা গাড়ির হাসপাতাল, পোশাকি নাম সার্ভিসিং সেন্টার। এবং প্রত্যাশা মতই, ইনস্যুরেন্স থাকা স্বত্তেও যৎসামান্য ফিরত পাবারই আশার বানী শুনলাম। তখন সন্ধ্যা প্রায় ৬ টার উপর, সোয়া ৬ টা হবে বোধহয়। স্থানটা তোপসিয়া রোডে ট্যাংরার কোন অঞ্চল হবে বোধহয়। আশেপাশে চায়না টাউন। ঘিঞ্জি পরিবেশ। ধাপার সিগনেচার গন্ধ ও চামড়ার গন্ধ মিশে একটা অতি জঘন্য গন্ধে ম ম করছে, পরিবেশটা। সস ও নুডলসের কারখানার পাশে ছরিয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু নাইটক্লাব। হেঁটে হেঁটেই বড় রাস্তার দিকে আসছিলাম। হাওড়া স্টেশন পৌছাতে হবে। ওটাই আমাদের গন্তব্য।
খানিক চলতেই কি যেন একটা ভুলো কথা মনে পড়ল। হুম... সারাদিন কিছু খাওয়াই হয়নি। সাথের তিনজনও গাড়ির শোকেই হোক বা পরিস্থিতির প্রতিকুলতাতে, খাবার নিয়ে কেও এতক্ষন উচ্চবাচ্য করেনি। আসে পাশে বহু চাইনিজ স্টল। তবে প্রাথমিকভাবে আমার সাথীরা সেখানে কেউই রাজী হলো না ওখানে খেতে। ওদের মতে চীনারা নাকি গরু শুয়োর কুকুর টিকটিকি সবই খায়। তাই নো রিস্ক। অগত্যা আরো এক কিমি হেঁটে একটু এলেই গেছিলাম। মাঝে ট্যাক্সি পাবার বৃথা প্রচেষ্টা সমবেত ভাবেই চালু ছিল হাত নেড়ে নেড়ে।
নাহ... আর নয়। এখানেই বসবো। আর যা হোক কিছু এখানেই খায় বলে ক্লান্ত শরীরে, একটা স্টলের বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। সাথে বেশ কিছু লাগেজ আছে। ভেজ চাও আর মোমো খেয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ওই দোকানিকেই শুধালাম... দাদা হাওড়ার ট্যাক্সি কোথা থেকে পাওয়া যাবে? উনি চোখ ছানাবড়া করে বললেন, চাউলপট্টির ওদিকে দেখতে পারেন, এদিকে পাবেন বলে মনে হয় না। সত্যিই তাই হলো। যাও বা এক আধটা পেলাম, ভাড়া যা হাঁকল, তাতে বোধহয় ট্যাক্সি কেনার লোনের একমাসের কিস্তি দেওয়া হয়ে যাবে।
দোকানে এক টেনিয়া ছোকরা এঁটো বাসনকোসন ধোয়, আর টেবিল সাফ করে। সে ই বললো, ও দাদা... “মোবাইলে একটা টেকসি কেটে নিন না কেনে”! বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ হয়, এফ এমে সারাদিন এতো এ্যাড শুনেও আমাদের কারোরই মাথায় আসেনি। ওলা, উবের, মেরু, ট্যক্সি ফর সিওর আরো কত্তো কি। রেস্টুরেন্টে স্ট্যাটাস রক্ষার তাগিদ সত্বেও সকল সময় ওয়েটার কে টিপস না দেওয়া সেই আমিই, অবচেতন মনে ছেলেটির হাতে ২০ টাকা গুঁজে দিলাম। আসলে ট্যক্সি না পাওয়ার অসহিষ্ণুতাটা চরমেই পৌছেছিল, ওটা তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল। ওলা এপস দুম করে ডাউনলোড করে নিলাম।
