কবিগুরুর কতগুলো লাইন ধার করে শুরু করি।
“আমরা সচরাচর কথোপকথনে যতটা অনুভাব প্রকাশ করি তাহারই চূড়ান্ত প্রকাশ করিতে হইলে কথোপকথনের ভাষা হইতে একটা স্বতন্ত্র ভাষার আবশ্যক করে। তাহাই কবিতার ভাষা– পদ্য। অনুভাবের ভাষাই অলঙ্কারময়, তুলনাময় পদ্য। সে আপনাকে প্রকাশ করিবার জন্য আঁকুবাঁকু করিতে থাকে — তাহার যুক্তি নাই, তর্ক নাই, কিছুই নাই। চূড়ান্ত যুক্তির ভাষা গদ্য, চূড়ান্ত অনুভাবের ভাষা পদ্য।
এমন যদি নিয়ম হইত যে, যে কবিতায় চতুর্দ্দশ ছত্রের মধ্যে, বসন্ত, মলয়ানিল, কোকিল, সুধাকর, রজনীগন্ধা, টগর ও দুরন্ত এই কয়েকটি শব্দ বিশেষ শৃঙ্খলা অনুসারে পাঁচ বার করিয়া বসিবে, তাহারই নাম হইবে কবিতা বসন্ত– ও যদি কবিতাপ্রিয় ব্যক্তিগণ কবিদিগকে ফরমাস করিতেন, “ওহে চণ্ডিদাস, একটা কবিতা বসন্ত, ছন্দ ত্রিপদী আওড়াও ত! ” অমনি যদি চণ্ডিদাস আওড়াইতেন—
বসন্ত মলয়ানিল, রজনীগন্ধা কোকিল,
দুরন্ত টগর সুধাকর–
মলয়ানিল বসন্ত, রজনীগন্ধা দুরন্ত,
সুধাকর কোকিল টগর।
ও চারি দিক হইতে “আহা আহা” পড়িয়া যাইত, কারণ কথাগুলি ঠিক নিয়মানুসারে বসানো হইয়াছে — তাহা হইলে কবিতা কতকটা আধুনিক গানের মত হইত। ঐ কয়েকটি কথা ব্যতীত আর-একটি কথা যদি বিদ্যাপতি বসাইতে চেষ্টা করিতেন, তাহা হইলে কবিতাপ্রিয় ব্যক্তিগণ “ধিক্ ধিক্” করিতেন ও তাঁহার কবিতার নাম হইত “কবিতা জংলা বসন্ত।” এরূপ হইলে আমাদের কবিতার কি দ্রুত উন্নতিই হইত! কবিতার ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিণী বাহির হইত, বিদেশবিদ্বেষী জাতীয়ভাবোন্মত্ত আর্য্যপুরুষগণ গর্ব্ব করিয়া বলিতেন, উঃ, আমাদের কবিতায় কতগুলা রাগ রাগিণী আছে, আর অসভ্য ম্লেচ্ছদের কবিতায় রাগ রাগিণীর লেশ মাত্র নাই।
এমন লোকও আছেন যাঁহারা ভাবিয়া পান না যে, ভাবগত কবিতা বস্তুগত কবিতা অপেক্ষা কেন উচ্চ শ্রেণীর ! তাঁহারা বলেন ইহাও ভাল উহাও ভাল। আবার এমন লোকও আছেন যাঁহারা বস্তুগত কবিতা অধিকতর উপভোগ করেন। উক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সুরুচিবান লোকদের আমরা জিজ্ঞাসা করি যে, ইন্দ্রিয়সুখ ভাল না অতীন্দ্রিয় সুখ ভাল? রূপ ভাল না গুণ ভাল? ভাবগত কবিতা আর কিছুই নহে, তাহা অতীন্দ্রিয় কবিতা। তাহা ব্যতীত অন্য সমুদয় কবিতা ইন্দ্রিয়গত কবিতা।
কবিতাটি কবির সন্তানের স্বরুপ। সন্তানের জন্মোপলক্ষে ঘটিত সুখের চেয়ে একটা কবিতার জন্মে কবির কম সুখ অনুভূত হয়না। কচি মুখ, মিষ্ট হাসি, আধো-আধো কথা ইহার বিষয় নহে। একটি ক্ষুদ্রকায়া সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে মিষ্টভাব কচিভাব ব্যতীত আরেকটি ভাব প্রচ্ছন্ন আছে, তাহা সকলের চোখে পড়ে না কিন্তু তাহা ভাবুক কবির চক্ষে পড়ে। সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে একটি অপরিসীম মহান ভাব, অপরিমেয় রহস্য আবদ্ধ আছে, যেমনটি কবিতায় থাকে।
সভ্যতার সমস্ত অঙ্গে যেরূপ পরিবর্তন আরম্ভ হইয়াছে কবিতার অঙ্গেও যে সেইরূপ পরিবর্তন হইবে ইহাই সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয়। কবিতা সভ্যতা-ছাড়া একটা আকাশকুসুম নহে। কবিতা নিতান্তই আশ্মানদার নয়।
এখনকার সভ্য সমাজে দশটাকে মনে মনে তেরিজ কষিয়া একটাতে পরিণত কর। কবিতাও সে নিয়মের বহির্ভূত নহে। সভ্য দেশের কবিতা এখন যদি তুমি আলোচনা করিতে চাও তবে একটা কাব্য, একটি কবির দিকে চাহিও না। যদি চাও ত বলিবে “এ কি হইল! এ ত যথেষ্ট হইল না! এ দেশে কি তবে এই কবিতা?
