Saturday, 3 November 2018

।। উন্মাদনামা ৩৩ ।।

হাড়ভাঙা ব্যাথা দারুন কষ্ট
উপশম তবু মেলে;
তার চেয়ে বড় আঘাত লাগে
পেট্রোল পাম্পে গেলে।
যখন দেখি ফ্লেক্সে ছাপা
গায়েতে জহর কোট,
মিত্রোঁ আছেন দাঁতক্যেলিয়ে
গুজরাতি মর্কট।।

Monday, 29 October 2018

।। একটি শীতকালীন ছ্যাঁচোড় ।।

হিম পরেছে উঠোন জুড়ে
শীতল আবেশ ছেয়ে,
ছুঁয়ে দেখ আমি আজও বেঁচে
তোর প্রেমে, ও মেয়ে।
তোর বক্ষ মাঝের উপত্যকায়
ছিল, অনুভুতির চাষ;
ও মেয়ে তুই নিড়েন দিলি
হল আমার সর্বনাশ।
কোমর বেয়ে নাভিপদ্ম,
যেথা সুখের বসবাস;
সেখানে আজ অনুপ্রবেশ
জবরদখল, খাস।
নিঃশ্বাস জুড়ে ছিলাম আমি
তোর শিক্ত ঠোঁটের খাঁজে;
অনিঃশেষ জিহ্বা বিলাস
বিনি সুতোর সাজে।
কাম রসেতে সাঁতার কেটে
রাত সাগরে পাড়ি,
সোহাগপুরের সাকিন ভুলে
কেমনে দিলি আড়ি?
ও মেয়ে তুই কই হারালি
কোন সে অন্ধ বাঁকে!
আলিঙ্গনে বাঁধব কারে
দুইটি বাহুর ফাঁকে?
কঠিন শৈত্য, আপন হারা
মৃত্যুময় এ বাঁচা,
গচ্চা যাবে বসন্তদিন
শূণ্য হৃদয় খাঁচা।
তোর, চোখের শাসন ফিরুক আবার
প্রখর গ্রীষ্ম বেয়ে!
চেনা ঘামের গন্ধ মেখে.....
শুনলি কি! ও মেয়ে?
________________
মিস্ত্রিঃ উন্মাদ হার্মাদ

Thursday, 25 October 2018

।। ...ও মেয়ে ।।

তোর সুখেতে মাতাল সুখী,
দুঃখে পাগলপারা;
তোর পিপাসায় চাতক আমি,
উন্মাদ তোকে ছাড়া।
প্রতীক্ষাতে ক্ষণযাপন, কখন-
প্রেমের ভেলা ভাসবে!
ও মেয়ে বল আমার মত
তোকে আর কে ভালবাসবে!
কে ভাঙাবে তোর অনুরাগ
কার ছোঁয়াতে জাগবি
ও মেয়ে তুই জীবনটা ভর
আমার সাথে থাকবি?
টক ঝাল মিঠে ঝগড়া মাখা
আদর পাবি সারাক্ষণ;
ও মেয়ে তুই খুঁজে পাবিনে
আমার মত আপনজন!
বন্ধু হয়ে থাকবি পাশে?
মানিয়ে নিবি সব ধারে?
ও মেয়ে তুই সব ভুলবি
যদি, আঁকড়ে ধরিস আমারে।

Sunday, 14 October 2018

।। ব্যতিক্রমী শারদ শুভেচ্ছা ।।

নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে এই পোষ্ট নয়। ছ্যাকা খাওয়ার পর হতভম্বতা কাটিয়ে উঠে খানিক বার্ণল লাগালাম নিজের ক্ষতস্থানে।.
বলা ভাল এটা ডিসক্লেইমার টাইপ।