মোবাইল এপসের স্বয়ংক্রিয় নির্দেশ অনুশরনের মাধ্যমে এক মিনিটের মধ্যেই আমার মোবাইলের স্ক্রিনে ট্যাক্সি নাম্বার, ড্রাইভারের নাম ছবি ও মোবাইল নাম্বার ভেসে উঠলো। এবং সময় নির্ধারন করেদিল, যে ৪ মিটিটের মধ্যে আপনার ট্যক্সি এসে পৌছাবে। যথারীতি ঠিক ৪ মিনিট হবার আগেই একটা সাদা ফিয়াট সেডান এসে হাজির। ভাড়ার দিকে খেয়াল করার সময় ছিল না। কারন যেকোন উপায়ে হাওড়া স্টেশনে পৌছনোটাই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।নাহলে ট্রেন মিস হবে।
গাড়িতে বসতেই AC স্টার্ট হয়ে গেল, সাথে মিউজিক সিস্টেমে সুমধুর সুরে চলতি হিন্দি গান। সুন্দর একটা ভুরভুরে মিষ্টি গন্ধ। মাথায় সাদা হ্যাট পড়া ড্রাইভার। সাদা ড্রেস। সামনে রাখা একটা মোবাইলস্ক্রিনে ম্যাপটা দেখাচ্ছে। খানিক পরেই হাওড়া পৌছলাম। স্ট্যান্ডে নামতেই টুক করে মোবাইলে ম্যাসেজ এলো। ড্রাইভার বললো “স্যারজি ম্যাসাজ আ গ্যায়া, দেখ লিজিয়ে” দেখলাম ১৪০ টাকা ভাড়া। কথা না বাড়িয়ে মিটিয়ে দিয়ে স্টেশনে ঢোকার তাড়ার মাঝেই, ড্রাইভারের উচ্চস্বরে একটা অনুরোধ কানে এলো, স্যারজি স্মাইলি মত দেনা ভুলিয়ে, গরিব আদমি হাম। ক্ষনিকের জন্য দাড়ালাম, মুখটি হাসিহাসি করে ড্রাইভারের আবদার মিটিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পরে বুঝেছিলাম স্মাইলি আসলে এ্যাপসেই ফিডব্যাকে দেবার কথা বলছিল। কারন রাতে ইমেলে তাদের লম্বা একটা ফর্দ পেলাম, যাতে সবিস্তারে আমার যাত্রাপথের যাবতীয় বিষয়ে বিশদে বর্ননা করা ছিল।
SUV কোলকাতায় পার্কিং করার খুব ঝামেলা, তাই পরদিন ফের ভায়া ট্রেন হাওড়া। কারন আজব খুড়োর কলের সন্ধান পেয়ে গেছি। নিজস্ব গাড়ির মত্ন যখন খুশি রেস্ত ফেললেই সুসজ্জিত বিলাসী গাড়ি হাজির। তাই ট্রেনই বেষ্ট। এদিকে বহুদিনের অনভ্যাস। সেই কলেজ ছারার পর ১৪-১৫ বছর, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রায় চাপাই হয়না। একটু অনভ্যাসের ফোঁটা চড়চড় করছিলো। হাওড়ায় নেমে ঘাট পেরিয়ে হাইকোর্ট চত্বরে যাবো, ট্যাক্সি ধরার দরকার ছিল না। দুপর নাগাদ যাবো সেক্টর ফাইভ। একটা প্রোজেক্টের বিষয়ে আলোচনা ছিল। সর্বহরার একমাত্র হাতিয়ার স্মার্টফোন, এই যন্ত্রের মত ইউটিলিটি আর কোন ইলেকট্রিক গেজেট করেছে কিনা সন্দেহ। লিফট থেকে নামতে নামতেই ট্যাক্সি বুকড, ধাঁ করে সটাই হাজির। এটা ওই এ্যাপসের ভাষায় কালি-পিলি ট্যাক্সি। রাজস্থানি পদবীর বাঙালী ড্রাইভার। বেশ মিশুকে। আজ আর মানসিক তাড়া ছিল না। তাই এ্যাপস কোম্পানি আর এই গাড়ীওলাদের সমযোজী বন্ধন প্রক্রিয়াটা কে জানার ইচ্ছাটা বিপ্লব ঘোষণা করে উঠলো। গল্পবাজ ড্রাইভার পেয়ে চঞ্চলমতিকে উপশম দেবার অযাচিত সুযোগ হাজির। ড্রাইভারকে একটা সিগারেট অফার করতেই গদগদ। বয়স আন্দাজ ৫০ এর মধ্যেই। কিন্তু দারিদ্র্যের নৃশংস থাবা যেটাকে আরো বছর ১৫ বেশী দেখাচ্ছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম-
~ বাহ আপনি তো দারুন মোবাইল চালান। কবে শিখলেন?
~ বাবু, আমাদের স্ট্যান্ডে এসে কোম্পানীর লোক শিখিয়ে দিয়ে গেছে।
~ কোন কম্পানী?