পূর্বে একজন পণ্ডিত না জানিতেন এমন বিষয় ছিল না। লোকেরা যে বিষয়েই প্রশ্ন উত্থাপন করিত, তাঁহাকে সেই বিষয়েই উত্তর দিতে হইত, নহিলে আর তিনি পণ্ডিত কিসের? এক অ্যারিষ্টটল দর্শনও লিখিয়াছেন, রাজ্নীতিও লিখিয়াছেন, আবার ডাক্তারিও লিখিয়াছেন। তখনকার সমস্ত বিদ্যাগুলি হ-য-ব-র-ল হইয়া একত্রে ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া থাকিত। বিদ্যাগুলি একান্নবর্ত্তী পরিবারে বাস করিত, এক-একটা করিয়া পণ্ডিত তাহাদের কর্ত্তা। পরস্পরের মধ্যে চরিত্রের সহস্র প্রভেদ থাক, এক অন্ন খাইয়া তাহারা সকলে পুষ্ট। এখন অবশ্য সর্বজ্ঞ পন্ডিত না থাকিলেও সর্বজ্ঞ কবির অন্ত নাই, তাহাতে কাব্য থাকুক আর নাই বা থাকুক, কাগজের উপরে কলম চালাইতে পারিলেই নিজেকে কবিবর ভাবিয়া লইতে অসুবিধা কি”।
———————————–
শুরুর ভুমিকাটাই অনেক বড় হইয়া গেল, আসলে কবিগুরুর লাইন তো , সুতরাং অল্পেতে কি ভাবে হইবে!
শেষ লাইন দিয়েই শুরুকরি। আজিকাল সকলেই কবি, তাহাতে কাব্যরস থাকুক বা না থাকুক। গুরুদেব ইন্টারনেটের কথা কল্পনাও করিয়া যাইতে পারেন নাই, যদি কোনক্রমে তাহার নিকট বর্তমান কোন ফেসবুক গ্রুপের একটা দিনের পাতা খুলিয়া দেখানো সম্ভব হইত, নিশ্চিত তিনি সিলিং ফ্যানে গলায় গামছা বাধিবার পূর্বে অবশ্যই সুলালিত দাড়িটি “কবিতার” অন্ত্যেষ্টির জন্য কামাইয়া ফেলিতেন নিশ্চিত।
বাঙালী ও কবিতা নাকি সমার্থক, আমি নিজেও তার বাহিরে নই। স্কুল কলেজে যতবার প্রেমে পড়িয়াছি ততবারই অন্তরের কবিত্ব জাগিয়া উঠিয়াছিল সন্দেহ নাই। অতঃপর প্রতিটি প্রেমকাহিনি সমাপ্তের সাথে সাথেই কবিতা বমনও আশ্চর্যজনক ভাবে স্তব্ধ হইয়া যাইত। আধুনা দুই এক বৎসর কাল এই পীড়া আপাতকালীন ভাবে দূরীভুত হইয়াছে।
কিন্তু যেহেতু ইহা আমার মতে একটি পীড়া, সেই হেতু বহু মানবসন্তানই পোলিওর ন্যায় এই প্রকারের ছোঁয়াচে পীড়ার শিকার। বিশেষত যাহারা অন্তর্জালের পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করিয়া থাকেন। তাহা অভ্যন্তরে আমার অত্যন্ত নিকট বন্ধুবাসরের সখার সংখ্যাও নেহাত কম নহে। এই বিষয় চয়ন করার অর্থ শত্রু সংখ্যা না বাড়লেও, বন্ধু যে কমিবে তাহার জন্য রকেট বিজ্ঞানি না হইলেও চলিবে। সুতরাং গালি খাইবার নিমিত্ত, যে আন্তরিক ভাবে প্রস্তুত থাকিতেই হইবে, ইহাও বলাই বাহুল্য।
কবিতা কি? কবিতা হইল মনের ভাবধারার অন্তিম মন্থিত নির্যাস। যাহা আনন্দে ফল্গুধারার মত নির্ঝরিনির মত প্রবাহিত হইয়া অন্যকেও সেই সুখামৃত পান করাইয়া তৃপ্ত লভিয়া থাকে, অথবা তীব্র বিষাদসিন্ধু গরলের মত বক্ষে চাপিয়া যাবতীয় দুঃখবোধকে কাব্যিক সরলতায় প্রকাশ করে , কিছুটা উপশমের চেষ্টা ।