 সকল বন্ধু ও সদস্যদের জন্য।

আমি আপনাদের কাছে বিনীত আবেদন/অনুরোধ করছি, আমার কোনো পোষ্টে, আমার কমেন্টের প্রত্তুতরে, আমার সাথে একসাথে মেনসন করে কাউকে ডাকার আগে, তাঁর থেকে অনুমতি নিয়ে নেবেন। তাঁর সাথে আপনার কোনো ক্ষার থাকলে বা বিশেষ সম্পর্ক (ঝগড়া বা ভালোবাসা যা ই হোকনা কেন) আমার পোষ্টে কাউকে 'মেনসন' করে কোনো পোষ্ট বা মন্তব্য করবেননা। কে কোথায় কার সাথে কি করে রেখেছেন সেটা আমি জানিনা, জানার আগ্রহও নেই (তর্কে গেলে জেনে নেবার সম্পূর্ণ অপশন খোলা রয়েছে)। কিন্তু সেটার দায় নিয়ে হলে খুব কষ্ট হয় বৈকি।
আমি চাইনা আমার জন্য কেউ অপ্রস্তুতে পড়ুক।
কারন কারোর চার পয়সা উপকার করতে পারিনি, অহেতুক ক্ষতিই বা কেন করব?
ফেসবুকে একই সাথে আমি সকলের কাছে ভালো থাকতে পারবনা, তাই বিগত ১০ বছরে আমার ঘোষিত শত্রুর সংখ্যা অনেকের বন্ধু চেয়ে বেশি। যাদের সাথে আপনাদের অনেকেরই যথেষ্ট দহরম মহরম, এতে আমার কোনো গাত্রদাহ নেই। কারন আমি যাকে ছুড়ে ফেলেছি জীবন থেকে, সেটা জেনে ছুঁড়েছি। লোম যতক্ষন শরীরে আছে, ততক্ষণই তাঁর পরিচর্যা, তাই ছুঁড়ে ফেলা মালগুলো অবাছিত লোক। কারোর থেকে ১ পয়সার হেল্প নিইনি, বা কে আমার কাছে বকেয়া কিছু রেখে যায়নি। আপনাদের কখনো কাউকে আমি কোনোদিনও মানা করিনি, যে ওর সাথে আমার এতো ঝামেলা- আপনি দয়াকরে মিসবেননা, - নাহ একটিবারও বলিনি। বলবও না। কারন আমার ঝগড়ার দায় আমার, আপনার নয়।
প্রত্যেকের নিজস্ব স্পেস, ভাবধারা, ও মতামত আছে। যেটা আমি অত্যন্ত সম্মান করি।
আমি ফেসবুককে যথেষ্ট সিরিয়াসলিই নিই, এখানে বন্ধু পেয়েছি, প্রেম করেছি, ঝগড়া করেছি, ব্যাবসা পেয়েছি, ইনভেষ্টর পেয়েছি, সব সব সব পেয়েছি। মজা আর আড্ডাই হচ্ছে এর ধারক, মজা বা হালকা চটুলতা গুলো বাদ দিলে জীবন পানশে এটা আমি মানি ও জানি। বন্ধুদের কাছে আমার সকল কিছু ওপেন। নিজের মত চাপিয়েও দিইনা, অন্যের মতকেও গিলে নিইনা।