~ ওই যে, চারিদিকে সব এড শুনছেন না, *** কোম্পানি। ওরা সল্টলেক থেকে আসেন, পার্কসার্কাসের কাছে কোন একটা মলে ওদের হেড অফিস।
~ তা, তোমাদের কত দিতে হল? মানে এই গুলো শিখতে?
~ হা হা হা, আমরা কেনে দেবো বাবু, বরং ওরাই আমাদের দেয়। যেদিন ক্লাস থাকে ওরা দুপুরে ফ্রিতে খাবার দেয়।
~ বাহ, এ তো দারুন ব্যাপার। আচ্ছা এই মোবাইলটা কত দিয়ে কিনতে হয়েছে?
~ কিছু না বাবু। ফ্রিতে দিয়েছে, এই মোবাইলটা আর এই ম্যাপ দেখা মেসিনটা। মোবাইলের কথাবলার বিল ওরা আর্ধেক দে, বাকিটা মার। আর ইন্টারনেটের টাকাও ওরাই দিয়ে দেয়।
~ আরে এতো ফাটাফাটি ব্যাপার, দেখছি। কিন্তু যদি কেও চুরি করে নিয়া পালাই?
~ না বাবু, ওদের লোক তো সব্ব স্ট্যান্ডেই আছে, ধরা পরে যাবে। আর পুলিসের সাথে কোম্পানীর খুব ভাব। আমাদের গাড়ির কাগজের জেরক্স আর ড্রাইভিং লাইসেন্সের জেরক্স রাখা আছে, ওদের কাছে। আর গাড়িতে কি একটা মেসিন লাগানো আছে, যার জন্য আমরা যেখানেই যাই না কেন , ওরা ঠিক বুঝে যায়।
~ বুঝলাম। তা এই যে আমার ভাড়াটা কোম্পানী তোমাকে পাইয়ে দিলো, তোমাকে কত কমিশন দিতে হবে কোম্পানীকে?
~ না বাবু। আমি কেনে দেবো? বরং কোম্পানী আমাকে প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা দেয়। তবে সারা দিনে কোম্পানীর ৩ টে ট্রিপ মারতেই হবে, তাহলেই দেবে, মোট ৩০ টাকা। ওভার খেটে দিলে আরো বেশী। কোম্পানী এসে আমাদের বেশ ভালো হয়েছে বাবু। বিনা পয়সায় চিকিৎসা পর্যন্ত করিয়ে দিচ্ছে। আজকাল কে এমন মাগনা দেয় বলুন!
~ কিন্তু কোম্পানি এমন মাগনা কেন দেয়? তাদের কি লাভ?
~ সে আমি কি করে বলবো? আমার কাঁঠাল নিয়ে দরকার। কোন গাছের তা খুঁজে কি লাভ...
~ তা ঠিকিই বলেছো। কিন্তু এটা তো তোমার বা তোমাদের জানা দরকার। বিনা স্বার্থে কেও কিছু কি দেয়? তুমি হলে দিতে?
~ ওরা বলে বিজ্ঞাপন থেকে ওদের নাকি আয় হয়, সেখান থেকেই দেয় বোধহয়...............
ইতিমধ্যে আরো নানা কথার ফাঁকেই গন্তব্যে পৌছে গেছি। আর ততক্ষনে এই এ্যাপস ট্যাক্সির বিষয় পরিষ্কার করতে গিয়ে যে আরো জটিল আবর্তে পড়ে গিয়ে হাঁসফাঁস করছি, তা বলাই বাহুল্য। সেখানে কাজ সেরে আবার ট্যাক্সি, ওই একই উপায়ে। এভাবে ৫-৬ দিনে প্রায় ২০-২৫ বার ট্যাক্সিতে চেপে ও তাদের ড্রাইভারদের সাথে কথা বলে যেটা বুঝলাম, সেটা হল... এ এক নিদারুন প্রকাশ্য ডাকাতি। এবং স্লো পয়জেনিং। ভয়ঙ্কর রকমের চক্রান্ত।
কোম্পানী- রাষ্ট্র- আর ইউনিয়ন নেতাদের ত্রিবেনী সঙ্গম।
কিন্তু কি ভাবে?