কবিতা কে লেখেন? কবিতা তিনিই লিখিয়া থাকেন যাহার মনের অভ্যন্তরের ভাবনাকে কাব্যের আকারে প্রকাশ করিবার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। আর যিনি এই কর্মটি সুচারুরুপে সম্পন্ন করিতে পারেন, তাহাকেই সেই কাব্যের জনকস্বরুপ কবি নামে অভিহিত করিতে পারি। কবিগুরু বলিয়াছেন, কবিতা আসলে কবির সন্তান স্বরুপ। কিন্তু আধুনিক এই কবির মেলাতে কজন সুস্থ সন্তানের জন্মদান করিয়াছেন বলিয়া দাবি করিতে পারেন? দু একটি ব্যাতিরেকে প্রায় সকলই পঙ্গু ও নিরেট। যাহার না আছে ধড় না পুচ্ছ।
পৃথিবীর অধুনা সঙ্কট বিশ্বউষ্ণায়ন প্রথম হইলে দ্বিতীয়টা অবশ্যই তৃতীয় বিশ্বের জনবিষ্ফোরন। আর সাহিত্যের সঙ্কট হইল এই দ্রুত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশিত প্রচারিত অপুষ্ট কঙ্কালসার ও বিষাক্ত শব্দগুচ্ছের তুমুল বিষ্ফোরনকে “কবিতা” নাম দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার কুৎসিত প্রচেষ্টা, আসলে আমাদের সাহিত্যকলার ঐতিহ্য আর ইতিহাসের পাশাপাশি যুবসমাজকেও সম্পূর্ন ভ্রান্তপথে বাধিত করিতেছে।
জীবনানন্দের অমোঘ বানী- “ সকলেই কবি নয়, কেও কেও কবি” এই সার সত্যকে উপেক্ষা করেই ঘটে চলেছে, কাব্যকে গন বলাৎকার। সীমাবদ্ধ জীবনের ব্যাকুলতা কে ভাষা যোগানোর পরিবর্তে, এই সাহিত্যহন্তা শব্দব্রম্ভের স্রোত সমাজকে আলো দেখানোর পরিবর্তে মরিচিকার প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন করিয়া দিচ্ছে। ব্যক্তির নিজস্ব সময়বোধ যখন তার একান্ত ব্যক্তিগত হইতে পারেনা, সেখানে কবিতা তো পাঠককুলের পরিশীলিত মনন বোধকে জাগ্রত করার অনুঘটক রুপে কার্য করিয়া থাকে, কবিতার দায় রহিয়াছে শিল্পোবোধএর ঐতিহ্যকে রক্ষা করার। সুতরাং কবি সেই দায় হইতে মুক্ত নন।
এক্ষণে যদি বোদ্ধাদের প্রশ্নে আসা হই, তাহা হলে সকলের জন্য সকল কবিতা হয়, ইহা সত্য। আধুনিক কবিগনকে সসম্মানে উহ্য করিয়াও, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে বা নির্মলেন্দুর সকল কবিতা কি সর্বসাধারনের বোধগম্য? নিশ্চই তাহা নহে। সকল কবিতা কি কালজয়ীই হইবে! না মোটেই তাহা নয়। কারন কবির ভাবনা আর পাঠকের সেই মুহুর্তের মনস্তত্বের টানাপোড়েনের উপরে অনেকটা নির্ভর করিয়া থাকে, বাকিটা ব্যক্তিগত রুচি। যদিও কিছু কিছু লাইন এতোটাই যুগান্তর যে, সেটা কালজয়ী হতে সময় নেয় না।
