উন্মাদীয় রবিবাসর
******ফাউ********
পাগলের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে দুলাল।
ঠিক কি কি ওকে করতে হচ্ছে এটা না না বলে, বলা ভালো ওকে কি কি করতে হচ্ছে না। বাড়ি পাহারা দেওয়া থেকে শুরুকরে হসপিটাল যাওয়া, পুলিস প্রশাসন, ইনস্যুরেন্স থেকে সব কিছুই তো ওই এই বয়সেই সামাল দিতে হচ্ছে। অথচ এমনটা তো হবার কথা ছিলোনা। আর পাঁচটা ছেলের দল যেমন হেসে খেলে ইস্কুল গিয়ে দিনাতিপাত করে, দুলালও তেমনই করতো। বাড়িতে হয়তো চাপা টেনসনটা বছরখানিক ধরেই বর্তমান ছিল, কিন্তু তার জন্য তো বাবা দিদি কাকা সব্বাই ছিলো, তারও আগে কাকা জ্যেঠু মামা মাসির দলও ছিলো, আপদে বিপদে পাশে থাকার জন্য। আজ দীর্ঘ ১১ দিন, দুলাল যেন ক্লাস এইটের স্কুলপড়ুয়া বাচ্চা না, সে যেন ৪৫এর পাক্কা সংসারি। সত্যিই সংসার বড় বিচিত্র।
এই পুজোতেই তো ওরা আন্দামান যাবার প্লান করেছিল। দিদি আর বাবা। জাহাজে চড়ে যাবে, প্রথম দিন তো উত্তেজনায় ইস্কুলে গিয়ে দুলাল বন্ধুদের কাছে ব্যাপারটা বলতেই পারিনি। সে ওতটা যদিও জানে না যে, আন্দামানে ঠিক কি কি দেখার আছে বা কোথায় কোথায় ঘোরার জাইগা। তবুও এক অলীক হাতছানির টান। সব যেন কেমন আবছা হয়ে গেছে আজ। সেই স্বপ্নগুলো আজ অনেক কষ্ট করেও ভাবতে পারে না দুলাল। তবুও মনে বিশ্বাস করে যে, নিশ্চই সবকিছু তারাতারি ঠিক হয়ে যাবে।
দুলালের বাবা সত্যরঞ্জন বিশ্বাস নদীয়া জেলার মাজদিয়া অঞ্চলের কোন একটা পোষ্ট অফিসের পিয়নের চাকুরি করেন। গ্রামের বাড়ি আদাপোঁতা- গোবিন্দপুর গ্রামে। গ্রামে কিছু অবশিষ্ট জমিজমা আছে। সেগুলো ওনার ভাইয়েরাই চাষআবাদ করে দেয়। সত্যবাবু চিরকালই মিতব্যায়ি। যার জন্য সংসারে বাহুল্য মোটেই না থাকলেও, স্বচ্ছলতার সাথে সাথে অভাবও কখনোই ছিলো না। একটু বেশী বয়েসেই বিবাহ করেছিলন উনি, বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান, এক সময় ভেবেছিলেন চিরজীবন অকৃতদার থেকে যাবেন, কিন্তু মৃত্যুশয্যায় মায়ের কথানুযায়ী চার ভাইএর জ্যাষ্ঠ , জীবনের ৩৭ টি বসন্ত পার করা সত্যরঞ্জন হাঁসখালির গোঁড়া বৈষ্ণব পরিবারের কন্যা, সপ্তদশী বিশাখার সাথে পরিনয় সুত্রে আবদ্ধ হয়।
সনাতন ভারতীয় পরিবারের যেমন চাহিদা, সত্যবাবুর পরিবারও তার ব্যাতিক্রন নয়। বিবাহের বর্ষপূরন হবার আগেই বিশখা দেবীর কোল আলো করে মালক্ষীর আগমন হলো। তাহাতে একমাত্র সত্যরঞ্জন বাবু ব্যাতিরেকে পরিবারের আর কেউই খুশি হতে পারলেন না। সবাই যে পুত্রসন্তান কামনা করেছিল। এমনকি সবচেয়ে বেশী যার মন ভেঙ্গে গিয়েছিল, তার নাম বিশখা দেবী। সুতরাং বেশ খানিকটা অনাদরেই বড় হতে লাগলো “ইতি”।
ইতিরানী বিশ্বাস। ইতি নামটু এই জন্যই, যাহাতে বিশখাদেবীর কন্যসন্তান যেন ওইখানেই ইতি হয়ে যায়। কিন্তু পরমেশ্বরের মতি বোঝায় দায়। পরবর্তী ১২ বছরে আরো চারবার বিশখা দেবী গর্ভবতী হয়েছিলেন বটে, কিন্তু বিজ্ঞানের আশির্বাদে তারা ভুমিষ্ট হবার পুর্বেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। কারনটা ওই... যেহেতু ইতিতেই শেষ ঘোষণা হয়ে গেছিলো, তাই ইতির আর কোন বোনের পৃথিবীর আলো দেখার অধিকার ছিলোনা। ইতিকে জন্ম দিয়ে বিশখাদেবী ঠিক কতটা উপকার ইতির জীবনে করেছে, সেটা প্রতি পদে পদে তিনি তার কন্যা ইতি কে বুঝিয়ে দিতেন। এবং তিনি সহ পরিবারের সকলেই, একটি বিশেষ নামে তারা স্বীয় কন্যাকে সম্বোধন করতেন।