এরও পর যদি কেউ কিছু কমেন্ট , পোষ্ট করেন তার দায় সম্পূর্ণ যিনি যিনি লিখছেন তাঁর। আমার মেনশন কৃত সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির নয়। তারও পরে যদি কিছু অসঙ্গতি হয়- তখন পুরাতন ফর্মে ফিরে BAD BOY হয়ে "তুমি আমি এক দেহে লীন' ভেবে নিয়ে চোখ বুজে 'তুমি' সেজে যাওয়া কিছুক্ষণের জন্য। তারপর? ব্রহ্মা জানে গোপন কম্মটি।
যারা ২০১৫ সাল ও তার আগের উন্মাদকে দেখেননি, তারা দয়া করে এই পোষ্ট পড়বেননা। এটা আপনার কমেন্টের উপযোগী নয়, এবং আপনি মিসিং লিঙ্ক গুলোর সন্ধান জানেননা। জাষ্ট এটাকে ইগনোর করুন।
এই পোষ্ট যিনি সিরিয়াসলি নেবেন, তাঁর জন্য সিরিয়াস, মজা ভাবলে মজা। কারন স্পষ্ট কথাতে আমার কোনো কষ্ট নেই।
আমি পৃথিবীতে সকলের কাছে ভাল হতে পারবনা, ইচ্ছা ও ক্ষমতা কোনোটাই নেই। যার কাছে আমি ঋণী তাঁর/ তাঁদের ছাড়া বাকিদের নিয়ে আমার এতটুকু আগ্রহ নেই, এক্সট্রা মান ইজ্জতেরও স্টক নেই। 'বন্ধু'দের কাছে আমার জীবন উতসর্গীত, এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জ্ঞানত জুতোজোড়া বয়ে দেব, এমন মানসিকতা যুক্ত। যেটা কখনই বদলাবেনা, মস্তিষ্কে আঘাত পেয়ে স্মৃতি (ইরানি নয়) না হারালে।
প্রসঙ্গ অকপটঃ এখানে কেউ যখন থাকেন, সেটা সম্পূর্ণ তাঁর ইচ্ছাতেই থাকেন। এখানেও কোনো জোর নেই। অকপটে থাকাটা আমার দুর্বলতাও নয়, শক্তিও নয়। এটা আমার প্যাশনের জাইগা, এখানে টাকা ও সময় উভয়ই খরচা করি অকাতরে। এর পরেও অকপট পার্ট অফ লাইফ ভায়া ফেসবুক, হার্ট অফ লাইফ নয়। কাল অকপট না থাকলেও আমি ও আপনি থাকব। সুস্থ সম্পর্কটা টিকে যাবে আজীবন।
ছোট পরামর্শঃ মজা ততটাই করুন, যতটা আপনি নিজে নিতে সক্ষম।
উপসংহারঃ আমার যাবতীয় সকল ভাল কিছুর দায় বা কৃতিত্ব যেমন আমার, তেমনই আমার খিস্তি, দুর্ব্যবহার, অসামাজিকতা, মাগিবাজি, এক্সট্রা গাড়পেয়াজি, ক্যালোয়াতি, সবজান্তা গেঞ্জিওয়ালাভাব, অন্যের পিছনে কাঠিবাজি, ফাঁপা ডায়লোগবাজি, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সহ যাবতীয় খারাপ কিছুরও সমস্ত দায়ভার আমার একান্ত নিজস্ব। কেউ এর জন্য দায়ী নেই, বা দায় নিয়ে হয়না। বিগত দিকে কাউকে নিতে হয়নি, আগামীতেও কাউকে নিতে হবেনা।
ধন্যবাদ।
শারদীয়ার শুভেচ্ছা।

