Thursday, 25 August 2016

অকবির জন্মকথা.

লেখাঃ মতিউল ইসলাম
—————–
জন্মেছিস যখন একটা দাগ রেখে যা,

এই উক্তি আমার এমন অনুপ্রেরণা দিল যে ছোট থেকেই ভাবনার শেষ রইলো না,কি ভাবে দাগ রাখা যায় বিষম চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়ালো শেষে অনেক ভেবে ভেবে শেষে চক দিয়ে গোটা বাড়ি আঁক কেটে দিলাম, মা এই সব দেখে ভালোই উত্তম মধ্যম দিলেন, শেষে বললেন কেন এই ভাবে বাড়ি নোংরা করেছিস বল,ফোঁপাতে ফোঁপাতে মা কে দাগ রেখে যাবার কথা বললাম, মা তো হেসে বাঁচেনা, বাবা কে গিয়ে বললেন, বাবা বললেন ব্যাটা দাগ এভাবে নয় কাজের মাধ্যমে রাখতে হয়.
ভীষণ চিন্তায় পড়লাম কি করা যায়? 

মনে মনে নেতাজী গান্ধীজি কে খুব রাগ দেখালাম কেন ওরা ইংরেজ দের দেশছাড়া করলো?আর কিছুদিন থাকলে কেমন বিপ্লবী হয়ে দাগ রাখতাম,

বহু চেষ্টা করলাম দাগ রাখার দাগ আর পড়ে না,অভিনেতা হতে গেলাম কাঁদতে বললে হাসি আর হাসতে বললে কাঁদি,
ঘাড় ধরে বের করে দিল,গান শিখতে চেয়ে প্রথম দিনেই এমন চিৎকার দিলাম গুরুজীর কানে তালা ধরে গেল,খবর পেয়েছি আজো সেই তালা খোলেনি,খেলাধূলা ও শরীরে সহ্য হলো না.
তারপর হঠাৎ একদিন পরশ পাথর পেয়ে যাবার মতো পেয়ে গেলাম দাগ রাখার অমোঘ অস্ত্র,
সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছি কাছের বান্ধবী কে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছি একদিন দুম করে ওর খাতায় লিখে দিলাম



তোর কালো চুল
আমার চুলবুল.



ও তো মহা খুশি আমি ও কবতের প্রেমে পড়লাম.
পরদিন আবার লিখলাম



তোর ওই বুক
আমার ধুকপুক.
রেগে গিয়ে আমার ত্যাগ করলো, 

নারী গেল কবিতা এলো জীবনে. লিখলাম


তুমি গেলে চলে
কবিতার কোলে ফেলে.
পেয়ে গেলাম দাগ রেখে যাবার ব্রম্ভাস্ত্র.



তার পর শুধু কবিতা আর কবিতা আর কবিতা,ভরে গেল সমস্ত পুরানো ডাইরির পাতা,বন্ধু রা ত্যাগ করলো কাতুকুতু বুড়োর মতো দেখা হলেই কবিতা শুনাতাম যে.



বড়ো বিপদে পড়লাম লিখছি গোঁয়ারের মতো কিন্তু কেউ শুনছে না,মন ভারাক্রান্ত, হঠাৎ আমার দুঃখে জুকারবার্গ বানিয়ে দিলেন ফেবু,আর আমার পায় কে পাতলা পায়খানার মতো কবিতার স্রোত ভাসিয়ে দিলাম বন্ধুদের টাইমলাইনে,পড়বি না নে ট্যাগ ট্যাগ আর ট্যাগ,



সুন্দর, ভালো,অসাধারণ লিখে লিখে অনেকে ক্লান্ত হয়ে আনফ্রেন্ড করলো আমি ও দ্বিগুণ উৎসাহে আরো বন্ধু জোগাড় করে ট্যাগাতে লাগলাম,আমার হাতে পড়ে মৃত্যু হলো কতো ছন্দ অলংকার আর রুপকের,কিছু দিন আগে খবর পেলাম আমার বিরুদ্ধে কবিতা আর ট্যাগে অস্তির হয়ে অনেক গ্রুপ খোলা হয়েছে, আন্দোলন চলছে জেলায় জেলায় শ্লোগান উঠছে ট্যাগানো কবিতা পড়ছি না পড়বো না।

আমি লিখেছি তোরা যে যাই বলিস ভাই,



আমার কবিতা ট্যাগা চাই.
মনে বড়ো সন্তোষ হচ্ছে দাগ পড়ছে হোক না লাল দাগ,দাগ তো.শেষে একটি নতুন কবতে বলি,
যতোই বন্ধ রাখো ট্যাগানো অপশন,
থামবে না আমার কলম,
জোৎস্নার চাঁদ নয়কো রুটি
যেন কবতের খাতা,
লিখবো আমি, কবতে নাই বা হলো?
হোক অকবিতা,
ফেসবুকের বন্ধু দের কাছে
এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার,
দাগ রেখেই যাব আমি.