ইতির চোদ্দতম জন্মদিনটাই, এযাবৎ তার জীবনের সবথেকে স্বরনীয় ঘটনা। সেবার খুব ঘটা করে জন্মদিন পালিত হয়েছিল। বিশখাদেবী নিজে হাতে পায়েস রান্না করেছিলেন, পাড়াপড়শিদের পরমান্ন খাইয়েছিলেন। যদিও কারনটা ইতির জন্য নয়, আসলে ওই বৎসরই ইতির জন্মদিনের মাস তিনেক আগে ভাই দুলাল পৃথিবীর আলো দেখে। বিশখাদেবী সেই আনন্দ উদযাপনের জন্য যথার্থ ফিকির না পেয়ে ইতির জন্মদিনেই খুশির প্রকাশ করে ফেলেন। পরবর্তী তে দুলালের অন্নপ্রাশনে সত্যবাবুকে রীতিমত বাজার থেকে মাসিক সুদে টাকা ধার করতে হয়, উদযাপনের খরচ মেটাতে।
পরবর্তী বছরে মা ষষ্টীর কৃপায় বিশখাদেবী পুনরায় গর্ভবতী হন। সাংসারিক অত্যচারে জর্জরিত অপুষ্টির শরীর, উপর্যুপরি গর্ভের ধকল না নিতে পেরে ও আগের গর্ভপাত জনিত কোন ত্রুটিগত কারনে, বিশখা দেবী তৃতীয় সন্তান জন্মদান কালীন, গর্ভস্থ সন্তান সহ, সরকারী হাসপাতালের বেডেই শেষ ইতি আর দুলালকে অনাথ করে অমৃতলোকে যাত্রা করলেন। ঘটনাক্রমে ওই গর্ভস্থ সন্তানটিও পুত্রসন্তানই ছিল। সত্যরঞ্জনবাবু বেশ কয়েকমাস যাবৎ খাওয়াদাওয়া ছেরে স্থবিরাবস্থার পরে, সমস্ত সংসারের ভার অজান্তেই কন্যা ইতির ঘাড়ে সঁপে দিলেন। ইতিও এতোটা গুরুত্ব আগে কখনো পায়নি। তাছারা মা চলে যাওয়ার জন্য সত্যি কথা বলতে তার জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। কারন মা- মেয়ের মধ্যে কখনই সেই চিরায়িত বন্ধনটা, কি যেন এক অজানা কারনে সম্পূর্ন উধাও ছিল। দুলাল তখন সবে এক পা এক পা হাটতে শিখেছে। সেই থেকে ইতিই দুলালের মা।
মা চলে যাবার পর থেকে ইতি, ওই পনেরতেই বাড়ির কর্তী হয়ে উঠলো। ছোট থেকেই চুরান্ত অবহেলার শিকার, ওর চরিত্রটাই অন্তর্মুখী করে তুলেছিল। যার জন্য ওর সমস্ত অপুর্ন ইচ্ছা রাগ ইত্যদি গুলো পরিক্ষার খাতায় প্রকাশ করে আসতো। বইকেই বন্ধু ভেবে আঁকরে ধরেছিল। ক্লাসে ফার্ষ্ট হয়তো কখনোই সে হয়নি, তবে প্রথম পাঁচের মাঝেই সে থাকতো। একাকী বাবাও যেন সেই সময় মেয়ের উপরে সম্পুর্ন নির্ভরশীল হয়ে পরেছিল। কচি ভাইকে বড় করার দায়িত্ব ভাগ করে নেবার জন্য, ইতির দিদা প্রথমদিকে বছর দুয়েক ছিল। কিন্তু দুলালের মামি সন্তানসম্ভবা হতেই দিদা নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। যদিও তাতে ইতির তেমন একটা ক্ষতি হয়নি, কারন মাধ্যমিকটা তার মাস দুয়েক আগেই শেষ হয়ে গেছিল।
পরিক্ষার ফলে ইতি আশাতীত ফল করেছিল। খান পাঁচেক বিষয়ে লেটার সহ উত্তীর্ন করা হেতু, কৃষ্ণনগরে ভালো স্কুলে বানিজ্য বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। সত্যবাবু বানিজ্যের মত বিষয়ে খানিক আপত্তি করলেও, শেষমেশ মেয়ের সিদ্ধান্তে সিলমোহরই দিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়িতে দামাল ভাই, অগত্যা অনেক কষ্ট করেও সত্য রঞ্জন বাবু পাড়ারই এক বিধবাকে শুধু মাত্র বাচ্চাকে ধরার জন্য নিয়োগ করলেন।
এই অতিরিক্ত পয়সার সংস্থান অবশ্য ইতিই পাড়ার বাচ্চাদের, সন্ধ্যেবেলা টিউশনি পড়িয়ে যোগার করে নিত। বেঁচে যাওয়া অতিরিক্ত পয়সায় কখনো কখনো নিজের নুন্যতম চাহিদা গুলোও মিটতো না। আসলে মফঃস্বলের টিউশনি তো, অর্ধেক বেতনই আদায় হতো না। তাছারা ইতি কখনো কাওকেও চাপ দিয়ে বেতন দাবি করেনি। জোর করাটা অর চরিত্রে যে এক্কেবারেই ছিলনা। পয়সার নিতান্ত দরকার নাহলে, সে হয়তো বিনামূল্যেই শিক্ষাদান করতো, যাতে ওর মত দূর্বিষহ অতীত যেন কারো না হয়।