Wednesday, 10 October 2018

।। দুর্গাপূজা ।।





শ্রী শ্রী চন্ডি গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের কাহিনী অনুসারে:- প্রলয়কালে পৃথিবী একবিরাট কারণ–সমুদ্রে পরিণত হলে শ্রীবিষ্ণু সেই সমুদ্রের উপর অনন্তনাগকে শয্যা করেযোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন। এই সময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্যে নির্গত হয়ে বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হল। ভীত হয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্য তাঁর নয়নাশ্রিতা যোগনিদ্রাকে স্তব করতে লাগলেন। সন্তুষ্ট হয়ে দেবী শ্রীবিষ্ণুকে জাগরিত করলে তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সাথে মহাযুদ্ধে রত হলেন। পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষর সন্ধক্ষিণ হচ্ছে মহালয়া৷ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ শুরু হয়ে পরর্বতী অমাবস্যা র্পযন্ত সময়কে দেবীপক্ষ বল৷ পুরাণ মতে ব্রহ্মার নির্দেশে পিতৃপুরুষরা এই ১৫ দিন মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসনে৷ তাই এই সময় তাঁদরে উদ্দেশ্যে কিছু র্অপণ করা হলে তা সহজেই তাদের কাছে পৌছায়। তাই গোটা পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষদেব স্মরণ ও মননের মাধ্যমে র্তপণ করা হয়৷ যার চূড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হল এই মহালয়া৷
অনেকেই এই দিনটিকে দেবীপক্ষের সূচনা বলে থাকেন। যদিও এটি একটি জনপ্রিয় ভ্রান্ত ধারণা৷ মহালয়া পিতৃপক্ষরে শেষ দিন৷ পরের দিন শুক্লা প্রতিপদে দেবীপক্ষের সূচনা হয়৷ সেই দিন থেকে কোজাগরী পুর্ণিমা পর্যন্ত ১৫ দিনিই হল দেবীপক্ষ৷
মহালয়া শব্দরে র্অথ অনুসন্ধান করলে দখো যাবে মহান+আলয় =মহালয়৷ সঙ্গে স্ত্রীকারাত্মক আযুক্ত হয়ছে, আবার মহ শব্দের র্অথে পায় পুজা এবং উত্সব৷ অর্থাৎ মহালয়া একটি র্অথে দাঁড়ায় পুজা বা উত্সবের আলয়৷ অন্যদিকে, মহালয়া বলতে পিতৃলোককে বোঝায়৷ যখন, বিদেহী পিতৃপুরুষ অবস্থান করেন৷ সেক্ষত্রে পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানই মহালয়া৷ এই দিনটিকে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার পরম লগ্ন বলে মনে করা হয়৷
মহালয়ার মূল মন্ত্রের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে তারমধ্যে এক বিশ্বজনীন চেতনা লক্ষ্যকরা যাবে, সেখানে বলা হচ্ছে, “ময়া দত্তনে তোয়নে তৃপ্যান্ত ভুবনত্রয়ম”৷ অর্থাৎ র্স্বগ, র্মত, পাতাল এই তিন ভুবনকে এই মন্ত্রর মাধ্যমে স্মরণ করা হয়৷ এই মন্ত্রোচ্চারণ করে তিন গণ্ডুষ জল অঞ্জলি দেওয়াই রীতি। এর মাধ্যমে বিদেহী পিতৃপুরুষ ও তাঁদরে র্পূবপুরুষকে স্মরণ করা হয়৷ এখানে কোনও জাতপাত বা শ্রেনীবৈষম্য নেই। আত্মীয়– অনাত্মীয় ভেদ নেই৷ হিন্দু অহিন্দু দ্বন্দ্ব নেই৷ দেশ–কালের সীমা নেই৷ আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্ত জগত তৃপ্যতু৷ এই মন্ত্র উচ্চারন করলে ব্রহ্ম থেকে পদতলে তৃণ র্পযন্ত সকলরে উদ্দেশ্যে র্তপণ করা হয়৷ মহালয়ার এই র্তপণ ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম ঐতহ্যি, যা র্সবজনীন তথা বশ্বিজনীন চেতনা থেকে উদ্ভূত।
মহালয়ার আগের পনেরটি তিথী হলো - প্রতিপদ, দ্বীতিয়া, তৃতীয়া, চতুর্থা, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়দশী, চতুর্দশী, ও অমাবশ্যা।
মহালয়ার দিন মা দূর্গা সন্তানাদি,সখী জয়া ও বিজয়াকে নিয়ে দলবলসহ পৃথিবীতে আগমন করেন। এইদিন চন্ডীপাঠ করে মা দূর্গাকে আমন্ত্রন জানানো হয়।
সনাতন হিন্দু সমাজের বেশীরভাগ বাড়িতে ঘট,ফুল, জল,নৈবদ্য সহকারে মা কে আমন্ত্রন জানানো ভক্তি এবং সাথে আলপনা এঁকে মায়ের ধরনীতে ও গৃহে আসার পথকে শোভনীয় করতে শিল্পমনের পরিচয় বহন করেন।