Wednesday, 24 August 2016

আমি ও অকপট



শুরুটা সেদিন একটু অন্যভাবে। গত বছর এই সময়ের কিছুমাস আগে যাবৎ একটা ব্যক্তিগত সমস্যায় সম্পূর্ন জর্জরিত ছিলাম, অন্য একটা বিশা…ল গ্রুপের সেবা করার কিছু সুযোগও পেয়েছিলাম, সেখানে বেশ কয়েকজনের আমিত্বের ভীড়ে হাঁসফাঁস করা অবস্থায় কিছু লিবারাল দশকর্মা ভান্ডার টাইপের গ্রুপেই সাধারনত নিয়মিত থাকতাম। সেখানেও অতিরিক্ত ধর্মীয় কচকচানি আর একটা কাঁচা খিস্তির কর্মশালাতে চরম হতাশ হয়ে বন্ধু সন্দীপের দ্বারস্থ হই। চলোনা আমরাও একটা গ্রুপ খুলি। পুঁজি ছিল শুধু উন্মাদীয় ভাবনার রসদ।
আমরা জানতাম আমরা বাঁদর, বেদে নই। নাচতে পারি নাচাতে নয়। গ্রুপ চালাতে যে নীতি (অল্প হলেও লাগে বৈকি) ধৈর্য অধ্যাবসায় ও ফেসবুকীয় জ্ঞান থাকা প্রয়োজন তার কিছুই আমাদের নেই। তবে অনেক সফল গ্রুপেরই, বন্ধু সৌমেনদার ভাষায় “অ্যাডমিন প্যালাদার” চাকুরি করেছি। বেশ কিছু জনপ্রিয় পেজের অন্যতম দায়িত্বেও থাকার অভিজ্ঞতা ছিল। আর প্রথমে অর্কুট পরে দীর্ঘ আট বছর এই ফেসবুকের সাথে সাথে সোস্যাল মিডিয়া পরিক্রমা।
সুতরাং শুরুটা এভাবেই। প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিল যুক্তি-তক্কো। বন্ধু সন্দীপের পরামর্শেই আমি অকপট নামটা নির্দিষ্ট করি। প্রথমে গোটা দশেক মেম্বার, তার মধ্যে ৮ জনই এডমিন। প্রসেনজিৎ গুহ, প্রশান্ত ঘোষ, রজত মালিক, সন্দীপ দাস, শেহনাজ আলম, সুদীপ্তা নাথ, সুধা মজুমদার, তন্ময় হক আর আমি। সঙ্গে ছিল অন্যতম মেম্বার রুমি হক ম্যাম আর শিল্পী গুহ দিদির শুভকামনা। এই পথ চলার শুরু। এর পরে প্রসেনজিৎ দা , প্রশান্ত আর রজত দিন ৩-৪ এর মধ্যেই ব্যক্তিগত কারনে অ্যাডমিন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন। প্রথম বাইরের মেম্বার মৃদুল কান্তি ঘোষ। প্রথম পোষ্ট আমার, আজকের বিচারে সেটি অবশ্যই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত।
এর পর যেমনটি হয়, সকলে মিলে নিজ নিজ বন্ধুদের অ্যাড করার পালা। এক সপ্তায় সংখ্যাটা দাঁড়ায় দেড়শোর কাছাকাছি। কেউই প্রায় আসতেন না তখন। জয়দা আমার পরের পর করে চলা পোষ্টে দুয়েকটা লাইক কমেন্ট করেন মাত্র। আর বাকি অ্যাডমিনদের গুটিকয়েক সাবধানি পোষ্ট। এর পর নিজেরাও কেমন উৎসাহ হারিয়ে ফেলার দশায় উপস্থিত হই। তবুও আমরা হাল ছাড়িনি, ধিকিধিকি করে হলেও জ্বলছিলাম। ঠিক কদিন পর জানিনা, দেবেশ সিংহ নামের এক অতি উৎসাহী সদস্য গ্রুপে প্রায় সর্বক্ষণের জন্যই উপস্থিত থাকতে শুরু করল। সে নিজেও তার কয়েকজন বন্ধুদের গ্রুপে অ্যাড করে, এভাবেই একটু একটু করে চলতে চলতে, তনিমা, দেবাশীষ দা আমাদের সাথে যুক্ত হন। এরপর গ্রুপের শ্রীবৃদ্ধি ঘটান অ্যাডমিনে এসে, দেবেশ নিজে, হৈমন্তী, আরো বেশ কয়েকজন। যাদের ছাড়া আজকের যেটুকুই “অকপট” বর্তমান, তার অন্যতম কৃতিত্বের দাবিদার এনারা সকলেই।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবেই আমরা সন্দীপ আর সুদীপ্তা কে আমাদের অকপট এর কার্যনির্বাহ বৃত্ত থেকে হারিয়ে ফেলি। সে দুঃখ আজও যাবার নয়। আজ অকপট একবছরের গ্রুপ হিসাবে তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য কিছু করেছে বলে দাবি করতে পারিনা। তবে আমাদের ভবিষ্যত লক্ষ্য এই অকপটকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রুপ প্রদান করা। যেখানে থাকবে আর্ত পীড়িতদের জন্য নিঃশুল্ক সেবার ব্যবস্থা, থাকবে দুঃস্থ মেধাবীদের জন্য শিক্ষা সরঞ্জাম, অনাথ, পথশিশু আর বৃদ্ধাশ্রমের জন্য সাহায্যমূলক সামাজিক ভাবনা। আমাদের পরিচয় হবে নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা, যাদের মূল উদ্দেশ্য নতুন ও উঠতি সাহিত্য প্রতিভাদের জন্য প্রাথমিক মঞ্চ প্রদান, ইত্যাদি। আর এই সকল কিছুর জন্য প্রয়োজন একটি দলগঠনের। আর অকপট সেই লক্ষ্যের পথে একটি পদক্ষেপ মাত্র।
আমি শুরুটা করি আরো সমসাময়িক পাঁচ জনের আগেই, কিন্তু আমার ধারাবাহিককরণে বেশ সমস্যা। এটা আমার একটা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য । ঠিক সেই রকম ভাবেই আমার বন্ধুরা যখন নেট বা ফেসবুকের নামই শোনেননি তার আগেই এই দুনিয়ায় আমার হাতেখড়ি হয়ে গেছে। তারপর সেই খারা-বরি-থোর । বছর দু-তিন প্রায় গায়েব। মাঝ মাঝে আসতাম বটে কিন্তু কোন এক এক্টিভিটিই ছিলনা। ২০০৯ থেকে একটু একটু করে নিয়মিত ফেসবুকে আসা শুরু করেছি। তবে এখনকার মত মোটেই নয়, এখন তো জৈবিক প্রয়োজন ব্যতিত ফেসবুকেই থাকি।
তখন গ্রুপ কি জিনিস তেমন জানিই না। তবে বিভিন্ন পেজের বিজ্ঞাপন টাইমলাইনেই আসত। তবে এখনকার মত এত সমৃদ্ধ টাইমলাইন কারোরই ছিলনা বোধহয়। এর পর একটু একটু করে একটা একটা করে ফেবু বিজ্ঞাপিত গ্রুপে নিজেকে সেঁধিয়ে দিই আর ভাল লাগলে টিকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিতাড়িত, কারন এই অন্তর্জালে সকলেই প্রশংশা শুনতেই পছন্দ করেন। অন্যথায় তোমার পিছলে লাথ। আমি পুরুষ, মহাপুরুষ নই, তাই আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা শত শতাংশই সঠিক ও প্রযোজ্য। আমার মতে এই গ্রুপ বাজির রমরমাটা ২০১২ সালের শেষের দিক থেকেই হবে বোধহয়।
মোটামুটি তো সবই বলে দিলাম সংক্ষেপে । আমার লেখার রোগ অতি পুরাতন, ক্লাস সেভেন কিম্বা এইট থেকেই কালিতে আরশোলা মাখিয়ে সাদা রুলটানা ডায়েরির খাতায় ছাড়ার অভ্যেস ছিল। ল্যাপটপ এসে তাতে নতুন মাত্রা জুড়ল। ভুল সংশোধনের সুযোগ ও রক্ষা করার হরেক পন্থা। আর এই ফেসবুক একটা বিচিত্র জগত খুলে দিল সামনে। তখন জানতাম না এই সীমা কোথায়, আর আজ তো পুরোটাই ঘেঁটে গেছে। শুধু জানি আমিই সত্য, বাকিরা সংখ্যা। অবশ্য নদীর অপর প্রান্তেও এই ধারনারই ভীড়। তবে মুখের থেকে এই পাড়ায় যেহেতু মুখোশ বেশি, তাই নিজেকে মানিয়ে নিতে অসুবিধা মোটেই হয়নি।
এরপর ডাস্টবিনের পচা ছানার মত একটা আধটা ছেঁড়া পোষ্ট করতে লাগলাম। এক দুজন বন্ধুরা কষ্ট করে পড়তেও লাগলেন। বুভুক্ষুর রাজ্যে এই কি কম পাওনা! আমিও আশাবাদী হয়ে উঠলাম । এর পরেই শুরু হল নিয়মিত লেখালেখি। আমি কবিতা তেমন লিখতে পারিনা, বা যেগুলো দু একটা লিখেছি সেগুলোকে আর যাই হোক কবিতা বলা চলেনা। কোন সন্দেহ নেই , সেই জন্যেই গদ্য আকারের ছোট কলেবরে বিষয় ভিত্তিক লেখা লিখে গুটিকয়েক অনেক পাঠকের নজরে পড়তে শুরু করি। তবে আমি মনোযোগী পাঠক মাত্র, আর ওই ভাল ভাল লেখা পড়েই নিজের লেখার সাধ। তখন শেয়ার ব্যাপারটা ভাল বুঝতাম না। অন্যের ভাল লেখা পেলেই নিজের টাইমলাইনে দিয়ে দিতাম, পরে একজনের অপমান খেয়ে তার নাম কৃতজ্ঞতায় দিয়ে শুরু করি।আজও যার ব্যতিক্রম হয়না। তারও অনেক পরে বাংলা হরফ এভেলেভেল হলে বাংলায় লেখা চালু করি।
তখনও আমার কাছে গ্রুপ কনসেপ্টটা পরিষ্কার নয়, কয়েকজন বন্ধু নিয়মিত আমার ওই ছেঁড়া কাথার মত লেখা নিয়মিত পোষ্ট করতেন, মূলত তাঁরাই লেখার উৎসাহটা যোগাতেন। প্রথমে ভাবতাম এই লাইকই বোধহয় কতজন পাঠক পড়লেন তার একমাত্র মাপকাঠি, আর কমেন্ট সমালোচনার। অনেক পরে বুঝেছি, এগুলো কোনোটাই নয়। লাইক জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হতে পারে, কিন্তু আমার ভাবনাগুলো লিখিত আকারে প্রকাশের পর সেগুলো মানুষ পড়েন কি পড়েন না সেটা বুঝলাম একটা সিক্রেট গ্রুপে এড হবার পর। সেখানে লেখা থাকে যে কত জন পোষ্টটি পড়েছেন। আমরা বা আমাদের মত পাবলিক প্রথমত ফেসবুক করেন মূলত সময় কাটানোর মাধ্যম হিসাবে। কিন্তু এই সময়ে আমদের বর্হিঃবিশ্বের সাথে যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বোধহয় এই ফেসবুক।
একটাসময় ছিল যখন কেবলমাত্র মজা করার উদ্দেশ্যে অনলাইনে আসতাম, এখন তো সময় খুঁজি কখন একবার গ্রুপে বা টাইমলাইনে ঢুঁ মারব। হাজার একঘেঁয়ে জোকস উতপটাং কবিতার ভীড়েও কিছু মানুষের লেখা নিয়ম করে পড়ি। অনেক লেখার সাথে নিজেকে মেলাতে পারি। বেশ কয়েকজন বন্ধু আমার লেখাও পড়েন হয়ত কষ্ট করেই, তাদের মতামতও জানান, বেশ লাগে ব্যাপারটা। সকলেই মানবেন গঠন মূলক সমালোচনা ভীষণ মূল্যবান বস্তু। তবে সকলের কথাতেই খুব গুরুত্ব দিইনা কেননা এ জগতে সকলেই নিজেকে জ্ঞানদা ভাণ্ডারের কর্তা ভাবেন নিজেকে। নিজের যোগ্যোতা না মেপে, শ্রীজাতর কবিতাতে সমালোচনা করেন, বা তসলিমার বিরোধিতা করেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হুজুগে মাতালের দলের বাড়বাড়ন্তকে টপকে নিশ্চুপ একজন পাঠকের দাম আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান।
ফেসবুকে আমার সবচেয়ে পছন্দের হচ্ছে ইনস্ট্যান্ট ইমোজিগুলো । কি সুন্দর একটা ছোট্ট ইমোজি দিয়ে অনেক কিছু বা সমগ্র পরিস্থিতিটাকে বর্ণনা করা যায়। একঘেয়ে জীবনে যাঁতাকলে, এই ফেসবুকে নিজের পুরাতন আপলোড করা পোষ্টগুলো দেখে বা বন্ধুদের রঙিন মুহুর্তের ছবিগুলো দেখে মন ভাল না হয়ে উপায় নেই। এটা রোজজীবনের একটা চটজলদি রিফ্রেশমেন্ট। ফেসবুকের মত এতো বৈচিত্রের পাশাপাশি সহাবস্থান খুব কমই বাস্তব সমাজে প্রতিফলিত হয়। অসভ্যের মত উত্তেজনা ও তার পরিণতি হিসাবে কাঁচা খিস্তির ফোয়ারাকে ড্রিবল করে এগিয়ে যেতে পারলে তার থেকে মজা আর কিচ্ছুটিতে নেই বলেই আমার ধারণা।