দেখতে দেখতে উচ্চমাধ্যমিকও যোগ্যতার সাথে পাস করে একাউন্টেন্সি অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। এবং সেটাও বেশ কৃতিত্বের সাথেই পাস করে গেল। এই বছর গুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলতে, সত্যরঞ্জন বাবু চাকুরি জীবন থেকে অবসর গ্রহন করেছিলেন আর দুলাল স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল। খুবই শান্তশিষ্ট ছেলেটি চতুর্থ শ্রেনীতে উঠেছে। মোটামুটি শান্তশিষ্ট জীবন চলছিল, নিস্তরঙ্গ পুকরের জলের মত। ইতির তেমন কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কোনদিনিই ছিলো না। জীবন যেমন যেমন যে যে খাতে ওকে বইয়েছে, ও তো সেই পথেই চলেছিল মাত্র। সেখানে ওর ইচ্ছা অনিচ্ছা, চাওয়া পাওয়া, ভালোলাগা মন্দলাগাকে কে ই বা গুরুত্ব দিয়েছে। ইতি তার প্রতিবন্ধকতা জানতো, তাই ওর তেমন বন্ধুও কেও হয়ে ওঠেনি।
আদর্শ বৈষ্ণব পরিবারের মত গলায় তুলসীর কন্ঠীহার আর শ্বেতচন্দনের তিলকে শোভিত হয়ে বাইরে বেরোনোর প্রথাটা, সেই যে মা থাকা কালীন শুরু হয়েছিল, স্কুলজীবনে কোনদিন তার কোন ব্যাতিক্রম ঘটেনি। যদিও ওই বিশেষ বেশভূষা শতাংশের বিচারে নিতান্তই নগন্য, এবং আধুনিক সমাজের চোখে যে, খানিকটা যে দৃষ্টিকটু লাগতো না, তা ঠিক নয়। অন্তত ওই বয়েসের মেয়ের জন্য। তবে সেটা কলেজের প্রথম বর্ষের আগে কখনো মনে হয়নি ইতির। জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্রামে এতোটাই ব্যাস্তছিল যে, পোশাকপরিচ্ছদ তথা রূপচর্চার আধুনিকতা সম্বন্ধে ভাবার অবকাশই ছিল না। বিশখাদেবী বিশ্বাস করতেন যে, ওই হরির কণ্ঠীহার আর গোপালের তিলক মেয়েকে কুনজর থেকে রক্ষা করবে।
আসলেও তাই, ছেলেরা তেমনভাবে পাত্তাই দিতো না ইতিকে। ওর ওই চুপচাপ থাকা ও ওই অদ্ভুত সাজসজ্জার কারনেই হবে বোধহয়। এত আদপে ইতিরই লাভ হয়েছিল। নিজের পড়াশোনার প্রতি নিরঙ্কুশ মনঃসংযোগ করতে সুবিধেই হয়েছিল। তবে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ও নিজে থেকেই, অন্তত কলেজে আর তিলক কেটে যেত না। তৃতীয়বর্ষে কন্ঠিহার টা ও বিদেয় নিল। বছর ২১ এর, দীর্ঘাঙ্গী তন্বী গ্রাম্য যুবতী ইতিরানী বিশ্বাস, রোজকার দৌড়ঝাপে বেতের মত ছিপছিপে শরীরে মেদের বিন্দুমাত্র উপস্থিতি নেই।
যে যৌবন বছর পাঁচেক আগেই তার শরীরে আগমনের ছোঁয়া দিয়েছিল, আজ তা জাকিয়ে বসে তার শাখাপল্লব বিকশিত করেছে। মুখমন্ডলীর আকর্ষনীয় মাগুরে রঙা যে আসলে রোদে পোড়া ধবধবে ফর্সারই ভিন্নরূপ, সেটা অবগুন্ঠিত দেহাংশের যেকোন অংশ অসাবধানতা বসত উন্মুক্ত হলে পরিলক্ষিত হয়। আওতার ঘাসের ন্যায়, তার শরীরি বিভঙ্গ শিল্পীর কল্পনা তথা তার তুলিকেও হার মানায়।
বছরে ২-৪ বার গ্রামের বাড়ি যাওয়া ছারা অন্য কোথাও তেমন যেতনা। তবে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান রক্ষা বা পরলৌকিক ক্রিয়াদি জাতীয় বিষয়গুলোতে পরিবারের পক্ষ থেকে সাধারনত ইতিই উপস্থিত থাকতো। তাতে সেটা জমির ফসলের টাকা নেওয়ার কাজই হোক বা ভাইয়ের স্কুলের কোন কাজ, সবটাই তাকেই করতে হতো। রিটায়ারের আগে সিনিয়ারিটির দরুন সত্যরঞ্জন বাবু, বেশ কিছু বছর পোষ্টঅফিসের ঘরে বসেই কাজ করতেন, বেতন ও আগের তুলনায় বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