পাঠকের সমাদর ব্যতিত কাব্যে প্রানের সঞ্চার হয়না। কিন্তু কবি কি পাঠকের কথা ভাবিয়া রচনা করেন? মোটেই না, সুতরাং কাব্যের অন্তর্নিহিত ভাবনা, শব্দচয়ন ও সমকালের প্রভাব কাব্যকে পাঠক মনের কাছাকাছি এনে দেয়। বাস্তব ঘটনামালার ভিন্নতাকে কাব্যিক ভাবে জারিত করে , কবির নিজস্ব চেতনার রঙে রাঙিয়ে যদি পাঠকের সম্মুখে পরিবেশন করা সম্ভবপর হয় তাহা হইলে সেই কবিতার মৃত্যু নেই। শুধু মাত্র লেখার জন্য কবিতা হয় না বা কবিতার জন্ম দশটা পাঁচটা চাকুরির মত নহে, যে খাতা আর কালি নিয়ে বসিলেই কবিতার জন্ম হইবে। কাব্যিক সাধনা প্রয়োজন। প্রখর বাস্তববোধ প্রয়োজন। সাথে নিষ্ঠা আর অধ্যাবসায়।
কবিতার কোন নির্দিষ্ট সূত্র নেই, নেই কোন চমক সৃষ্টির তাৎক্ষনিক দুর্দান্ত পন্থা। সর্বপ্রথম প্রয়োজন কাব্যপাঠের নেশা, যাহা বিনা কবিতার জন্ম দেওয়া অসম্ভব। লেখনির সময় পাঠককে উপেক্ষা করা নিতান্ত প্রয়োজন, কিন্তু অবজ্ঞা নহে। কারন কবিতায় বহু মানুষ আশ্রয় গ্রহন করিয়া থাকেন, কিন্তু কবিতা কেবলমাত্র তাহার বরপুত্রদের উপরেই ভর করিয়া থাকে, অবশ্যই তাহারা ক্ষণজন্মা। লৌকিক জগতের যাবতীয় উপলব্ধির সহিত কল্পনার মাধুরীর সংমিশ্রণ ঘটানো সকলের কর্ম নহে। যিনি নিজেকে কবি বলিয়া প্রকাশের ইচ্ছা করেন, তাহার অনুভূতি জগতের সকল প্রতীকি চেতনা, তাহার সৃষ্টির প্রতিটি ছত্রে উপস্থিত থাকিতেই হবে, তবেই না কবি।
আজিকালের আধুনিক কবিদের মধ্যে, বিশেষত এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যাদের মূলত প্রকাশ, তারা ঠিক উদ্দেশ্যে কবিতা লেখেন , অধিকাংশ জনেই তার ব্যাখ্যা দিতে অপারগ। কাজ নাই, চলো কবিতা লিখি এই গোছের। কেবলমাত্র, বন্ধু বৃত্তে আরো অনেকেই যেহেতু এই চর্চা করিয়া থাকেন, সেই হেতু “আমি” না লিখিলে কেমনে প্রশংশা পাইব? এই ভাবনা থেকেই বেশিরভাগ জনেই কবিতার নামে মল-মুত্র ত্যাগ করিয়া থাকেন। আর প্রশংসা শুনিবার জন্য যত জনকে সম্ভবপর ততজনকে সাথে বেঁধে নেন। জোর করে কি কবিতা শোনানো সম্ভব? সেই সুকুমারি ছড়ার একুশে আইন ন্যায় একটু পরিবর্তন ঘটাইয়া, সেথায় যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে, তাদের ধরে ট্যাগের বলে, কানের কাছে নানার স্বরে, কবিতা শোনায় লক্ষ ড্যাস।
কবিতা তো কবির আবেগ। তাহা জোর করিয়া একপ্রকার ঘাড় ধাক্কা দিইয়া শোনাইবার অপচেষ্টা আজিকাল শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হইয়াছে। একটা সত্য ওনারা বুঝতে চাহেননা, যে তার কবিতা যদি সত্যিই উৎকর্ষতার মান অতিক্রম করিতে পারেন, পাঠককূলই তাহাকে সমাদরে মাথায় তুলিয়া রাখিবেন, ও তাহার পুনঃপুনঃ প্রচার করিতে থাকিবেন। একটা বিষয় মনে রাখিতে হইবে, সাফল্যের কোন হ্রস্বতর পথ হইতে পারেনা। সমালোচোনা সহিবার অসীম শক্তির সহিত নিরলস প্রয়াসের দীর্ঘ যুগলবন্দিই সফলতার বৃত্তের প্রবেশপথ দেখাইতে সক্ষম।