অনেকেই আজ কত নতুন নতুন জিনিষ শুরু করছেন। খুবই ভাল বিষয় সেটা, তবে এটা আমি মাথায় রাখি যার কাছ থেকে শিখেছি, তিনি যেন গুরুর মর্যাদাটুকু পান, তাতে ভার্চুয়ালই হোক বা বাস্তবে। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে, যিনি শুরু করেছেন, এগিয়ে নিয়ে যাবার গুরুদায়িত্বও তারই কাঁধে থাকে। অনেকেই এটা বোঝেননা, যার জন্য তাকে ফেলে রেখেই বাকিরা এগিয়ে যায়।
আজ যখন ফিরে দেখি একটা বছর, তখন পাওনার চেয়ে হতাশা বেশি। প্রাপ্তির ঝুলি অনেক, কিন্তু আমরা ব্যর্থ আমাদের অনেক পুরাতন বন্ধুদের এই অকপটের বৃত্তে ধরে রাখতে। তাদের ভুলের থেকেও আমি নিজেকে আরো আরো বেশি বেশি করে দোষী করতে চাই। যাতে এমন ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমরা একটা বিষয় ভুলে যাই, যে আর পাঁচজনকে শোধরানোর চেয়ে নিজেকে বদলে ফেলা অনেক সহজ। আর আমার মতটাই সেরা ও অন্তিম নয়। এই জায়গা থেকে আমাদের আরো সহনশীল হতে হবে। বিরুদ্ধমতের ক্ষেত্রেও আমাদের উদ্ধত্বতা প্রকাশ পেয়েছে বারেবারে। তবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে আগামীর ভবিষ্যৎ যে নিদারুণ কষ্টের হবে সেটা বলাই বাহুল্য। আসলে আমরা তো চরিত্রগত ভাবেই ত্যাগ করতে শিখিনি। সকলের আগে ইগো , অহমিকা আর আমিত্ব কে যতটা সম্ভব হত্যা করতে হবে। তাহলেই হয়ত অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।
এই ভার্চুয়াল গ্রুপগুলোর অধিকাংশেরই বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। আমরা সেই ছক থেকে আগামীতে বেরিয়ে এসে সমাজের জন্য কিছু করার প্রয়াস করতে পারব বলেই বিশ্বাস রাখি। আমরা বিশ্বাস করি যে গাছ দ্রুত বেড়ে উঠে , তার কাঠ দিয়ে জ্বালানি ছাড়া আর কিছুই ভাল করা সম্ভব নয়। এবং হালকা ঝড়েই তার অস্তিত্ব টালমাটাল করে। বট বৃক্ষ হতে পারি বা না পারি চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?

অন্তত একটা ছাতিম বা কদম হতে পারলেই আমরা সার্থক বলে ধরে নেব। আর তার জন্য প্রয়োজন সময়। কারন দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক কখনই সময়ের আঁচে অগ্নিপরীক্ষা না দিয়ে কুলিন হতে পারেনা। যেহেতু আমাদের লক্ষ্য স্থির, তার কোন তারাহুড়ো নেই আমাদের। শত শত হাজার হাজার সদস্যদের ভিতর থেকে আগামী তিনবছরে উদ্যমী রুচিশীল ধর্মীয় কূটকাচালির উর্ধ্বে থাকা কিছু হৃদয়বান মানুষের খোঁজ অবশ্যই পাবো, এই বিশ্বাস আছে। দরকার তো ১৯ টি জেলার জন্য কমপক্ষে ৩৮ জনের। যিনি লাভের আশা না করেই কিছু সৎ সামাজিক কর্মের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পছন্দ করবেন। অনেকেই ইতিমধ্যেই কাজ নিঃশব্দে করে চলেছেন, তাদের খোঁজ করে আমাদের দলে আনার চেষ্টা চালাবো আমরা, কারণ আমরা শিখতে চাই তাদের থেকে।
তাই অকপটকে শুধু মাত্র এক একটা সময় কাটানোর ঠেক হিসাবে আমরা ভাবিনা। এখানেই আমাদের সাথে সুব্রত দা, সোমনাথ দা, প্রবাল দা, মতিভাই, দেবাশিষ দা, সহ গোপালদা, আশরাফুল, সুব্রত সহ অনেকে মানুষই আছেন, যাদের নিয়ে হয়ত আজ থেকে শুরু করলেই কোন সেবামূলক কাজ শুরু করাই যায়, কিছু দিতে পারুক বা না পারুক, উৎসাহ আর খানিকটা সময় দেবেন বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু আমরা আরো দেখে শুনে আরেকটু দলে ভারি হয়ে , নূন্যতম তৈরি হয়েই বাস্তবের মাটিতে নামতে চাই। কারন নাচতে নেমে ঘোমটা টেনে হাসির খোরাক হওয়ার থেকে দু-টো দিন অপেক্ষা ভাল।

অকপটের সকল বর্তমান ও প্রাক্তন সদস্যদের জানাই গ্রুপের ও আমার পক্ষ থেকে অকপট ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।
অকপট এগিয়ে চলুক নিজের গতিতে।
উন্মাদ হার্মাদ
চব্বিশে আগষ্ট,২০১৬

Tuesday, 23 August 2016

কবিতার আধুনিকতা; ও বর্তমান পরিস্থিতি

কবিতার আধুনিকতা; ও বর্তমান পরিস্থিতি

লেখাঃ তন্ময় হক

কবিগুরুর কতগুলো লাইন ধার করে শুরু করি।
“আমরা সচরাচর কথোপকথনে যতটা অনুভাব প্রকাশ করি তাহারই চূড়ান্ত প্রকাশ করিতে হইলে কথোপকথনের ভাষা হইতে একটা স্বতন্ত্র ভাষার আবশ্যক করে। তাহাই কবিতার ভাষা– পদ্য। অনুভাবের ভাষাই অলঙ্কারময়, তুলনাময় পদ্য। সে আপনাকে প্রকাশ করিবার জন্য আঁকুবাঁকু করিতে থাকে — তাহার যুক্তি নাই, তর্ক নাই, কিছুই নাই। চূড়ান্ত যুক্তির ভাষা গদ্য, চূড়ান্ত অনুভাবের ভাষা পদ্য।
এমন যদি নিয়ম হইত যে, যে কবিতায় চতুর্দ্দশ ছত্রের মধ্যে, বসন্ত, মলয়ানিল, কোকিল, সুধাকর, রজনীগন্ধা, টগর ও দুরন্ত এই কয়েকটি শব্দ বিশেষ শৃঙ্খলা অনুসারে পাঁচ বার করিয়া বসিবে, তাহারই নাম হইবে কবিতা বসন্ত– ও যদি কবিতাপ্রিয় ব্যক্তিগণ কবিদিগকে ফরমাস করিতেন, “ওহে চণ্ডিদাস, একটা কবিতা বসন্ত, ছন্দ ত্রিপদী আওড়াও ত! ” অমনি যদি চণ্ডিদাস আওড়াইতেন—