রিটায়ারে এককালিন অনেকটা টাকা পাওয়ার দরুন সংসারে সচ্ছলতার মাত্রার সুচক উর্ধমূখীই ছিল। করোগেটের টিনের ঘর ভেঙে তিনকুঠরি একটা বাড়িও বানিয়েছেন সদ্য। সরিও তাতে এখনো পলেস্থারা পরেনি। তার মধ্যেই অবশ্য সত্য বাবু কন্যা-পুত্র নিয়ে বসবাস করতেন। এরই মধ্যে ইতি স্নাতকোত্তর পড়াশোনা চালাবার জন্য কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে বার কয়েক ঘুরে , কয়কজন বন্ধুস্থানীয় সহপাঠী ও শিক্ষকদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তীর পাশাপাশি একটি নামী বেসরকারি সংস্থায়, প্রতিযোগিতামূলক পরিক্ষার জন্য প্রস্তুতি কেন্দ্রেও ভর্তী হয়ে গেল।
এরই মাঝে দুলালের কাছে সে সাইকেল চালানোটা রপ্ত করে, নিজে একটা লেডিস সাইকেলও কিনেছে। টিউশনির পয়সায় বাঁচিয়ে। উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রী পড়ানোর দরুন বর্তমানে তার আমদানি নেহাত খারাপ হয় না। স্থানীয় ভাবে প্রায় সকলস্থানেই এখন সে সাইকেলেই যাতায়াতটা সেরে নেয়। মনখারাপের বিকালে মাঝে মাঝে সে চূর্নী নদীর তীরে একা একাই বসে থাকে। সন্ধ্যার আগে আবার ঘরে ফিরে আসে। মোবাইল ফোন বা আধুনিক বৈদ্যুতিন সরঞ্জামে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। কাকেই বা সে ফোন করবে। কিন্তু এই সাম্প্রতিক ওই বেসরকারি কেন্দ্রটিতে ভর্তি হবার পর কম্পিউটার শিখেছে, আর একটা সস্তার পুরাতন মোবাইল ফোনও কিনেছে।
পরমেশ্বর সকলকেই জীবনে এক আধবার সুযোগ দেনই দেন। ইতিই বা সেই নিয়মের ব্যাতিক্রম হবে কেন! তার উপরে ইতি নিঃসন্দেহে অনুগত পরিশ্রমী ও মেধাবী ছাত্রী। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের অফিসার পদের জন্য পরীক্ষা দিতেই , তার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে যায়। এটা অবশ্য তার অধ্যাবসায়ের পাওনা। সত্যরঞ্জন বাবু খুশিই হলেন মেয়ের এই সাফল্যে। সুতরাং লেখাপড়ার পাট সেখানেই সাঙ্গ হলো। প্রথমে কোলকাতায় বেশ কিছুদিন ট্রেনিং, শেষে মহিলা হবার দরুন বাড়ির বেশ কাছেই, ওই ব্যাঙ্কেরই রানাঘাট শাখায় প্রথম নিযুক্তি করন হলো।
জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখার দরুন কোন কাজেই ইতির আড়ষ্টতার লেশমাত্র ছিল না। ওর মূল মন্ত্র, হয়তো এটাই তার প্রথম ও শেষ সুযোগ। তাই শালীনতা বজায় রেখে, পাত্রের আকারের সাথে ঢলে গিয়ে চট করে নিজেকে মানিয়ে নেবার এক অসাধারন গুন সে রপ্ত করে ফেলেছিল। অল্পদিনেই সহকর্মী ও ব্যাঙ্কের ওই শাখার গ্রাহকদের কাছে এক জন জনপ্রিয় মুখ হয়ে উঠলো।
ফ্রন্টডেস্ক অফিসার থেকে ক্যাসিয়ার হয়ে, ইতি বর্তমানে কৃষ্ণনগর শাখায় একাউন্ট অফিসারের পদ নিয়ে বদলি হয়েছে সবে। এর মাঝে তিনটি বছর যেন চোখের পলকে গায়েব হয়ে গেছে। ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে, বাবাও মুন্ডিত মস্তকে জপমালাকে সাথী করে একটা কীর্তনের দলের সাথে ভীরে গিয়ে নতুন ভাবে জীবনকে আবিষ্কারের চেষ্টায় মত্ত। ইতির বেতনের টাকার বাড়ির ও শ্রী ফিরেছে। নতুন রঙ করা থেকে সামনে একটা ছোট্ট ফুলের বাগান সহ, বেশ কিছু আসবাব পত্রের ও আমদানি হয়েছে। বেশ শান্তিময় আবহওয়া।