কাব্য চর্চার সহিত প্রতিষ্ঠার আত্মীয়তা অত্যন্ত দুর্মূল্য। কারন সফলতার যে পথে প্রতিষ্ঠার মঞ্চ প্রস্তুত হয়, তাহা অত্যন্ত বন্ধুর। সাহিত্য জ্ঞান আমার মতে সর্বাধিক পাঠককুলের কাছেই সঞ্চিত। বাকি যারা সাহিত্যচর্চাটা দু কলম লেখালখির মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ করিয়া থাকেন তাহারা কেহই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নন, কারণ সাহিত্য সৃষ্টির নির্দিষ্ট পাঠ নেই, কবিত্ব আরো মারাত্বক, ইহা প্রায় সম্পূর্নটাই আত্মগত ও স্বাভাবিক পরিস্ফুটন। কবিগুণ একপ্রকারের স্বভাবগুণ, কোন গুরু ধরিয়া কবি হওয়া অসম্ভব।
সমকালীন খ্যাতিমান কবিগনের কবিতাতেও, যাহাকে আমরা আধুনিক কবিতা বলিয়া জানি, সেই সকল কবিতার অভ্যন্তরে একটা গল্প থেকে থাকে, যদিও অধিকাংশ কবিতাতেই ছন্দের প্রভাব মুক্ত। কিন্তু সেগুলি বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনার সোনালী ফসল। কিন্তু সেই সকলকে অনুকরণ করিয়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্বঘোষিত কবির দল, কবিতার নামে যে দলবদ্ধ বিশৃঙ্খল অত্যাচারে বিদ্ধ পাঠককূলকে খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া কাব্যগরল পানে বাধ্য করিয়া থাকেন, তাহা হইতে নিষ্কৃতি কোথায়? আরে বাবা কবিতা অনুভব করিতে হয়, আত্মস্থ করিতে হয় উপলব্ধি করিতে হয়।
শুধু মাত্র “ বাহ, অপূর্ব, অনবদ্য, দারুন, সুন্দর, অবিশ্বাস্য ইত্যাদি” রোজ ব্যবহৃত ভোঁতা ভাষাগুলি শোনার অভিপ্রায়ে? আর কিছু হউক বা না হউক, এই কবিদের পাল্লায় পড়িয়া এই কতিপয় শব্দবন্ধগুলি তাহার কার্যকারিতা হারাইয়াছে নিঃসন্দেহে। কারণ আসলে কোনটা অপূর্ব? কোনটা অনবদ্য? কোনটা অবিশ্বাস্য? বনলতা সেন? নাকি দেবতার অভিষাপ? না কি ওই “রেচন পদার্থ “ গুলো। যাহারা প্রতিষ্ঠিত বা মহান তাহাদের কথা ছাড়িয়া দিন , বাকি যাহারা অধ্যবসায়ের সহিত প্রতিদিনিই চেষ্টা করিতেছেন, তাদেরও যে গুটি কয়েক সুন্দর সৃষ্টি, সেগুলিই বা কি ভাবে ই গনপ্রশংসার ভীড়ে আলাদা করিবেন হে কবিবর? একবার পরখ করে দেখুন আপনার সৃষ্টপদটি কি আদৌ খাদ্য তো? অখাদ্য বা সুখাদ্যের বিচার নাহয় পাঠক করিবেন পড়িবার পর। অন্যের কথা ছাড়িয়া দিন, নিজের তৈরি কান্ডকারখানায় কি মুড়ি মিছরি একই দড় হইয়া যায়নি আপনি নিজেও?