বসন্ত মলয়ানিল, রজনীগন্ধা কোকিল,
দুরন্ত টগর সুধাকর–
মলয়ানিল বসন্ত, রজনীগন্ধা দুরন্ত,
সুধাকর কোকিল টগর।
ও চারি দিক হইতে “আহা আহা” পড়িয়া যাইত, কারণ কথাগুলি ঠিক নিয়মানুসারে বসানো হইয়াছে — তাহা হইলে কবিতা কতকটা আধুনিক গানের মত হইত। ঐ কয়েকটি কথা ব্যতীত আর-একটি কথা যদি বিদ্যাপতি বসাইতে চেষ্টা করিতেন, তাহা হইলে কবিতাপ্রিয় ব্যক্তিগণ “ধিক্ ধিক্” করিতেন ও তাঁহার কবিতার নাম হইত “কবিতা জংলা বসন্ত।” এরূপ হইলে আমাদের কবিতার কি দ্রুত উন্নতিই হইত! কবিতার ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিণী বাহির হইত, বিদেশবিদ্বেষী জাতীয়ভাবোন্মত্ত আর্য্যপুরুষগণ গর্ব্ব করিয়া বলিতেন, উঃ, আমাদের কবিতায় কতগুলা রাগ রাগিণী আছে, আর অসভ্য ম্লেচ্ছদের কবিতায় রাগ রাগিণীর লেশ মাত্র নাই।

এমন লোকও আছেন যাঁহারা ভাবিয়া পান না যে, ভাবগত কবিতা বস্তুগত কবিতা অপেক্ষা কেন উচ্চ শ্রেণীর ! তাঁহারা বলেন ইহাও ভাল উহাও ভাল। আবার এমন লোকও আছেন যাঁহারা বস্তুগত কবিতা অধিকতর উপভোগ করেন। উক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সুরুচিবান লোকদের আমরা জিজ্ঞাসা করি যে, ইন্দ্রিয়সুখ ভাল না অতীন্দ্রিয় সুখ ভাল? রূপ ভাল না গুণ ভাল? ভাবগত কবিতা আর কিছুই নহে, তাহা অতীন্দ্রিয় কবিতা। তাহা ব্যতীত অন্য সমুদয় কবিতা ইন্দ্রিয়গত কবিতা।
কবিতাটি কবির সন্তানের স্বরুপ। সন্তানের জন্মোপলক্ষে ঘটিত সুখের চেয়ে একটা কবিতার জন্মে কবির কম সুখ অনুভূত হয়না। কচি মুখ, মিষ্ট হাসি, আধো-আধো কথা ইহার বিষয় নহে। একটি ক্ষুদ্রকায়া সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে মিষ্টভাব কচিভাব ব্যতীত আরেকটি ভাব প্রচ্ছন্ন আছে, তাহা সকলের চোখে পড়ে না কিন্তু তাহা ভাবুক কবির চক্ষে পড়ে। সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে একটি অপরিসীম মহান ভাব, অপরিমেয় রহস্য আবদ্ধ আছে, যেমনটি কবিতায় থাকে।
সভ্যতার সমস্ত অঙ্গে যেরূপ পরিবর্তন আরম্ভ হইয়াছে কবিতার অঙ্গেও যে সেইরূপ পরিবর্তন হইবে ইহাই সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয়। কবিতা সভ্যতা-ছাড়া একটা আকাশকুসুম নহে। কবিতা নিতান্তই আশ্মানদার নয়।
এখনকার সভ্য সমাজে দশটাকে মনে মনে তেরিজ কষিয়া একটাতে পরিণত কর। কবিতাও সে নিয়মের বহির্ভূত নহে। সভ্য দেশের কবিতা এখন যদি তুমি আলোচনা করিতে চাও তবে একটা কাব্য, একটি কবির দিকে চাহিও না। যদি চাও ত বলিবে “এ কি হইল! এ ত যথেষ্ট হইল না! এ দেশে কি তবে এই কবিতা?