পুরাণ মতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তে তিনি এই পূজার আয়োজন করায় দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী পূজাও বলা হয়। কিন্তু রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে যাওয়ার আগে শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। অকালে তথা শরৎকালে অনুষ্ঠিত হওয়া এই পূজা তখন থেকেই অকালবোধন নামে পরিচিত ।
স্কন্দপুরান বর্ননা অনুসারে রুরু দৈত্যর পুত্র দূর্গকে বধ করেছিলেন বলেই পার্বতীর নাম হয়েছে দেবীদূর্গা। তবে বাঙ্গালীর দূর্গোৎসবে দেবী কিন্তু স্কন্দপুরানের বর্ননামতে দূর্গাসুর বধকারী রুপে তিনি পূজিত নন। এখানে তিনি পূজিত হন মহিষাসুর মর্দিনী রুপে। দেবী দূর্গার এই আবির্ভাবের পরিচয় পাওয়া যায় মার্কন্ডেয় পুরানে। ভাগবত পুরান অনুসারে ব্রম্মার মানস পুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ক্ষীরোদ সাগরের তীরে মৃম্ময়ী মুর্তি নির্মান করে দেবী দূর্গার আরাধনা করেন। মার্কন্ডেয় পুরান মতানুসারে এই দুগোৎসবের আয়োজন করেন রাজা সুরথ। আর রাজা সুরথ এই দূর্গাপূজা করেছিলেন বসন্তকালে।
“যা চন্ডি মধুকৈটভারী, দৈত্য দলনী, যা মহিষমর্দিনী, যা দূর্গে চন্ড মুন্ডোমালিনী, যা রক্ত বিজশ্বরী, শক্তি সুন্দরী সুন্দর দৈত দলনী—যা—“। আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেঁজে উঠেছে আলোক মঞ্জিল, ধরনীর বর্হিআকাশে–অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তর আকাশে জাগরিত জোর্তিময়ী জগৎমাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদ্ধধ্বনি অসিম ছন্দে বেজে ঊঠে রুপলোক ও রশলোকে আনে নবভাব মাধুরীর সঞ্জিবন, ত্রাহি আনান নন্দিতা শামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে–মৃন্ময়ীকে আবাহন। আজ শক্তিরুপীনি বিশ্বজননীর শারদও শ্রীমন্ডিত প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানগ্রহিতা।
কথিত রয়েছে মহালয়ার দিন ঘট বসে। সেদিন থেকেই নিয়মিত ঘট পুজো করা হয়। মহাষষ্ঠীর দিন মায়ের বোধন হয়। সেদিনই বোধনের ঘট বসে। মহাসপ্তমীর দিন নিয়ম মেনেই কলাবউ স্নান ও পুজোর অন্য আচার পালন করা হয়। মহাষ্টমীতে পুজোর পাশাপাশি সন্ধিপুজোরও আয়োজন করা হয়। তন্ত্রমতেই করা হয় সন্ধিপুজো। নিয়মমেনে ১০৮ প্রদীপ ও পদ্ম দেওয়া হয়। হোম ও যজ্ঞ করা হয় নবমীতেও। দশমীর দিনই প্রতিবার নিয়ম মেনে বিসর্জন দেওয়া হয়।
উপমহাদেশে জমিদারী প্রথা বিলোপের পর শারদীয় দূর্গপূজায় জমিদারদের অংশ গ্রহন স্বাভাবিক ভাবেই অনেকটা কমে যায়। নব্য ধনীক শ্রেনীর উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিতে দূগোৎসব আয়োজক কমিটিতে যুক্ত হয় অনেক নতুন নতুন মূখ। তবে প্রতিটি দুর্গোৎসবই তখনকার সময় আয়োজিত হত সম্পূর্ন একক উদ্যোগে। আনুমানিক ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় ঘটে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
গুপ্তিপাড়ার একটি ধনী পরিবারের আকস্মিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে অনিশ্চয়তার সন্মূখীন হয় ঐ বাড়ীটির বাৎষরিক দূর্গাপূজার আয়োজন। তখন গুপ্তিপাড়ায়ার ১২ জন বন্ধু মহলের যুবক এগিয়ে আসেন যৌথ উদ্যোগে দূর্গাপূজা পালন করার জন্য। এই ১২ জন ইয়ার বা বন্ধু সংঘবদ্ধভাবে গ্রহন করে পূজা পালনের সার্বিক দায়িত্ব। আর গুপ্তিপাড়ার এই পূজাটি মানুষের কাছে পরিচিত হয় “বারোইয়ারী” বা বারোয়ারী পূজা নামে। এই বারোয়ারী পূজার সুত্র ধরে একক উদ্যোগে সম্পাদিত দুর্গাপূজাই আজ পরিনত হল সার্বজনীন শারদীয় উৎসবে। ধনীর আঙ্গিনা থেকে দূর্গাপূজা নেমে এলো অনেকটা সাধারন মানুষের সাধ্যের মাঝে। গুপ্তিপাড়ার আদর্শ অনুসরন করে সম্মিলিত উদ্যোগে বারোয়ারী পূজা ছড়িয়ে পড়ল ভারতীয় উপমহাদেশসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের এই নৈকট্য সাধারন মানুষকে সাহস জোগালো র্দূগাপূজা মতো সর্ববৃহৎ ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্টানে বিত্তশালীদের একচেটিয়ে অধিকারে ভাগ বসানোর। ব্যক্তি বা বারোয়ারীর সীমা ছাড়িয়ে দূর্গাপূজা আজ পরিনত হল সার্বজনীন শারদীয় উৎসবে।
উরিষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দূর্গা পূজা হয়ে আসছে। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মউৎসাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে একই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী পুজার আয়োজন করে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দূর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী বা কমিউনিটি পূজা হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পূজা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।

ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা) দেবীমাতা, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দূর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী সে হিসাবে অথবা দেবী মাতা হিসাবে পূজা হতে পারে। তবে কৃত্তিবাসের রামায়নে আছে, শ্রী রাম চন্দ্র কালিদহ সাগর (বগুড়ার) থেকে ১০১ টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে সাগর কূলে বসে বসন্তকালে সীতা উদ্ধারের জন্য সর্বপ্রথম শক্তি তথা দুর্গোৎসবের (বাসন্তি পূজা বা অকাল বোধন) আয়োজন করেছিলেন। মারকেন্দীয়া পুরান মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা খ্রীষ্ট্রের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে উরিষ্যা) নামে দূর্গা পুজা প্রচলন করেছিল। যদিও প্রাচীন উরিষ্যার সাথে নেপালের পূজার কোন যোগসূত্র আছে কিনা জানা নাই।
ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায় মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দূর্গা পূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১১শ শতকে অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে দূর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বঙ্গে ১৪শ শতকে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল কিনা ভালভাবে জানা যায় না। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৭৯০ সালের দিকে এই পূজার আমেজে আকৃষ্ট হয়ে পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তি পাড়াতে বার জন বন্ধু মিলে টাকা পয়সা (চাঁদা) তুলে প্রথম সার্বজনীন ভাবে আয়োজন করে বড় আকারে দূর্গা উৎসব। যা বারোইয়ার বা বারবন্ধুর পূজা নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
দেবী দূর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অনান্য দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দূর্গা ‘দূর্গতিনাশিনী’ বা সকল দুঃখ দুর্দশার বিনাশকারিনী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর’র শরীর থেকে আগুনের মত তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোক পূঞ্জে পরিণত হয়। ঐ আলোক পুঞ্জ থেকে আর্বিভূত এক দেবী মূর্তি। এই দেবীই হলেন দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যাশক্তি মহামায়া অসুর কুলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে শান্তি স্থাপন করেন।
দেবী দূর্গা ত্রি-নয়না বলে তাঁকে ‘ত্রৈম্বক্যে’ বলা হয়। তাঁর বাম চোখ হলো বাসনা (চন্দ্র), ডান চোখ কর্ম (সূর্য) ও কেন্দ্রীয় চোখ হলো জ্ঞান (অগ্নি)। দূর্গার দশ বাহুতে যে দশটি অস্ত্র রয়েছে, সেই অস্ত্রসমূহও বিভিন্ন প্রতীকের ইঙ্গিতবাহী। শঙ্খ ‘প্রণব’ বা ওঙ্কার ধ্বনির অর্থবহতা নির্দেশ করে। তীর ধনুক দেবীর শক্তিমত্তার প্রতীক। মায়ের হস্তে ধৃত বজ্রাগ্নি হলো ভক্তের সঙ্কল্পের দৃঢ়তা। দূর্গা’র হাতের পদ্ম বা ‘পঙ্কজ’ অর্থ হলো পদ্ম যেমন কাদামাটির ভেতর হতে অনাবিল হয়ে ফোটে, তেমনি দেবীর উপাসকরাও যেন লোভ-লালসার জাগতিক কাদার ভেতর হতে আত্মার বিকাশ ঘটাতে পারে। দেবীর তর্জনীতে ধরা সুদর্শন চক্র তাঁর শুভতার লালন ও অশুভের বিনাশের ইচ্ছার প্রকাশ। দূর্গার হাতে ধরা তলোয়ার জ্ঞানের ইঙ্গিত ও ত্রিশুল হলো সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের প্রকাশ। হিন্দু শাস্ত্র মতে, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