হঠাত করে দেখলে নিকট আত্মীয়স্বজনেরা আজকাল ইতিকে কেওই তেমন চিনতে পারবে বলে মনে হয় না। তিন বছর আগের ইতির সাথে আজকের এই কর্পরেট ইতির আকাশ আর পাতালের ফারাক। কৃষ্ণনগরে আসার পরেই সে একটা স্কুটি কেনে, যাতায়াতের সুবিধার জন্য। নিজের সুবিধা মত যাতায়াত করা যায়।
দারুন ব্যাপারটা সেই সময়ই ঘটে গেল। কৃষ্ণনগর ব্রাঞ্চে আসা ইস্তকই পুরুষ সহকর্মীর দল মৌমাছির মত ইতির আশেপাশে নানা অছিলায় ঘুরঘুর করতো। সেটা ম্যানেজার সাহের আর শুভ্র ছারা প্রায় সক্কলেই। শুভ্র হলো ওই ব্রাঞ্চের অস্থায়ী পিয়ন, বড়লোক বাবার বখাটে ছেলে। পড়াশোনা কোনমতে উচ্চমাধ্যমিক ফেল। বোমবোম করে লাট্টুর মত সারা দেশ ঘুরে বেড়াতো, আর বাপের পয়সার শ্রাদ্ধ করতো। ব্যাবসায়ি পিতা পরিচিতিবলে ব্যাঙ্কের কাজটুকু জুটিয়ে দিয়েছেন।
নিজের কাছেও ব্যাবসা শেখাতে রাখতে পারতেন, কিন্তু সঠিক শাষনের জন্য অন্যের দোরেই কর্ম শ্রেয়, এই ভেবেই ব্যাঙ্কের চাকুরিতে বহাল। অন্তত কাজটা করার অভ্যাসটা আগে তৈরি হবে, এই আশায়। তাই সর্বদা শুভ্র মনমরা হয়েই, ব্যাঙ্কের প্রায় সকল সহকর্মীরই ফাইফরমাইস নির্দ্বিধায় সে শুনে চলতো। কোনকিছুতেই তার তেমন আগ্রহ ছিল না। নিরাশক্ত শুভ্রর পৈতৃক বাড়ি নদীয়ারই আসাননগরে।
এই উদাসীনতার যাঁতাকলে আটকা পরে, ইতি- শুভ্রকে মন দিয়ে বসলো। একসাথে অফিস, আসাননগর পর্যন্ত একসাথে স্কুটিতে যাওয়া, ছুটিতে পার্কে বা সিনেমা দেখতে যাওয়া। সবটাই চুটিয়ে শুরু হলো। অফিসেও একে একে সকলেই জেনে গেল ওদের সম্পর্কের কথা। তাতে করে বেশ কয়েকজন সহকর্মী ব্যার্থ মনোরথে সাময়িক শত্রুর মত আচরনও শুরু করে দিল। যাই হোক শেষ পর্যন্ত দুই পরিবারেই জানাজানি হতে বেশী দেরি লাগলো না। মাস ছয়েকের মধ্যেই গোটা ঘটনাটা এই অবস্থায় এসে পৌছালো।
ইতি আর শুভ্র মিলে ঠিক করলো তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। শুভ্রর বাড়িথেকে আপত্তি না থাকলেও, ইতির বর্ধিত বৈষ্ণব পরিবার, মানে মামা মাসি কাকা জ্যাঠ্যা সহ পাড়াপ্রতিবেশির দল, প্রায় প্রত্যেকেই এই বিয়েতে বেঁকে বসলেন। একে শুভ্রর পদবী পাল, জাতিতে চাষা সদগোপ। ইতিরা বৈষ্ণব, আত্মীয় পরিজন কোন মতেই এ বিয়ে মানবেন না। কিন্তু ইতি সেই এক গোঁ। তার উপরে কর্মজগতে শুভ্র, ইতির অধীনস্থ কর্মচারী। কিন্তু ইতি যে, বিয়ে কেবল শুভ্রকেই করবে। সকলের মতকে অগ্রাহ্য করে, নিমরাজী সত্যরঞ্জন বাবু শুভ্র পালের হাতেই মেয়েকে সঁপে দিলেন।
বৌভাতের রাত্রে ফুলশয্যার সময়, শুভ্রর মধ্যে এক বিশেষ ধরনের চঞ্চলতা লক্ষ্য করলো ইতি। যদিও সারাদিনের ক্লান্ত শরীরে শীঘ্রই সেই রাত্রে, সে ঘুমিয়ে পরলো। এর পর অষ্টমঙ্গলায় এসেও শুভ্র যেন কেমন একটা অচেনার মত ব্যাবহার করতে লাগলো। ইতির কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো। প্রেম করে বিবাহ। তবুও জিজ্ঞাসা করতে যেন কোথায় একটা বাঁধছিল। শেষে দিন পনের পর, অফিস থেকে ফেরার পথে স্কুটিতে একদিন সে শুধিয়েই ফেললো কথাটা। শারীরিক অক্ষমতা আছে কি না, এই বিষয়ে।