পূর্বে একজন পণ্ডিত না জানিতেন এমন বিষয় ছিল না। লোকেরা যে বিষয়েই প্রশ্ন উত্থাপন করিত, তাঁহাকে সেই বিষয়েই উত্তর দিতে হইত, নহিলে আর তিনি পণ্ডিত কিসের? এক অ্যারিষ্টটল দর্শনও লিখিয়াছেন, রাজ্নীতিও লিখিয়াছেন, আবার ডাক্তারিও লিখিয়াছেন। তখনকার সমস্ত বিদ্যাগুলি হ-য-ব-র-ল হইয়া একত্রে ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া থাকিত। বিদ্যাগুলি একান্নবর্ত্তী পরিবারে বাস করিত, এক-একটা করিয়া পণ্ডিত তাহাদের কর্ত্তা। পরস্পরের মধ্যে চরিত্রের সহস্র প্রভেদ থাক, এক অন্ন খাইয়া তাহারা সকলে পুষ্ট। এখন অবশ্য সর্বজ্ঞ পন্ডিত না থাকিলেও সর্বজ্ঞ কবির অন্ত নাই, তাহাতে কাব্য থাকুক আর নাই বা থাকুক, কাগজের উপরে কলম চালাইতে পারিলেই নিজেকে কবিবর ভাবিয়া লইতে অসুবিধা কি”।
———————————–
শুরুর ভুমিকাটাই অনেক বড় হইয়া গেল, আসলে কবিগুরুর লাইন তো , সুতরাং অল্পেতে কি ভাবে হইবে!
শেষ লাইন দিয়েই শুরুকরি। আজিকাল সকলেই কবি, তাহাতে কাব্যরস থাকুক বা না থাকুক। গুরুদেব ইন্টারনেটের কথা কল্পনাও করিয়া যাইতে পারেন নাই, যদি কোনক্রমে তাহার নিকট বর্তমান কোন ফেসবুক গ্রুপের একটা দিনের পাতা খুলিয়া দেখানো সম্ভব হইত, নিশ্চিত তিনি সিলিং ফ্যানে গলায় গামছা বাধিবার পূর্বে অবশ্যই সুলালিত দাড়িটি “কবিতার” অন্ত্যেষ্টির জন্য কামাইয়া ফেলিতেন নিশ্চিত।
বাঙালী ও কবিতা নাকি সমার্থক, আমি নিজেও তার বাহিরে নই। স্কুল কলেজে যতবার প্রেমে পড়িয়াছি ততবারই অন্তরের কবিত্ব জাগিয়া উঠিয়াছিল সন্দেহ নাই। অতঃপর প্রতিটি প্রেমকাহিনি সমাপ্তের সাথে সাথেই কবিতা বমনও আশ্চর্যজনক ভাবে স্তব্ধ হইয়া যাইত। আধুনা দুই এক বৎসর কাল এই পীড়া আপাতকালীন ভাবে দূরীভুত হইয়াছে।
কিন্তু যেহেতু ইহা আমার মতে একটি পীড়া, সেই হেতু বহু মানবসন্তানই পোলিওর ন্যায় এই প্রকারের ছোঁয়াচে পীড়ার শিকার। বিশেষত যাহারা অন্তর্জালের পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করিয়া থাকেন। তাহা অভ্যন্তরে আমার অত্যন্ত নিকট বন্ধুবাসরের সখার সংখ্যাও নেহাত কম নহে। এই বিষয় চয়ন করার অর্থ শত্রু সংখ্যা না বাড়লেও, বন্ধু যে কমিবে তাহার জন্য রকেট বিজ্ঞানি না হইলেও চলিবে। সুতরাং গালি খাইবার নিমিত্ত, যে আন্তরিক ভাবে প্রস্তুত থাকিতেই হইবে, ইহাও বলাই বাহুল্য।
কবিতা কি? কবিতা হইল মনের ভাবধারার অন্তিম মন্থিত নির্যাস। যাহা আনন্দে ফল্গুধারার মত নির্ঝরিনির মত প্রবাহিত হইয়া অন্যকেও সেই সুখামৃত পান করাইয়া তৃপ্ত লভিয়া থাকে, অথবা তীব্র বিষাদসিন্ধু গরলের মত বক্ষে চাপিয়া যাবতীয় দুঃখবোধকে কাব্যিক সরলতায় প্রকাশ করে , কিছুটা উপশমের চেষ্টা ।
কবিতা কে লেখেন? কবিতা তিনিই লিখিয়া থাকেন যাহার মনের অভ্যন্তরের ভাবনাকে কাব্যের আকারে প্রকাশ করিবার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। আর যিনি এই কর্মটি সুচারুরুপে সম্পন্ন করিতে পারেন, তাহাকেই সেই কাব্যের জনকস্বরুপ কবি নামে অভিহিত করিতে পারি। কবিগুরু বলিয়াছেন, কবিতা আসলে কবির সন্তান স্বরুপ। কিন্তু আধুনিক এই কবির মেলাতে কজন সুস্থ সন্তানের জন্মদান করিয়াছেন বলিয়া দাবি করিতে পারেন? দু একটি ব্যাতিরেকে প্রায় সকলই পঙ্গু ও নিরেট। যাহার না আছে ধড় না পুচ্ছ।
পৃথিবীর অধুনা সঙ্কট বিশ্বউষ্ণায়ন প্রথম হইলে দ্বিতীয়টা অবশ্যই তৃতীয় বিশ্বের জনবিষ্ফোরন। আর সাহিত্যের সঙ্কট হইল এই দ্রুত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশিত প্রচারিত অপুষ্ট কঙ্কালসার ও বিষাক্ত শব্দগুচ্ছের তুমুল বিষ্ফোরনকে “কবিতা” নাম দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার কুৎসিত প্রচেষ্টা, আসলে আমাদের সাহিত্যকলার ঐতিহ্য আর ইতিহাসের পাশাপাশি যুবসমাজকেও সম্পূর্ন ভ্রান্তপথে বাধিত করিতেছে।
জীবনানন্দের অমোঘ বানী- “ সকলেই কবি নয়, কেও কেও কবি” এই সার সত্যকে উপেক্ষা করেই ঘটে চলেছে, কাব্যকে গন বলাৎকার। সীমাবদ্ধ জীবনের ব্যাকুলতা কে ভাষা যোগানোর পরিবর্তে, এই সাহিত্যহন্তা শব্দব্রম্ভের স্রোত সমাজকে আলো দেখানোর পরিবর্তে মরিচিকার প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন করিয়া দিচ্ছে। ব্যক্তির নিজস্ব সময়বোধ যখন তার একান্ত ব্যক্তিগত হইতে পারেনা, সেখানে কবিতা তো পাঠককুলের পরিশীলিত মনন বোধকে জাগ্রত করার অনুঘটক রুপে কার্য করিয়া থাকে, কবিতার দায় রহিয়াছে শিল্পোবোধএর ঐতিহ্যকে রক্ষা করার। সুতরাং কবি সেই দায় হইতে মুক্ত নন।
এক্ষণে যদি বোদ্ধাদের প্রশ্নে আসা হই, তাহা হলে সকলের জন্য সকল কবিতা হয়, ইহা সত্য। আধুনিক কবিগনকে সসম্মানে উহ্য করিয়াও, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে বা নির্মলেন্দুর সকল কবিতা কি সর্বসাধারনের বোধগম্য? নিশ্চই তাহা নহে। সকল কবিতা কি কালজয়ীই হইবে! না মোটেই তাহা নয়। কারন কবির ভাবনা আর পাঠকের সেই মুহুর্তের মনস্তত্বের টানাপোড়েনের উপরে অনেকটা নির্ভর করিয়া থাকে, বাকিটা ব্যক্তিগত রুচি। যদিও কিছু কিছু লাইন এতোটাই যুগান্তর যে, সেটা কালজয়ী হতে সময় নেয় না।
পাঠকের সমাদর ব্যতিত কাব্যে প্রানের সঞ্চার হয়না। কিন্তু কবি কি পাঠকের কথা ভাবিয়া রচনা করেন? মোটেই না, সুতরাং কাব্যের অন্তর্নিহিত ভাবনা, শব্দচয়ন ও সমকালের প্রভাব কাব্যকে পাঠক মনের কাছাকাছি এনে দেয়। বাস্তব ঘটনামালার ভিন্নতাকে কাব্যিক ভাবে জারিত করে , কবির নিজস্ব চেতনার রঙে রাঙিয়ে যদি পাঠকের সম্মুখে পরিবেশন করা সম্ভবপর হয় তাহা হইলে সেই কবিতার মৃত্যু নেই। শুধু মাত্র লেখার জন্য কবিতা হয় না বা কবিতার জন্ম দশটা পাঁচটা চাকুরির মত নহে, যে খাতা আর কালি নিয়ে বসিলেই কবিতার জন্ম হইবে। কাব্যিক সাধনা প্রয়োজন। প্রখর বাস্তববোধ প্রয়োজন। সাথে নিষ্ঠা আর অধ্যাবসায়।
কবিতার কোন নির্দিষ্ট সূত্র নেই, নেই কোন চমক সৃষ্টির তাৎক্ষনিক দুর্দান্ত পন্থা। সর্বপ্রথম প্রয়োজন কাব্যপাঠের নেশা, যাহা বিনা কবিতার জন্ম দেওয়া অসম্ভব। লেখনির সময় পাঠককে উপেক্ষা করা নিতান্ত প্রয়োজন, কিন্তু অবজ্ঞা নহে। কারন কবিতায় বহু মানুষ আশ্রয় গ্রহন করিয়া থাকেন, কিন্তু কবিতা কেবলমাত্র তাহার বরপুত্রদের উপরেই ভর করিয়া থাকে, অবশ্যই তাহারা ক্ষণজন্মা। লৌকিক জগতের যাবতীয় উপলব্ধির সহিত কল্পনার মাধুরীর সংমিশ্রণ ঘটানো সকলের কর্ম নহে। যিনি নিজেকে কবি বলিয়া প্রকাশের ইচ্ছা করেন, তাহার অনুভূতি জগতের সকল প্রতীকি চেতনা, তাহার সৃষ্টির প্রতিটি ছত্রে উপস্থিত থাকিতেই হবে, তবেই না কবি।