ভারতের অন্যান্য বড় শহর গুলোর মধ্যে দিল্লিতে হলুদ ট্যাক্সি সবচেয়ে কম। ব্যাঙ্গালুরু মুম্বই বা চেন্নাইতেও তথৈবচ। অটোর দৌরাত্ব অবশ্য সব শহরেই বিদ্যমান। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে তো এমন অবস্থা ছিল না। বাসের আধুনিকিকরন হয়েছে, এসি ভলভো বাস এখন অহরহ। অটোর স্থানও দ্রুত টোটো দখল করছে, তাহলে ট্যাক্সি কথায় গেলো? দিল্লিতে নাহয় মেট্রো ব্যাবস্থা খুবই উন্নত। হলুদ ট্যাক্সি কেন হারিয়ে যাচ্ছে ওই শহর গুলোতে? হয়তো প্রশ্ন উঠবে, কোথায়! এই তো কলকাতায় হাজার হাজার হলুদ ট্যাক্সি। বা এখন এম্বাস্যাডর বন্ধ হয়ে নীল সাদা ট্যাক্সির গাদা। আসলে মজাটাই ওখানে। পশ্চিম, দক্ষিন বা মধ্যভারতের মেগা সিটিগুলোতেও কয়েক বছর আগে এমন হাজার হাজার ট্যাক্সি দেখা যেত। আজ প্রায় বিলুপ্ত। আগামীর কোলকাতাতেও এই অবস্থা আসন্ন।
এই এপস নির্ভর কোম্পানী গুলোর এক আধটা বাদে সবই প্রায় বিদেশী কোম্পানী। কনসেপ্টটাও তাদেরই। আর তাদের লক্ষ্যমাত্রাটা দীর্ঘমেয়াদী। যেমনটি পুঁজিবাদেরা করে থাকে। প্রথম ৩-৪ টে বছর বিনিয়োগের সময়। তারপর থেকে মুনাফা। যেটা একসময় শোষনে পরিনত হয়। ছোট ছোট ব্যাবসায়দের প্রতিযোগিতাথেকে ছিটকে ফেলে দিয়ে, মোনোপলি ব্যাবসা। যেটার ট্রেলার দিল্লিতে সবে শুরু হয়েছে, কোলকাতায় আসতে আরো ২-৩ বছর কমপক্ষে।
প্রথমে প্রতিটা কোম্পানী প্রত্যেক এড়িয়ায় দু একটি করে গোটা ২০-৩০ নিজস্ব ক্যাব বাজারে নামিয়েছে। তাদের ড্রাইভার গুলো তবকাধারী। আমার প্রথম দিনের চড়া ড্রাইভারটির মত। ওই ড্রাইভারের আথিতেয়তা ও কেতা দেখলে, নিজেকে ওই যাত্রাকালীন সময়টুকু কেমন যেন কেউকেটা কনে হতে বাধ্য। এই ড্রাইভারগুলো প্রত্যেকেই কোলকাতার অন্যান্য ড্রাইভারের তুলনায় অনেক বেশি বেতনভুক। আর চরমভাবে প্রশিক্ষিত। স্ট্যান্ডে থাকা কালিন এরাই বাকি ড্রাইভারদের মগজ ধোলায় করে। এদের সফট টার্গেট একটু নতুন গাড়ি আর অল্পবয়স্ক ড্রাইভার। এরই মাঝে কোম্পানী তাদের ক্যাম্পেনিং প্রোগ্রাম চালায়, আর গরীব ড্রাইভারদের ফ্রি চিকিৎসা ও উপহারের উপঢৌকন। আর ভারতীয়দের সহজাত স্বভাবই হল, ২টাকার ফ্রি কে করায়ত্ব করতে ১০ টাকা পর্যন্ত খরচা করে ফেলে। আর এখানেই কবি কেঁদেছেন।
এই এ্যপস বা ফোনে বুকিং করা ট্যাক্সির ভাড়া সিস্টেম কেমন? এরা সাধারনত তিন ধরনের পরিষেবা প্রদান করে। এই শ্রেনিবিভাগকে বিভিন্ন কোম্পানীর তাদের নিজস্ব কোডনেম দ্বারা চিহ্নিত করে। ছোট হ্যাচব্যাক গাড়ি, সেডান গাড়ি, আর চিরাচরিত হলুদ ট্যাক্সি। ছোট হ্যাচব্যাক গুলোতে চাপলেই কমপক্ষে ৯৯ টাকা ভাড়া গুনতে হবে প্রথম চার কিলোমিটারের জন্য। পঞ্চম কিলোমিটার থেকে ৮/- কিমি হারে ধার্য হবে। এবং যাত্রা শুরুর ২ মিনিট পর থেকে যাত্রা শেষ হওয়া পর্যন্ত যতমিনিট হবে, ততটাকা দিতে হবে। মোদ্দা কথা হল, কেও যদি ১৫ কিমি দুরত্ব সাওয়ারি করেন ৩০ মিনিটে , তাহলে তাকে গুনতে হবে ৯৯+(১৫-৪)১১*৮=৮৮ + ২৮ টাকা।