-শুভ্র! চলোনা কোলকাতা যায়, একটা ভালো ডাক্তার দেখিয়ে আসি। এভাবে তো আর স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক থাকে না। আমি তোমার বিবাহিত স্ত্রী, তাছারা আমারা ভালো বন্ধু, আমার কাছে তোমার লজ্জা কি? তোমার আর আমার বলে কি আর আলাদা কিছু আছে! সবটাই তো আমাদের... ইত্যাদি ইত্যাদি।
শুভ্র নিরুত্তর রইলো, রাত্রে খাবার টেবিলে শ্বাশুরির কাছে যথেষ্ট গঞ্জনা শুনতে হলো। কেন সে শুভ্রুর পৌরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। খুব মনটা খারাপ হয়ে গেল ইতির। প্রচন্ড মানসিক অভিঘাতের দরুন পরদিন সে আর শ্বশুর বাড়ি ফিরলো না, ব্যাঙ্ক থেকে সোজা বাপের বাড়ি। স্বামির কাছেও তার কোন পার্শোনাল কথা থাকতে পারে না? রাত্রে ইতির শ্বশুর অবশ্য সত্যবাবুকে ফোন করে জেনে নিয়েছেন ইতি সেখানে গেছে কি না। এরই মাঝে ব্যাঙ্কের কাজকর্মও রোজকারমত চলছিল, শুধু ইতি যেন কেমন অসহিষ্ণু হয়ে পরেছিল। গ্রাহক ও সহকর্মীদের সাথে রূঢ়ভাবে বেশ কয়েকবার ব্যাবহারও করে ফেলেছিল। বিয়ের পর সহকর্মীরা এমনিতেই ইতির থেকে দুরত্ব বজায় রাখতো। যেমন আত্মীয়স্বজনেরা দূরে সরেগিয়েছিল শুভ্রকে বিয়ে করার জন্য।
অনেক ভেবে, শেষে বাবার মান সম্মানের কথা ভেবে সে যাত্রায় ইতি আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু তিনদিনের মাথায় মদ্যপ শুভ্রর হাতে চরমভাবে নিগৃহীত হয়ে, সারা শরীরে কালসিটে দাগ নিয়ে যেই রাত্রেই একাকি যুবতী মাজদিয়া ফিরে এল। কলপারে পরে গেছে এই অজুহাতে ব্যাঙ্ক থেকে চিকিৎসা জনিত ছুটিও নিয়ে নিল। সত্যবাবু এখন সারাদিন কীর্তনেই ব্যাস্ত। আজকাল অনেক দূর দূর চলে যান, কীর্তনের দলের সাথে, তাই সংসারের তেমন খোঁজ নেওয়াও হয়ে ওঠে না।
শুধু এটুকু জানেন যে, মেয়ে অসুস্থ। কিশোর দুলাল স্কুলের পড়াশোনা আর খেলাধুলা নিয়েই ব্যাস্ত। তাই পিতা-পুত্র কেউই জানতে পারলেন না সত্য ঘটনাটা। শুভ্রদের বাড়িথেকেও কেও খোঁজও নেয়নি রাগের কারনে। এর বেশ কিছুদিন পর আবার ইতির ব্যাঙ্ক যাত্রা শুরু হলো। সে এক অদ্ভুত যন্ত্রনাময় পরিস্থিতি। কাওকে বলাও যায় না, আবার সওয়াও যায় না। কর্মসুত্রের দরুন শুভ্রের সাথে একজন অধস্তন স্টাফের মতই ব্যাবহার করতে হত ইতিকে। কিন্তু কোথাও যেন একটা দুরত্ব তৈরি হয়েছিল। এটা সহকর্মীদেরও চোখ এড়ায় নি। তাই যদি কিছু অযাচিত সুযোগ পাওয়া যায়, সেই চেষ্টায় কয়েকজন সহকর্মী পুনরায় ইতির ঘনিষ্ট হবার চেষ্টাতে ব্রতী হয়ে উঠলো।
হাজার হোক, নিজের বিবাহিত স্ত্রী। এই সকল ঘটনাক্রম শুভ্রের অদৃশ্যপৌরুষেও আঘাত করলো। সে যথারীতি পুনরায় ইতির নৈকট্যলাভের চেষ্টায় লেগে রইলো। মেয়ে মানুষের মন, তার উপর আবার বাঙালী রমনী, স্বামীর সামান্য সোহাগেই সব অভিমান গলে জল। দিন পনের পর অবস্থা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল শুভ্রের সাথে। কিন্তু ততদিনে ইতি শ্বশুরকুলের প্রায় সকলের চক্ষুশূল হয়ে হঠেছিল। আরো দিন পনের পর শ্বশুরগৃহে ফেরার পর, শুভ্র ব্যাতিরেকে প্রায় সকলেই অযাযিতর মত ব্যাবহার করতে লাগলো। কথায় আছে স্বামীর সুখ থাকলে বাকি সকলই হেলায় সহ্য করা যায়। তাই ইতি সাফল্যের সাথেই সমস্ত কিছু কে উপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় নিরুপদ্রবে মাস খানেক সংসার করার মধ্যে শুভ্র একবার ইতির সাথে কোলকাতার এক ফার্টিলিটি ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসার বিষয়েও বিশদে কথা বলে এসেছে। দুজনেই সুসময়ের অপেক্ষায়।