আজিকালের আধুনিক কবিদের মধ্যে, বিশেষত এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যাদের মূলত প্রকাশ, তারা ঠিক উদ্দেশ্যে কবিতা লেখেন , অধিকাংশ জনেই তার ব্যাখ্যা দিতে অপারগ। কাজ নাই, চলো কবিতা লিখি এই গোছের। কেবলমাত্র, বন্ধু বৃত্তে আরো অনেকেই যেহেতু এই চর্চা করিয়া থাকেন, সেই হেতু “আমি” না লিখিলে কেমনে প্রশংশা পাইব? এই ভাবনা থেকেই বেশিরভাগ জনেই কবিতার নামে মল-মুত্র ত্যাগ করিয়া থাকেন। আর প্রশংসা শুনিবার জন্য যত জনকে সম্ভবপর ততজনকে সাথে বেঁধে নেন। জোর করে কি কবিতা শোনানো সম্ভব? সেই সুকুমারি ছড়ার একুশে আইন ন্যায় একটু পরিবর্তন ঘটাইয়া, সেথায় যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে, তাদের ধরে ট্যাগের বলে, কানের কাছে নানার স্বরে, কবিতা শোনায় লক্ষ ড্যাস।
কবিতা তো কবির আবেগ। তাহা জোর করিয়া একপ্রকার ঘাড় ধাক্কা দিইয়া শোনাইবার অপচেষ্টা আজিকাল শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হইয়াছে। একটা সত্য ওনারা বুঝতে চাহেননা, যে তার কবিতা যদি সত্যিই উৎকর্ষতার মান অতিক্রম করিতে পারেন, পাঠককূলই তাহাকে সমাদরে মাথায় তুলিয়া রাখিবেন, ও তাহার পুনঃপুনঃ প্রচার করিতে থাকিবেন। একটা বিষয় মনে রাখিতে হইবে, সাফল্যের কোন হ্রস্বতর পথ হইতে পারেনা। সমালোচোনা সহিবার অসীম শক্তির সহিত নিরলস প্রয়াসের দীর্ঘ যুগলবন্দিই সফলতার বৃত্তের প্রবেশপথ দেখাইতে সক্ষম।
কাব্য চর্চার সহিত প্রতিষ্ঠার আত্মীয়তা অত্যন্ত দুর্মূল্য। কারন সফলতার যে পথে প্রতিষ্ঠার মঞ্চ প্রস্তুত হয়, তাহা অত্যন্ত বন্ধুর। সাহিত্য জ্ঞান আমার মতে সর্বাধিক পাঠককুলের কাছেই সঞ্চিত। বাকি যারা সাহিত্যচর্চাটা দু কলম লেখালখির মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ করিয়া থাকেন তাহারা কেহই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নন, কারণ সাহিত্য সৃষ্টির নির্দিষ্ট পাঠ নেই, কবিত্ব আরো মারাত্বক, ইহা প্রায় সম্পূর্নটাই আত্মগত ও স্বাভাবিক পরিস্ফুটন। কবিগুণ একপ্রকারের স্বভাবগুণ, কোন গুরু ধরিয়া কবি হওয়া অসম্ভব।
সমকালীন খ্যাতিমান কবিগনের কবিতাতেও, যাহাকে আমরা আধুনিক কবিতা বলিয়া জানি, সেই সকল কবিতার অভ্যন্তরে একটা গল্প থেকে থাকে, যদিও অধিকাংশ কবিতাতেই ছন্দের প্রভাব মুক্ত। কিন্তু সেগুলি বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনার সোনালী ফসল। কিন্তু সেই সকলকে অনুকরণ করিয়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্বঘোষিত কবির দল, কবিতার নামে যে দলবদ্ধ বিশৃঙ্খল অত্যাচারে বিদ্ধ পাঠককূলকে খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া কাব্যগরল পানে বাধ্য করিয়া থাকেন, তাহা হইতে নিষ্কৃতি কোথায়? আরে বাবা কবিতা অনুভব করিতে হয়, আত্মস্থ করিতে হয় উপলব্ধি করিতে হয়।
শুধু মাত্র “ বাহ, অপূর্ব, অনবদ্য, দারুন, সুন্দর, অবিশ্বাস্য ইত্যাদি” রোজ ব্যবহৃত ভোঁতা ভাষাগুলি শোনার অভিপ্রায়ে? আর কিছু হউক বা না হউক, এই কবিদের পাল্লায় পড়িয়া এই কতিপয় শব্দবন্ধগুলি তাহার কার্যকারিতা হারাইয়াছে নিঃসন্দেহে। কারণ আসলে কোনটা অপূর্ব? কোনটা অনবদ্য? কোনটা অবিশ্বাস্য? বনলতা সেন? নাকি দেবতার অভিষাপ? না কি ওই “রেচন পদার্থ “ গুলো। যাহারা প্রতিষ্ঠিত বা মহান তাহাদের কথা ছাড়িয়া দিন , বাকি যাহারা অধ্যবসায়ের সহিত প্রতিদিনিই চেষ্টা করিতেছেন, তাদেরও যে গুটি কয়েক সুন্দর সৃষ্টি, সেগুলিই বা কি ভাবে ই গনপ্রশংসার ভীড়ে আলাদা করিবেন হে কবিবর? একবার পরখ করে দেখুন আপনার সৃষ্টপদটি কি আদৌ খাদ্য তো? অখাদ্য বা সুখাদ্যের বিচার নাহয় পাঠক করিবেন পড়িবার পর। অন্যের কথা ছাড়িয়া দিন, নিজের তৈরি কান্ডকারখানায় কি মুড়ি মিছরি একই দড় হইয়া যায়নি আপনি নিজেও?
কবিতার শরীরে কাব্যালঙ্কার থাকতেই হবে, ইহাই কবিতার প্রাথমিক শর্ত। কবিতা পাঠের সময় পাঠকের মনে যদি কোন চিত্রকল্প না জাগ্রত হয়, কোন গল্প, বা চরিত্র, বো জীবনবোধ বা দর্শন খুঁজিয়া না পায়, তাহলে সেটা কি কবিতা? না কি কবিতার নামে আসলে কবিতার শ্রাদ্ধবাসর। কবিতার প্রথম শ্রোতা বা পাঠক তো আসলে যিনি লিখিতেছেন তিনিই। তিনি কি বলিতে পারিবেন যে তিনি ঠিক কি পরিমান কাব্যালঙ্কার- রুপক-অনুপ্রাশ-ছন্দ বা দর্শন জীবনবোধের দ্বন্দ্ব মশালা স্বরুপ মিশাইয়াছেন!! না, তিনি পারিবেন না, তিনি শুধু ট্যাগ নামক অস্ত্রের অপব্যবহার করিয়া, ঘাড় ধরিয়া আপনাকে পড়িতে বাধ্য করাইতে পারেন মাত্র। একটা নমুনা পরিবেশন করিলাম,

কবিতাটি নিম্নরূপ
ওগো আমার প্রেমিকা
কাল চুমেছিনু তব ললাটে
আজ তুমি নেই সাথে
তাই পাদিতেছি খাটে।।
মানে ছন্দ মিলাইবার জন্য যা ইচ্ছে তাই কিছু একটা দিলেই হইল। অথবা নিন্মরূপ