সর্বমোট ২১৫ টাকা, আর এর সাথে সার্ভিস ট্যাক্স ৪ থেকে ১৪.৫ শতাংশ। গড়ে ৯ শতাংশ। মানে ২১৫ এর সাথে আরো কমপক্ষে প্রায় ২০ টাকা যোগ হয়ে, মোট ভাড়া দাঁড়াবে ২৩৫ টাকা মাত্র।
সেডানের ক্ষেত্রেও অনুরুপভাবেই, তবে ওই চার কিমির পর ভাড়া কমপক্ষে ১১ টাকা প্রতি কিমি। বিভিন্ন কোম্পানীর ফেরে এই কিলোমিটার প্রতি ভাড়ার দরটা সামান্য হেরফের করে মাত্র। বাকিটা কমবেশি প্রায়ই একই। শুধু নামের হেরফের। “সিওর ফর ট্যাক্সি” নামের মত এক আধটা কোম্পানিই আছে, যেখানে নুন্যতম ভাড়া ৯৯ এর স্থানে ৩৫ টাকা। বাকিটা একই পদ্ধতি। তবে এই পরিষেবা খুবই অপ্রতুল।
যেগুলো কোম্পানির নিজেদের গাড়ি সেগুলোতে ড্রাইভারদের ৮-১২ ঘন্টা করে ডিউটি। এর মাঝে সব মিলিয়ে এক ঘন্টার বিশ্রাম। মাসে চারটি ছুটি সহ ১২০০০/- থেকে ১৮০০০/- টাকার ইর্ষনীয় বেতন। বাকি সমস্ত উপার্জনই কোম্পানির। এবার যারা ভাড়া খাটে কোম্পানীদের কাছে, তাদের হিসাবে আসা যাক। এদের প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র চুক্তি। মোটামুটিভাবে ভাড়ার সমস্ত টাকাটা গাড়িমালিক পায়। ওয়েটিং মানে সময়ের দরুন মিনিট প্রতি যে টাকাটা হয়, সেটি কোম্পানির। যে পেমেন্ট গুলো অনলাইনে হয়, সেগুলো থেকে প্লাস মাইনাস করে একাউন্টস মেনটেইন করে থাকে।
এই গাড়িগুলোর প্রত্যেকের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক কোটা থাকে, কোম্পানির অনুমতি ব্যাতিরেকে ইচ্ছাকৃত কম ভাড়া গ্রহন করলে এদের জরিমানা দিতে হয়, যেটা মাসের শেষে এডজাষ্ট হয়। তেমনই কম ভাড়া হলে বা কোটার বেশী ভাড়া খাটলে যথাক্রমে নুন্যতম ক্ষতিপূরণ ও পুরষ্কারের ব্যাবস্থা থাকে। সেটা কিন্তু হাতেগরম, রোজকারটা রোজ ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমা হয়। এখানে অনেক প্রাইভেট গাড়ি, যারা কেবল নিজেরা যাতায়াত করেন, আর সেটা শুধু অফিস ড্রপ করে পার্কিং এ থাকতো, আবার সেই সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরা। এগুলোও কমার্সিয়াল ট্যাক্স দিয়ে হলুদ নাম্বারপ্লেট সহ মাঝখানের ওই সময়টুকু এই কোম্পানী গুলোর জন্য খেপ খেটে দিচ্ছে। যেহেতু ভাড়া খোঁজার ঝামেলা নেই, ড্রাইভারের চুরি করার স্কোপ ও কম, তাই “আমের আম, আটিরও দাম” অনেক গাড়ির মালিকই এই পন্থায় যুক্ত। এতে ইনকামটা খুব খারাপ আসে না। তার উপরে ধোপদুরস্ত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এই গাড়ি গুলো যাত্রীদের বেশিই পছন্দ।
শেষের জন। আমাদের চিরাচরিত হলুদ ট্যক্সি। এম্বাসেডর কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাবার দরুন বর্তমানে নীল বর্ডার সাদা সুজুকি ডিজায়ার অধিকাংশ জাইগা দখল করেছে। এদের দিয়েই কথোপকথনটা শুরু করেছিলাম। এদের ভাড়ায় কোম্পানির কোন হস্তক্ষেপ নেই। এদের ভাড়া সরকার নিয়ন্ত্রন করে। যাত্রী মোট ভাড়ার উপর অতিরিক্ত ১০ টাকা দেবে, আর কোম্পানি ১০ টাকা দেয়। মোট কুড়িটাকা।