কবিতার শরীরে কাব্যালঙ্কার থাকতেই হবে, ইহাই কবিতার প্রাথমিক শর্ত। কবিতা পাঠের সময় পাঠকের মনে যদি কোন চিত্রকল্প না জাগ্রত হয়, কোন গল্প, বা চরিত্র, বো জীবনবোধ বা দর্শন খুঁজিয়া না পায়, তাহলে সেটা কি কবিতা? না কি কবিতার নামে আসলে কবিতার শ্রাদ্ধবাসর। কবিতার প্রথম শ্রোতা বা পাঠক তো আসলে যিনি লিখিতেছেন তিনিই। তিনি কি বলিতে পারিবেন যে তিনি ঠিক কি পরিমান কাব্যালঙ্কার- রুপক-অনুপ্রাশ-ছন্দ বা দর্শন জীবনবোধের দ্বন্দ্ব মশালা স্বরুপ মিশাইয়াছেন!! না, তিনি পারিবেন না, তিনি শুধু ট্যাগ নামক অস্ত্রের অপব্যবহার করিয়া, ঘাড় ধরিয়া আপনাকে পড়িতে বাধ্য করাইতে পারেন মাত্র। একটা নমুনা পরিবেশন করিলাম,
কবিতাটি নিম্নরূপ
ওগো আমার প্রেমিকা
কাল চুমেছিনু তব ললাটে
আজ তুমি নেই সাথে
তাই পাদিতেছি খাটে।।
মানে ছন্দ মিলাইবার জন্য যা ইচ্ছে তাই কিছু একটা দিলেই হইল। অথবা নিন্মরূপ
গোরোস্থানে আসার আগে
টাটা করেছিলাম সকলকে,
সকলেও আমায় টিটকিরি করেছিল
তারপর বহুদিন আর খোঁজ নেয়নি কেউ
একা অন্ধকারে আছি রোজ বিড়ি খাই
ডিগবাজি ও খাই,
শুধু ভাত খাইনা, কারন আমার সুগার
তবে গালি খাই, কারন পাওনাদারদের ধার শোধ করতে পারিনি।
আমি মাতালদের সর্দার ছিলাম
তাদের বউয়েরা আমার গুষ্ঠিদ্ধার করে আজও।
এই নির্জন গোরোস্থানে বসে আমি রোজ সকলকে করি টাটা।
ইহাও নাকি একটি আধুনিক কবিতা। ভাবিতে কষ্ট হয়, কেহ লেখে তিনি হাগেন, কেহ লেখেন তিনি গালিখান আর ডিগবাজি। ইহাদের কি কারাগারে অবরুদ্ধ করিবার প্রয়োজন নয় অবিলম্বে ,সুস্থ স্বাভাবিক মস্তিষ্কে যাহারা এগুলোকে জাহির করিয়া জনসমক্ষে প্রকাশ করিতে পারেন, তাদের মানসিক সুস্থতা লইয়া প্রশ্ন রহিল।
কুমোর যেমন কাঠের কাঠামোর উপরে কাদামাটি লেপনের মাধ্যমে একটু একটু করিয়া মূর্তির মধ্যে সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকেন, তেমনই কবিকেও তার চেতনার রঙে রাঙানো পাঁপড়ি দিয়া একটি একটি করিয়া কবিতার শব্দমালা গাঁথিতে হয়, তবেই না সেই কবিতা হয় কাব্যিক সৌন্দর্যের প্রেমময় মুর্তি। সামান্যতম বিচ্যুতিও যেখানে কবিতার অপঘাত মৃত্যু ঘটায় বলেই শিল্পরসিকদের অভিমত, সেখানে এমন কাব্যচর্চা একধরনে সামাজিক গর্হিত অপরাধ, যাহা অন্তত কবিতারই স্বার্থে আইন প্রনয়নের মাধ্যমে বন্ধ করা উচিৎ।প্রয়োজন গন প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ।