গোরোস্থানে আসার আগে
টাটা করেছিলাম সকলকে,
সকলেও আমায় টিটকিরি করেছিল
তারপর বহুদিন আর খোঁজ নেয়নি কেউ
একা অন্ধকারে আছি রোজ বিড়ি খাই
ডিগবাজি ও খাই,
শুধু ভাত খাইনা, কারন আমার সুগার
তবে গালি খাই, কারন পাওনাদারদের ধার শোধ করতে পারিনি।
আমি মাতালদের সর্দার ছিলাম
তাদের বউয়েরা আমার গুষ্ঠিদ্ধার করে আজও।
এই নির্জন গোরোস্থানে বসে আমি রোজ সকলকে করি টাটা।
ইহাও নাকি একটি আধুনিক কবিতা। ভাবিতে কষ্ট হয়, কেহ লেখে তিনি হাগেন, কেহ লেখেন তিনি গালিখান আর ডিগবাজি। ইহাদের কি কারাগারে অবরুদ্ধ করিবার প্রয়োজন নয় অবিলম্বে ,সুস্থ স্বাভাবিক মস্তিষ্কে যাহারা এগুলোকে জাহির করিয়া জনসমক্ষে প্রকাশ করিতে পারেন, তাদের মানসিক সুস্থতা লইয়া প্রশ্ন রহিল।
কুমোর যেমন কাঠের কাঠামোর উপরে কাদামাটি লেপনের মাধ্যমে একটু একটু করিয়া মূর্তির মধ্যে সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকেন, তেমনই কবিকেও তার চেতনার রঙে রাঙানো পাঁপড়ি দিয়া একটি একটি করিয়া কবিতার শব্দমালা গাঁথিতে হয়, তবেই না সেই কবিতা হয় কাব্যিক সৌন্দর্যের প্রেমময় মুর্তি। সামান্যতম বিচ্যুতিও যেখানে কবিতার অপঘাত মৃত্যু ঘটায় বলেই শিল্পরসিকদের অভিমত, সেখানে এমন কাব্যচর্চা একধরনে সামাজিক গর্হিত অপরাধ, যাহা অন্তত কবিতারই স্বার্থে আইন প্রনয়নের মাধ্যমে বন্ধ করা উচিৎ।প্রয়োজন গন প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ।
এর পর আসিবে কবির কাব্যচর্চার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা এক নহে। গোলাপ চাষ, বা ধানের চাষ আর গাঁজার চাষের সামাজিক মূল্য কি এক? সুতরাং যত্রতত্র খোলা স্থানে মলমুত্র ত্যাগ করিবেন না যেমন সত্য, তেমনই খোলা মঞ্চে যত্রতত্র কবিতার নামে রেচন ত্যাগিবেন না। অনেকেই ভাবিয়া নেন যে, তিনি ঢেকুর তুলিলেই একটি কবিতার জন্ম হয়, তাহাদের অনুরোধ, সেই সকল বদহজমের ফসলকে নিজস্ব সংগ্রহের রাখিয়া দিন দয়া করিয়া, সামাজিক ভদ্রতার খাতিরে প্রকাশ্যে আপনার এই ঢেঁকুরের বদনাম না করিলেও নিজস্ববৃত্তে আপনাকে লইয়া খোরাক পরিবেশন করিয়া থাকে আপনারই নিকট বন্ধুস্বজন।। কারন আপনার নিজস্ব রচনা (রেচন হইলেও) আপনার নিকটে অবশ্যই ভাল, কারন স্বিয় ত্যাগকৃত গন্ধবায়ুতে দুর্গন্ধের পরিমাপ নিরুপন করা সকল সময় সম্ভবপর হয়না নিজের দ্বারা। সামাজিক মাধ্যমেও বিভিন্ন মঞ্চ রহিয়াছে , যাহা উঠতি প্রতিভাদের জন্যই সংরক্ষিত। জল মাপিতে হইলে ওই স্থানই সর্বত্তোম।
সময়ের তাড়নাতেই সময়োপযোগী কবিতার জন্ম হইয়াছে, এখনও হইতেছে, আগামীতেও হইবে। বাস্তবের প্রেক্ষিত হোক বা কল্পনার পটভূমিতে অঙ্কিত, প্রগতিশীলতা বা আধুনিকতার নামে যেন শৈল্পিক নান্দনিকতা না হারাইয়া যায়। সৎ চেষ্টা সফল হইতে বাধ্য, ইতিহাস সাক্ষী। পাঠকের চৈতন্যের প্রতি অবশ্যই সৃষ্টির দায় বর্তাইয়া থাকে। ফাঁপা শব্দবন্ধের মেকি গড্ডালিকাপ্রবাহে ভাষিয়া না যাইয়া সমালোচোনার জন্য আহ্বানও জরুরী।
মেদ যেমন সুন্দরী নারীর আবেদনকে কুশ্রী করিয়া দেয়, তেমনি কবিতারও অতিরিক্ত শব্দ কবিতাকে গুরুত্বহীন করিয়া তোলে, সমালোচোনার অনুশীলনই পারে আগামীর কবিতাকে মেদবর্জিত ঝরঝরে আকর্ষনীয় রুপ দিতে।
কবিতা কবি বিনে জন্মলাভে অক্ষম। আর সেই পতাকা থাক যোগ্যের হাতে, আর নিজেকে যোগ্য বানাতে প্রয়োজন কাব্যবোধ, সাথে প্রচুর অনুশীলন, আর প্রতিষ্ঠা লিপ্সা। কবিতা হউক সাবলীল আর প্রাঞ্জল। মোটের উপর কবিতা মানুষ ও মানবতার কথা বলুক। তাহার জন্য কবি শিক্ষিত হউক বা না হউক, কাব্যজ্ঞানরহিত যেন না হন। কবিতা মাথা উঁচু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংস্কারের সামাজিক চিন্তায় চিন্তিত হয়ে, অন্ধকার দূর করার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, সমাজ বদলের অঙ্গীকারে উৎসাহ জোগাবে মানুষের হৃদয়কে। নিয়ে যাক রুপকথার অন্তরে, শোনায় সুখ দুখঃখের গীতমালা।
শুধু শব্দের খেলা নয়, সমকালীন কবিতায় থাক শব্দের সঙ্গে শব্দের মেলবন্ধন বা গাঁথুনি, প্রয়োজনে ছন্দও স্থান পাক অন্ত্যে। বাক্যবিন্যাসে থাকুক মজবুত ভিত, যা সমাজ ও কালকে স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখবে, এই বিশ্বাসটা আগে নিজের মধ্যে জন্মাক। আর সেটা সম্ভব হইলে তবেই কবিতার শরীরে ধরা পড়িবে ভালোবাসা ও মমতার প্রলেপ।

Thursday, 4 August 2016

একটি নরম প্রতিবাদ


হাগু পুরাণ
**************

 শ্রীযুক্ত বাবু সৌমেনর একটা ট্রলের প্রেক্ষিতে এই লেখা। আমার আজীবন লালিত, সুখসমৃদ্ধ বাল্য স্মৃতিপট(টি)কে মুছে দেবার যে চক্রান্ত রাজ্য-কেন্দ্র মিলিত সরকার স্বচ্ছভারত অভিযানের মাধ্যমে করতে যাচ্ছে, তার জন্য শুধুই ধিক্কার। আমি সকল সুধী অকপট জনগনকে আমাদের “চিরকি” সঙ্ঘে একবার ঘুরে “যাবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানালাম।
“হাগা” শুধুই একটা জৈবিক দৈন্দনিন কর্ম নয়। ইহা একটি শিল্প। চোখের ইশারাতে নিবিষ্ট হয়ে রসনা তৃপ্তির মাধ্যমে যে সকল সুস্বাদু খাবার, আমরা ভক্ষন করে থাকি, তাহাই আমাদের পাক যন্ত্রে পিষ্ট হইয়া ভীষন মমত্বে আমাদেরই পেটে, উচ্চস্তরীয় গন্ধ বিশিষ্ট ঈষৎস্বর্ণাভ বর্নের এক প্রকার পরিবেশবান্ধব দ্রব্য উৎপাদন করে থাকি , যাকে ‘গু” বলা হইয়ে থাকে। আর এই গু কে তার মর্জিমত আমরা হেগে থাকি। সুতরাং হাগা একটি সয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া মাত্র।
আমরা প্রানীকুল সকলেই হাগি, কিন্তু সেটা নিজেদের মর্জিতে নয়। গু যখন নিজে থেকে বেগবান হয়ে পরিবেশে মিশে যেতে চায়, তখনই একমাত্র সে বাহির হয়। যার জন্য হাগা কখনই আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। পৃথিবীর সকল গুরুত্বপূর্ন মানুষের রুটিন থাকে, খাওয়া, সাক্ষাত, ঘুম, প্রেম থেকে সব্ব। শুধু মাত্র হাগা এমন শিল্প, যার জন্য কোন সময় নেই, হাগা চাইলে, আপনি যে ই হন না কেন, আপনাকে তার জন্য সময় নির্দিষ্ট করতেই হবে। তাহলে হাগার স্থানকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া কি চক্রান্ত নয়?
প্রবাদে কথিত সুখ স্বপনে শান্তি শ্মশানে। মিথ্যা কথা। আসল শান্তি হেগে। পৃথিবিতে হাগাবিলাসিরাই একমাত্র উজ্জ্বল মুখশ্রীর অধিকারী। হাগা নেই যার, পোড়া কপাল তার। যারা পায়খানায় হাগেন তারা শুধু কল্পনা করুন , ওই রকম একটা ছোট্ট বদ্ধ স্থানে আপনাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে পাঁচ মিনিটের জন্য, আমি নিশ্চিত আপনি পারবেন না। অথচ হাগতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একসা হয়েও অধিকাংশ মানুষই একমুখ প্রশান্তি নিয়ে পায়খানা থেকে হেগে বের হন। এটাই হাগাকে শুধু মহান করেনি, হাগা নিজে থেকেই উচ্চমার্গের। অনেকে একাকিত্ব কে যন্ত্রনা বলেন, তারা যানেননা কোষ্ঠকাঠিন্যের জ্বালা।
লোকে বলে কর্ম জরুরী, কেউ আবার বলে ধর্ম। এগুলো সবই হাগাকে হেও করার কুৎসা। কারন একবার হাগা পেলে তার থেকে গুরুত্বপূর্ন জরুরী কাজ আর পৃথিবিতে থাকেনা। মায়ের স্নেহ বা মমত্ব নিয়ে নিশ্চই কেও প্রশ্ন তুলবেন না আশাকরি। তাহলে আজকের আধুনিক মায়েদের কথা ভাবুন, তারা হাগা কে ভালবেসে কি সুন্দর একটা নিকনেক দিয়েছে, আর এটা বিশ্বজনীন, নাম “পটি”। কটা এমন উদাহরন আছে মশাই?
পৃথিবিতে নানা ভাষা, নানা জাতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাদা-কালো বিভেদ। কিন্তু আদর্শ সাম্যবাদ এই হাগার ক্ষেত্রে। ওই উচু হয়ে বসেই আপনাকে হাগতে হবে। ওই বিশিষ্ট ভঙ্গিটার নামই হাগতে বসার ভঙ্গি। আছে পৃথিবিতে, এই ধরনের নির্দিষ্ট কোন ভঙ্গি? হাগতে বসার পোজ। যেটা শুধুই একটা বিশেষ কার্যসিদ্ধি ছাড়া আর কাওকে বোঝায় না। ধনী গরীব, চোর থেকে সাধু, জর্জ বুশ থেকে লাদেন… সবাই ওই একই কায়দায় হেগে থাকে।
অনেক ছিদ্রান্বেশি মানুষ হাগা কে এক বাক্যে শেষ করে দেয়। যেন কমোডের ফ্লাস। কিন্তু ব্যাপারটা অতোটা সহজ নয়। যেহেতু হাগা একটা শিল্প, সেহেতু সেই শিল্পের বিন্যাস রয়েছে, সুধীজনের এ বিষয়ে অবগত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। যেমন