তাহলে শুধু কি ২০ টাকার লোভেই হলুদ ট্যাক্সি গুলো কোম্পানীর কথামত চলছে? উত্তর হলঃ- না। কোম্পানীর সাথে জুড়ে থাকলে ফাঁকা গাড়ি নিয়ে কম ঘুরতে হয়। তেলের পয়সাটা বাঁচে। এবং কিছু নিশ্চিত ভাড়া পাওয়া যায়।
নগরজীবনের নাগরিকদের কাছে ট্যাক্সি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাতবিরেত, অনুষ্ঠান বাড়ি, বেশী ব্যাগপত্র বহনের জন্য, বা দ্রুত পৌছানোর জন্য ট্যাক্সির বিকল্প নেই। কিন্তু ট্যক্সি ড্রাইভাররাও অনেকে মহা বেদো। ইচ্ছা করে যাত্রী তোলে না, মিটারে না গিয়ে অনেক সময়ই বেশি ভাড়া দাবি করে। যার জন্য আমাদের এই সরকার NO REFUSEAL TAXI ও বের করেছিল, তাতেও খুবই একটা সুরাহা হয়নি। পাবলিক যে কলু, সে কলুই রয়ে গেছে। এই এ্যাপস সিস্টেম অনেকের কাছেই চাঁদমারি হসাবে গৃহিত হয়েছে। সময় মত পরিষেবা, ন্যায্য মুল্য (!)।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? ভালোই তো হচ্ছে। নাহ ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। হলুদ ট্যাক্সির ভাড়া সরকার নির্ধারিত। ডিজেলের দাম বাড়লেও ভাড়া তেমন বাড়েনি, বা জ্বালানীর দামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভাড়ার বিন্যাস নেই। উপরুন্তু আছে পুলিশি জুলুম, চাঁদার মহামারী সহ নানান ঝামেলা। বোঝার উপর শাকের আঁটির ড্রাইভার পাওয়ার সমস্যা তো নিত্য। পার্সোনাল গাড়িতে বেতন কিছু কম হলেও খাটনি অনেক কম, আর ভাড়া গাড়ি চালাতেই হলে মুম্বই দিল্লি বা চেন্নাইয়ের মার্কেটে কোলকাতার তুলনায় বেতন অনেক বেশী, প্রায় ডবলের আশেপাশে। তাই নতুন করে হলুদ ট্যাক্সি চালাবার পেশায় উৎসাহ খুবই কম। যারা বাইরে যাতে চাই না কিন্তু ভাড়া গাড়ি চালাতে চান, তাদের তুলে নিচ্ছে কোম্পানীগুলো, অনেক বেশী বেতনের সুবিধা দিয়ে।
একটা সময় বিহার বা উড়িষ্যা বা পাঞ্জাব থেকে এই কাজের জন্য পুরুষেরা দল বেঁধে আসতো। যেটা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। কারন যারা বাইরেই থেকে কাজ করবে তারা এই কম বেতনের কোলকাতায় আসবে কেন? অন্য বড় শহরে অনেক বেশি বেতন। আগে দিনের ট্যক্সিটা, রাতে নিয়ে খেপ খাটার জন্য ২-৪ জন লাইন বেঁধে থাকতো। এখন পার্মানেন্ট ড্রাইভারই নেই , তো খেপ খাটার ড্রাইভার।বরং অন্য পেশায় ঝামেলা কম।
সরকার এক দুর্বোধ্য নীতি আঁকরে ভাড়া বাড়ানোর বিরোধী (আসলে এ এক নির্লজ্জ লেনদেনের ফসল) । এতে নাকি পাবলিকের উপরে চাপ কমছে। আদপে কি তাই? খরচের সাথে পাল্লাদিয়ে আটতে না পেরে , অনেকেই ট্যাক্সি তুলে নিচ্ছেন। এরই ফাঁকে ঢুকে পরছে এ্যাপস কোম্পানি। কারন আমার আপনার দরকার তো আর থেকে থাকবে না। আমাদের ট্যাক্সি দরকারই দরকার। সরকারের যত মাথাব্যাথা এই ব্যাক্তি মালিকানাধিন হলুদ ট্যাক্সির উপরে। অনেক বেকার ছেলে নিজেই একটা ট্যাক্সি কিনে চালিয়ে স্বরোজগারের পথ করে নিয়েছিল। বছর পাঁচেক আগে পর্যন্তও এটাই ছিল আমচিত্র। যাদের না ছিল কোন সার্ভিস ট্যাক্স না সেস।