এরই মাঝে কোলকাতায় যাবার ঘটনায় শ্বশুর বাড়িতে কি করে যেন জানতে পেরে, চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। শ্বাশুরি মার নিজস্ব আবিষ্কারে উদ্বাঘাটিত সত্যানুযায়ি, কুলক্ষণা বৌমার কারনেই নাকি তার দুগ্ধপোষ্য শিশু পুত্রের এই দৈহিকক্ষয় ও হয়রানি। সুতরাং তিনি তার যথাসাধ্যমত ও সমবেতভাবে ছেলের মস্তিষ্কে স্থাপন করতে কসুর করলেন না তাঁর পর্যবেক্ষন। সন্দেহ এক বিষম বস্ত, ফলও হলো হাতেনাতে। কড়াই খুন্তি এক কাছে থাকলে যেখানে টুংটাং ঠোকা লাগে, সেখানে রক্তমাংসের স্বামি-স্ত্রীর সমগ্র বিপণির ন্যায় প্রতিষ্ঠানেরও, সম্পর্কের নিজস্ব কিছু নিয়ম রয়েছে। যুদ্ধ থেকে প্রেম, এই সম্পর্কের মধ্যে তো সবকিছু মানে সকল কিছুই ঘটা স্বাভাবিক যা যা পৃথিবীতে ঘটা সম্ভব। কিন্তু মাঝে অনুঘটকের মত কেও সেই সম্পর্কের ভিতর অনৈতিক প্রবেশ করে, তাহলে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে ঘটতে, সেই সম্পর্কের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটা আশ্চর্য কিছু নয়। এক্ষেত্রেও সেটাই ঘটলো।
সতরাং শ্বাশুরিমাতার নির্দিষ্ট পরিকল্পনার গুনে অল্পদিনেই ইতি ও শুভ্রের জীবন নরকযন্ত্রনার ভরে উঠল। ইতি নরকদর্শন করলো যেদিন, সেদিন রোববার। দুপুরে খাসির মাংস রান্না করছে ইতি। বাপের বাড়িতে মাংসের চল ছিল না মোটেই। শ্বশুরবাড়ির সকলে ননদের বাড়িতে বেড়াতে গেছিলো, ঘরে শুধু শুভ্র আর ইতি। বারটা নাগাদ কলিংবেলের আওয়াজ। শুভ্রই দরজা খুললো। ওরই পুরাতন বন্ধুর দল। ইতি মনে মনে খানিকটা বিরক্ত হলেও হাসিমুখেই সকলকে আপ্যায়ন করলো।
আসলে ওর মনের ইচ্ছাটা ছিল, আজ নিভৃতে একান্তে স্বামীর সহচর্য লাভ। সেই অভিপ্রায় মাঠেমারা গেল। এগুলো শুভ্রর বদ সঙ্গের একটা অংশ। দুপরের সেই রান্নাকৃত মাংস সহযোগে চললো দেদার ফুর্তী, মদ্যপানের ফোয়ারা সহ। এরই মাঝে হঠাৎ করে মদের খেয়ালে শুভ্রর সুর্বুদ্ধি(!) জাগ্রত হলো। স্ত্রীকে সে চরম ভালবাসতো, কিন্তু রমনসুখ দিতে অক্ষম, সেটা বন্ধুদের নিকটে মদের খেয়ালে সেই কথার উপস্থাপন করতেই, তারা বন্ধু সৎকারে একপায়ে রাজী হয়ে গেল।
এর পরের ঘটনা শুধু মাত্র ইতি জানে আর জানে তার ঈশ্বর। রক্তাক্ত কুমারি ইতির সেকি চরম পরিণতি। ইতিকে আবার মানসিক অবসাদ গ্রাস করলো। মুন্ডিত মস্তকের পিতা সত্যরঞ্জন জপমালা নিয়ে জীবনের সার উদ্বাঘাটনে ব্যাস্ত। এই শুভ্রের জন্যই আত্মীয় পড়শিরা আজ কেও পাশে নেই। অথচ আত্মহত্যা করার কথাটাও ইতির মনে এলো না। বরং সে আরো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। বেশ কিছুদিন ছুটির পর ব্যাঙ্কের উচ্চমহল থেকে উপর্যুপরি এই ছুটির কৈফিয়ত দাবি করে যথা শিঘ্র কাজে বহাল হবার চিঠি পেয়ে অগত্যা পুনরায় ব্যাঙ্কে যাওয়া শুরু করলো।
কিছুদিনের মধ্যে আবার সেই পুরাতন নাটকের পুনরাবৃত্তি। কিছুদিন অপরিচিতের মত থাকার পর, আবার ইতির ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা। মাঝে শ্বশুর মশাই ও মেসো শ্বশুর ও এসে একবার বৌমার কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছেন। কারন নেশা ছুটে যাবার পর শুভ্র বুঝতে পারে, যে সে ঠিক কি করেছিল। কিছুদিন আত্মঅনুসোচোনার পর বাড়িতে সকল ঘটনার পুংঙ্খানুপুঙ্খ বিবরন দেয় সেই দিনের। তাতে করে সবাই দুঃখিত হলেও শ্বাশুরিমাতা আর ননদ বেশ তারিয়ে তারিয়েই ব্যাপারটা উপভোগ করে। যেন তাদের মনের মত একটা কর্মসম্পাদন করেছে তার নপুংশক ছেলে বা দাদা।