১) ডেলা বাঁধা কোয়া হাগা।
২) ডেলা বাঁধা সসেজ হাগা
৩) ছদ্মবেশী সসেজ হাগা, যার গায়ে ফাটলের নক্সা আঁকা
৪) সর্পিল নরম হাগা অনেকে একে সুস্বাদু জিলাপির সাথেও তুলনা করে থাকে।
৫) স্পষ্ট প্রান্ত কাটা মোটা হগা, যাহাতে কালো রেখা সহ রক্তের ছাপ দেখা যায়।
৬) নাদি হাগা
৭) জীর্ণ প্রান্ত সঙ্গে ফুঁয়োফুঁয়ো টুকরা, এটি একটি আবেগপ্রবণ হাগা। এককথায় ভসকা হাগা, যাতে বায়ুর মিশ্রন থাকে।
৮) পলকা ডট হাগা, এটি সাধারনত তীব্র বায়ু নির্গমনের সাথেসাথে নির্গত হয়, যার দ্বারা মূলত প্যানে বা কমোডে শৈল্পিক দাগ গুলো রচিত হয়।
৯) ল্যাদ হাগা।
১০) তরল হাগা (এর মধ্যেও প্রচুর শ্রেনি বিভাগ রয়েছে)
এগুলো আমরা প্রত্যেকেই কখনো না কখনো হেগেছি। সুতরাং এগুলোকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারিনা। নিখিলবিশ্ব হাগন্তি সম্মেলনে কখনো যোগদান করলে এ বিষয়ে জ্ঞান আরো খোলতাই হতে বাধ্য। আপনি যদি, প্রায় অন্ধকার ঘরে রোজ হাগতে থাকেন, কিভাবে এই বিশাল বিষয় সম্বন্ধে জানতে পারবেন? এক বালতি জনেই তো জ্ঞানের সলিলসমাধি। আপনি ঠিক কতবড় হাগুরে শিল্পী , সেটা অধরাই থেকে যাবে। আমরা কি ঝাল তরকারি খেয়ে জ্বলুনি হাগার তীব্রতায় জীবনের জ্বালা কি ভুলে থাকিনা? এই দ্রুত যোগাযোগ ব্যাবস্থা ও ব্যাস্ততার যুগে ওই হাগার সময়টুকুই তো প্রাকৃতিক ভাবে একান্তে নিজের সাথে কাটানোর সময়। তাহলে সেই সময়ে কেন রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ? কে কোথায় শান্তিতে হাগবে সেটা তার মৌলিক অধিকার হওয়া উচিৎ।
তাই শুধুমাত্র পায়খানায় নয়, খোলা স্থানে হাগার অধিকার দিতেই হবে। মৃদুমন্দ বাতাসে পাছায় কভু মুথাঘাসের সুরসুরি সহ, একা বা বন্ধুবৃত্ত হয়ে মুখে বিড়ি বা গান সহযোগে হাগার মাধুর্য কি জানেন রাষ্ট্র যন্ত্রের কারবারিরা? এই রাজনিতির কারবারিদের পাল্লায় পরেই “অনসন” নামক সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কত জন যে হাগতে ভুলেছে তার ইয়াত্তা নেই।
তাই সুধী হাগামোদী বন্ধুগণ একজন সুস্থ নাগরিক হিসাবে হাগার উপরে এই রাষ্ট্রীয় জুলুমের প্রতিবাদে আপনাকেও সামিল হবার আহ্বান জানাচ্ছি। এই আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ আমরা আমাদের মাঠে হাগার ছবি প্রোফাইল পিকচারে দেবো আগামিতে,#হোকমাঠেহাগা। তবেই হবে আসল চ্যালেঞ্জ এক্সেপটেড। পৃথিবিতে কতশত দিবস আছে, আমরাও মুক্ত হাগা দিবসের দাবি জানাবো। কবির সেই মহান ছড়া মনে করুন

হাগছি মোরা হাগছি দেখো
মুক্তস্থানে আহ্লাদী
ধরফরিয়ে ভরভরিয়ে
মুক্তহাগার পাল্লা দিই।
অথবা

হারে রে রে রে রে
আমায় হাগতে দেরে দেরে
যেমন হাগে বনের পাখি
মনের আনন্দে… রে।
একটা হাগা বিপ্লবের সুচনা করতে চাই আমরা। হাগুগীতির সংকলনের জন্য সরকারি উদাসিনতা মানছিনা মানব না। বিশিষ্ট হাগিয়ে শিল্পীদের বাৎসরিক গুয়েশ্রী সম্মানে ভুষিত করার সম্মান দাবি করছি। যাতে সবাই গর্বের সাথে বলতে পারে, একবার বিদায় দে মা… হেগে আসি।
মনে করুন সেই বানী, হাগন্তির লাজ নেই দেখন্তির লাজ। মানে সমল হাগাবিলাসি মানুষজন লজ্জার উর্ধ্বে। শুধু মন থেকে কপট লজ্জাকে দূর করে যে যেখানে পারেন হেগে দেখিয়ে দিন। এই হাগা শব্দ টি থেকেই গোরারা জড়াজড়ি কে হাগ বলে থাকে। আজ দেশে গরুর হাগা, মানে গোবরকে ওষুধ হিসাবে খাওয়া হচ্ছে, আমরাই খাচ্ছি অস্পৃশ্য শুদ্ধিকরনের জন্য। এখন গোবরে নাকি সোনা পাওয়া যাচ্ছে, ওই গরু কি কখনো নির্দিষ্ট স্থানে হাগে? তাহলে মানুষের জন্য কেন এই অবিচার? কেন আইন গোবরের পথে চলবে না?
আমাদের সমবেত গনহাগা মন্ডলী তে সরকারকে সামিল করলে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত নিশ্চই আর পুনরায় করবেন না। মনে রাখবেন আপনি কাল হেগেছিলেন, আজ হেগেছেন কালও হাগবেন। আপনিও মুক্তমন ও মুক্তস্থানে হাগুন ও অন্যকেও সাহায্য করুন। শুধু আপনার দুর্গন্ধ যেন অন্যের দমবন্ধের কারন না হয়ে দাঁড়ায়।
হাগতে গিয়ে কেউ মৃত্যবরন করে না, কিন্তু মৃত্যুকালে অনেকেই হেগে ফেলেন, তাই হাগা পৃথিবীর অন্য তম সহজ কাজ। যেকোন বীর বা সাধারন মানুষ যদি কোন কাজে অসমর্থ হয়, তাকে টিপ্পনি করে বলে হেগে ফেলেছে, ভাবুন এটাই কি যথেষ্ট প্রমান নয় যে, হাগাই সবচেয়ে সহজ কাজের মধ্যে একটা। অবশ্য অসুস্থতা হলে ভিন্ন কথা। হাগার জন্য কারো অসুখ করে না, অসুখ করলে মানুষ অনেক সময় হাগে।
সময় বদলাচ্ছে আগামিতেও বদলাবে, খাদ্যাভাস থেকে সব কিছুই বদলাচ্ছে, বদলায়নি শুধু হাগা, সৃষ্টির আদি মানুষও হেগেছিল, শেষ মানুষও হাগবেই। তাই হাগা কে হাগার মত থাকতে দিন।
মৃত্যুর আগে হাগাই একমাত্র সত্য।
উন্মাদ হার্মাদ