কিন্তু কোম্পানিগুলি কি ভাড়া নেবে, সেটা একমাত্র তারাই ঠিক করে। সরকারের এখানে কোন নাক গলানোর জাইগা নেই। ইচ্ছামত দাম বাড়ায় বা দাম কমায়, আর সার্ভিস ট্যাক্সের গুঁতো তো আছেই। সরকার এপাড়ায় ভাসুর-বৌমার মতন আচরন করে। সবটাই সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার ফসল।
এখানেই কোম্পানীর কারসাজি। সরকারের সাথে একটা বিশাল অঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে, ভাড়া না বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত। খুব স্বভাবতই বাজার থেকে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় হলুদ ট্যাক্সি লটকে যেতে বাধ্য। তাতেও যারা থেকে যাচ্ছে, তাদের উপর প্রথমে পুলিশি নিপীড়ন, সর্বশেষে দলের ছেলেদের দিয়ে চাঁদার বোঝা। হলুদ ট্যাক্সির অন্তর্জলি যাত্রার এ এক ফুল প্রুফ প্লান। সফল হতে বাধ্য।
অভ্যাস বড় খারাপ জিনিস। একবার হয়ে গেলে ছারা মুশকিল। আর কোম্পানীগুলো ২০ টাকার লোভ দেখিয়ে সাধারণ যাত্রীদের কাছে ওই নির্দিষ্ট হলুদ ট্যক্সির ড্রাইভারকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করিয়ে নিচ্ছে। সেই ড্রাইভার জানে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার থেকে কোম্পানীর ভাড়া বেশী। তাই অগত্যা টিকে থাকার জন্য সেই ড্রাইভার বা মালিকটি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় কোম্পানির সাথে জুড়ে যাচ্ছেন। এটাই ১০ টাকার সাফল্য। বাকি দশ টাকা তো আমি বা আপনি দিচ্ছি। কোম্পানির পুঁজি তো ১০ টাকা। পরে সুদে আসলে ঠিক তুলে নেবে।
কোম্পানীর মালিকদের সাথে সরকারের উচুতলার লোকেদের সাথে উঠাবসা। রাস্তায় কেসকাবারি ঝামেলা হলে, কোম্পানি সামলায়। চাঁদার বিলও কেন্দ্রিয় ভাবে দিয়ে দেওয়া হয়। নেতা মন্ত্রী যখন সেটিং, পুলিস খামোখা কেন কেস দেবে? সতরাং নির্জ্ঝঝাট কর্মজীবন। মালিক বা ড্রাইভারের গাড়িটি ভালানো ও তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ ছারা কোন বিষয়ে মাথাব্যাথা নেই।
কিন্তু এতে করে এই সরকার স্বোরোজগারের বিলাসী যুবকদের ও অতি ক্ষুদ্র উদযোগপতিদের কর্মচারীতে রুপান্তরিত করে দিল সুচতুরতার সাথে। একটাই প্রভু। যার পুঁজি আছে। বাকিরা সবার তার অধীনের দাস।
এই কোম্পানীগুলোতে যুক্ত হবার প্রথম শর্ত ইউনিয়ন না করার মুচলেকা দেওয়া। আর এই হলুদ ট্যাক্সি সংগঠনের অনেক নেতাই কারনে অকারনে, কোম্পানীর থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়ে হরতাল ডেকে দিচ্ছে। যত বেশী হরতাল, তত বেশী এ্যপসের ট্যক্সিতে অভ্যাস। ততই আগামী উজ্জ্বল।