এইভাবে মাস ছয়েক অতিক্রান্ত, নাটকের মাত্রা চরমে উঠেছে আজকাল। স্ত্রী-পালনের নুন্যতম শর্ত পালনে অক্ষম হলেও, স্বামীর দাবি আদায়ে আজকাল শুভ্র অত্যন্ত মরিয়া। জোর করেই স্কুটিতে চেপে বসে। ব্যাঙ্কে শত লোকের মাঝে লজ্জাজনক আচরন করতে থাকে। রাস্তায় যেখানে সেখানে হাত, ওড়না ধরে টানাটানি করা থেকে প্রায় সমস্ত কিছুই করে। ইতি যেন আজকাল কাঠের পুতুল।
কোন কিছুতেই তার কিছু এসে যায় না। শুধু তার পন, চাকুরি সে ছারবে না। কারন এটা কারো দয়ায় পাওয়া নয়। আর চাকরি ছেরে ঘরে একা থাকাটাই তার কাছে মৃত্যু স্বরূপ। ইদানিং অবশ্য সে একাকীত্ব কাটানোর জন্য জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা একাউন্ট ও খুলেছে। সেখানেই অনেক অপরিচিত ব্যাক্তিদের সাথে তার আলাপ ও সখ্যতা গড়ে উঠলো। একজন বিশেষ জনের সাথে, তার অদ্ভুত নামের জন্যই ইতির একটু কৌতূহল হয়। সেই সুত্র ধরেই পরিচয়, ও ঘনিষ্টতা, নিখাদ বন্ধুত্বের।
এখানেও বাড়াবাড়ি শুভ্রর নজরদারি শুরু হলো, এবং তার স্ত্রী কেন অন্যের সাথে কেন বন্ধুত্ব করবে! সেই স্বামীর অধিকার তুলে, পুনরায় জনসমক্ষে সেই একই ধরনের অশ্লীলতা। অবশেষে তিতিবিরক্ত হয়ে ইতি বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা রুজু করলো, বিবাহের বর্ষপূর্তির কয়েকদিনের মাথাতেই। কিন্তু শুভ্র নাছোড়বান্দা, বিবাহবিচ্ছেদ সে করবে না। সব সিদ্ধান্তটাই ইতিরানি পাল একা একাই নিয়েছিলেন। কিছুটা মানসিক সাহায্য অবশ্য তার সেই অদেখা বন্ধুটিও করেছিল। তবে তা নিতান্তই। মাঝে কোর্টে একদিন মামলার শুনানিও হয়ে গেছে।
এতো কিছু কথা অবশ্য সত্যরঞ্জন বাবু কিছুই খোঁজ রাখেননি। এরই মাঝে মদ্যপ শুভ্র আবার ক্রুর জানোয়ারের মত ইতির উপরে হামলা চালাল। একটা অ্যাসিডের বোতল ইতিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল ব্যাঙ্কথেকে দেরার পথে। ইতির সৌভাগ্য সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কিন্তু ইতির যেটা আজপর্যন্ত করে উঠতে পারেনি, এবার সেটাই করে ফেললো। ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহননের প্রচেষ্টা। আর সে নিতে পারছিল না, এই যন্ত্রনা। ইতি প্রানে বেঁচে গেলেও, বৃদ্ধ সত্যরঞ্জন আশক্ত শরীরে এই ধাক্কা সইতে না পেরে, পরলোকগমন করলেন। কোলকাতা মেডিকেল কলেজের ICU কোন একটা রুমে, ইতিরানী আজ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে চলেছে।
ওদিকে দুলাল ... পিতার মুখাগ্নি সেরেই, প্রতিবেশী জ্যেঠু সম্পর্কিয় একজনের সাথে হাসপাতাল, ইনস্যুরেন্সের অফিস, বাবার গচ্ছিত টাকার জন্য ব্যাঙ্কে... তার সাথেই পুলিশি জেরা। সমস্ত কিছুই একা হাতে সামলাচ্ছে... ওই অষ্টম শ্রেনিতে সবে উঠা দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস। যদিও কিশোর মনে সে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি, যে কেন তার পালক ‘মা’ মানে দিদির ডাক নাম “ফাউ”।
**************************************
(উন্মাদীয় বানানবিধী অনুসৃত)
+++++++++++++++++++++
No comments:
Post a Comment