এর পর আসিবে কবির কাব্যচর্চার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা এক নহে। গোলাপ চাষ, বা ধানের চাষ আর গাঁজার চাষের সামাজিক মূল্য কি এক? সুতরাং যত্রতত্র খোলা স্থানে মলমুত্র ত্যাগ করিবেন না যেমন সত্য, তেমনই খোলা মঞ্চে যত্রতত্র কবিতার নামে রেচন ত্যাগিবেন না। অনেকেই ভাবিয়া নেন যে, তিনি ঢেকুর তুলিলেই একটি কবিতার জন্ম হয়, তাহাদের অনুরোধ, সেই সকল বদহজমের ফসলকে নিজস্ব সংগ্রহের রাখিয়া দিন দয়া করিয়া, সামাজিক ভদ্রতার খাতিরে প্রকাশ্যে আপনার এই ঢেঁকুরের বদনাম না করিলেও নিজস্ববৃত্তে আপনাকে লইয়া খোরাক পরিবেশন করিয়া থাকে আপনারই নিকট বন্ধুস্বজন।। কারন আপনার নিজস্ব রচনা (রেচন হইলেও) আপনার নিকটে অবশ্যই ভাল, কারন স্বিয় ত্যাগকৃত গন্ধবায়ুতে দুর্গন্ধের পরিমাপ নিরুপন করা সকল সময় সম্ভবপর হয়না নিজের দ্বারা। সামাজিক মাধ্যমেও বিভিন্ন মঞ্চ রহিয়াছে , যাহা উঠতি প্রতিভাদের জন্যই সংরক্ষিত। জল মাপিতে হইলে ওই স্থানই সর্বত্তোম।
সময়ের তাড়নাতেই সময়োপযোগী কবিতার জন্ম হইয়াছে, এখনও হইতেছে, আগামীতেও হইবে। বাস্তবের প্রেক্ষিত হোক বা কল্পনার পটভূমিতে অঙ্কিত, প্রগতিশীলতা বা আধুনিকতার নামে যেন শৈল্পিক নান্দনিকতা না হারাইয়া যায়। সৎ চেষ্টা সফল হইতে বাধ্য, ইতিহাস সাক্ষী। পাঠকের চৈতন্যের প্রতি অবশ্যই সৃষ্টির দায় বর্তাইয়া থাকে। ফাঁপা শব্দবন্ধের মেকি গড্ডালিকাপ্রবাহে ভাষিয়া না যাইয়া সমালোচোনার জন্য আহ্বানও জরুরী।
মেদ যেমন সুন্দরী নারীর আবেদনকে কুশ্রী করিয়া দেয়, তেমনি কবিতারও অতিরিক্ত শব্দ কবিতাকে গুরুত্বহীন করিয়া তোলে, সমালোচোনার অনুশীলনই পারে আগামীর কবিতাকে মেদবর্জিত ঝরঝরে আকর্ষনীয় রুপ দিতে।
কবিতা কবি বিনে জন্মলাভে অক্ষম। আর সেই পতাকা থাক যোগ্যের হাতে, আর নিজেকে যোগ্য বানাতে প্রয়োজন কাব্যবোধ, সাথে প্রচুর অনুশীলন, আর প্রতিষ্ঠা লিপ্সা। কবিতা হউক সাবলীল আর প্রাঞ্জল। মোটের উপর কবিতা মানুষ ও মানবতার কথা বলুক। তাহার জন্য কবি শিক্ষিত হউক বা না হউক, কাব্যজ্ঞানরহিত যেন না হন। কবিতা মাথা উঁচু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংস্কারের সামাজিক চিন্তায় চিন্তিত হয়ে, অন্ধকার দূর করার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, সমাজ বদলের অঙ্গীকারে উৎসাহ জোগাবে মানুষের হৃদয়কে। নিয়ে যাক রুপকথার অন্তরে, শোনায় সুখ দুখঃখের গীতমালা।
শুধু শব্দের খেলা নয়, সমকালীন কবিতায় থাক শব্দের সঙ্গে শব্দের মেলবন্ধন বা গাঁথুনি, প্রয়োজনে ছন্দও স্থান পাক অন্ত্যে। বাক্যবিন্যাসে থাকুক মজবুত ভিত, যা সমাজ ও কালকে স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখবে, এই বিশ্বাসটা আগে নিজের মধ্যে জন্মাক। আর সেটা সম্ভব হইলে তবেই কবিতার শরীরে ধরা পড়িবে ভালোবাসা ও মমতার প্রলেপ।