পুরোটাই একটা গট আপ খেলা, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। আজ কোম্পানীগুলো তাদের ইনভেষ্ট করছে। ২-৪ বছরের মধ্যেই নিশ্চিত হলুদ ট্যাক্সি কোলকাতার বুক থেকে বিদায় নেবেই নেবে। তখন এরা দাঁত নখ বেড় করবে। যার ট্রেলার দেখা যাচ্ছে, বেঙ্গালুরু বা দিল্লিতে। মুম্বই ট্যাক্সি সম্বন্ধে আমার তেমন স্বচ্ছ ধারনা নেই। ইচ্ছামত পাবলিকের পকেট কাটবে। আর তখন কোন বিকল্প থাকবে না। অগত্যা সেটাই দিতে হবে।
এই ষড়যন্ত্রে সরকার অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে। আধুনিকিকরনের নামে, কর্মঠ যুবসমাজের একাংশকে চাকর হয়ে যাতে বাধ্য করছে।চুরান্ত ব্যাতিক্রম ছারা ব্যাক্তি কখনই ওই মহাশক্তিধর পুঁজির সাথে পাল্লা দেবার ক্ষমতা রাখেনা। তাই পরিবহন ব্যাবস্থাকে এইভাবে মুনাফাখোর পুজিপতিদের হাতে তুলে দিয়ে আখেরে বাঁশ টা আমাদেরই দিচ্ছে। মাঝখানে কিছু নেতামন্ত্রী হারামের পয়সায় কোটিপতি হয়ে টাকা উড়াচ্ছে।
প্রতিবাদ করার কোন স্কোপ নেই। এ যেন ক্যান্সার রোগী। মানে এই হলুদ ট্যাক্সি। যা কিনা কোলকাতার ঐতিহ্যের সাথে একাত্বভাবে জড়িত। খুব শীঘ্রই জাদুঘরে স্থান পেতে চলেছে।
ডিজিটাল ইন্ডিয়া ঢক্কানিনাদের সমাজের খুবই একটা ক্ষুদ্র আবর্তেই বন্দি। হয় গোটা সমাজকে “ট্যাক-স্যাভি” হয়ে হবে, নতুবা ঘোর দুর্দিন। দেশীয় মীরজাফরদের সহযোগিতায় বিদেশী পুঁজিপতিরা আমাদের দেশীয় রোজকার জীবনকে দখল করে তাঁর উপর প্রভুত্বের সেচ্ছাচার চালাবে। আরো দুর্দিন , যারা শহরতলী থেকে হলুদ ট্যাক্সির ভিতলে সব্জি থেকে লাশ, এক কথায় হিরে থেকে জিরে পরিবহন করে থাকে। কোম্পানীর ট্যাক্সি তা মোটেই করবে না। করলেও যা ভাড়া , তাতে ঢাকের দায়ে মনসা বিকোবে।
সমস্যা, মতির মা দের। তারা এ্যাপস কি জিনিস জানেনা। বস্তিতে কারো শরীর খারাপ করলেই “ ৩০ টা টাকা দিচ্ছি বাবা, এট্টু RG KAR এ নামিয়ে দিয়ে আয় না বাবা” এর দিন শেষ হবে। এই লোকগুলো আরো বেশি অসহায় হয়ে পড়বে।
কারন এরা না জানে এ্যাপসের ব্যাবহার, না আছে অগাধ টাকা। আর এপসছারা ওই বাহারি ট্যাক্সিএ চাকাটুকুও যে গড়াবে না। কারন অন্তর্জালের মাধ্যমে, সংশ্লিষ্ট গাড়ির সমত কিছুই কোম্পানিবাবুদের নখদর্পনে।
সামনেই ভোট, প্রচুর টাকার দরকার। পুঁজিপতিরা স্বয়ং কুবেরকে নিয়ে হাজির। ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করাটাই লক্ষ্য। জনগনকে সেবা আনুসাঙ্গিক কর্মের একটা। তাই আগামীতে অনেককিছুরই বিলুপ্তিকরন ঘটতে পারে, আমার আপনার মত অনেকেকে বলিকাষ্ঠে চড়িয়ে। হলুদ ট্যাক্সি তো যায় অন্যতম।
ভালো হলো! না কি খারাপ , এর উত্তর আগামীর গর্ভে।
তবে হারিয়ে যাবার আগে শেষ একবার হলুদ ট্যাক্সির সফরটুকু করেই নিই নাহয়।
বিঃদ্রঃ- উন্মাদীয় বানানবিধি অনুসৃত।
উন্মাদ হার্মাদ
০৭/১২/২০১৫