নেউর ও ধেঙুড় ছিলেন দুই ভাই ও তারা কর্মসূত্রে ছিলেন তান্ত্রিক। আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দকালে তাঁরা খড়দহের শ্মশান ঘাটে তন্ত্র সাধনা করতে আসতেন। পণ্ডিত কামদেব যিনি ছিলেন রাধাকান্ত মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর একদিন গঙ্গাস্নান করতে এসে এদের দুজনের সাথে পরিচয় হয়। তারপর তিনি তাদের সেই রাধাকান্ত মন্দির দর্শন করাতে নিয়ে যান। কিছু সময়ের আলাপ আলোচনার পর পণ্ডিত কামদেব দুই ভাই কে খড়দহে বসবাসের জন্যে অনুরোধ করেন আর একই সাথে অনুরোধ করেন রাধাকান্তের সেবার জন্যে। বিনা পয়সা তে জমি নেবেন না বোলে মোট একুশ গণ্ডা কড়ি দিয়া খড়দহের একটি জায়গা কেনেন যা আজ ভট্টাচার্য পাড়া নামে খ্যাত। তারপর ওনারা সেখানে বসবাস শুরু করেন।
কিছুদিন পর হঠাৎ নেউর স্বপ্নাদেশ পান খড়দহের কোন অরণ্যে এক সাধকের কাছে যাওয়ার। সেখানে সেই দুই ভাই যান ও সত্যিই সেখানে সেই সাধকের দেখা পান। সেই সাধক তাদের একটি শিবলিঙ্গ দেন এবং সেটিকে তাদের গৃহে প্রতিষ্ঠা করার অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধে প্রতিষ্ঠিত হয় সেই শিবলিঙ্গ। সেই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠানের ৩ বছরের মধ্যেই শুরু হয়ে দেবী দুর্গার পূজা। এই পূজা নেউর ও ধেঙুড় নিজেরাই মন্ত্র পাঠ করে করতেন এবং এই পুজ হত এবং আজও হয়ে আসছে 'তান্ত্রিক মতে'। এবং এই দুর্গাপূজাটি হল ২৪ পরগণার সবচেয়ে পুরানো পূজা। এই পূজাতে আগে মহিষ বলি হত। তারপর নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর অষ্টম গর্ভের সন্তান বীরচন্দ্রের অনুরোধে তা বন্ধ করা হয় এবং তার পরিবর্তে ফল বলি শুরু হয়।
◘ পূজার বৈশিষ্ট্য –
ক) কলাবৌ কে গঙ্গাজলে স্নান কোরানোর পরিবর্তে ১০৮ টি ঘটের জলে স্নান করানো হয় এবং এই ১০৮ টি ঘটে ১০৮ রকমের জল থাকে।
খ) এই পূজাতে আগে মহিষ বলি হত। তারপর নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর অষ্টম গর্ভের সন্তান বীরচন্দ্রের অনুরধে তা বন্ধ করা হয়ে এবং তার পরিবর্তে ফল বলি শুরু হয়।
গ) বীরচন্দ্র গোস্বামীর কথায় দেবী দুর্গার পূজার সময়ে শ্রী শ্রী গোপাল ও নারায়ণ এর ও পুজ হয়।
ঘ) সন্ধিপুজার সময়ে দেবীর ভোগ হিসাবে এঁচোর দাওয়া হয়।
মহাষষ্ঠীর দিন প্রতিমাকে লুচি ও বিভিন্ন নিরামিষ তরকারি ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। ওইদিন বাড়ির মায়েরা উপবাস করেন। মহাসপ্তমীর দিন থাকে খিচুড়ি ভোগ। সঙ্গে থাকে বেগুনি, লাবড়া, আলুর দম, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি ও তিন রকমের মিষ্টি। মহাষ্টমীর দিন থাকে লুচি ভোগ। সঙ্গে ধোকার ডালনা, ছোলার ডাল, কুমড়ো-আলুর ছক্কা, চাটনি ও তিন রকমের মিষ্টি। নবমীর দিন মাকে পুষ্পান্ন (বৈষ্ণব মতে পোলাওকে পুষ্পান্ন বলা হয়) এছাড়া পনিরের পকোড়া ও তরকারি, আলুর দম, ছানার ডালনা, চাটনি ও তিন রকমের মিষ্টি দেওয়া হয়।
সনাতন ধর্ম বিশ্বাস করে, “মানুষের দেহ পাঁচটি উপাদান দিয়ে তৈরি”। যথা: আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি। তাই মৃত্যুর পর এই দেহ আগুনে দাহ করা হয় অথবা মাটি দেওয়া হয়। অর্থাৎ যে উপাদান দিয়ে এই দেহ তৈরি, মৃত্যুর পর আবার সেই একই উপাদানে মিশে যায়।
তেমনি প্রতিমার ক্ষেত্রেও তাই, তা মাটি দিয়ে তৈরি। মাটির প্রাণহীন মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলে সেটি প্রতিমা হয়। আর পূজা শেষে দেবীকে বিদায়ের পর সেই প্রতিমাটি আবার প্রাণহীন মূর্তি হয়ে যায়। আর তাই তাকে আবার পঞ্চতত্ত্বের একটি, সেই জলেই বিসর্জন দেওয়া হয়।
এই প্রতিমা পূজার সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে বিসর্জন। জলের মাধ্যমেই যেন মাটির প্রতিমা পুনরায় প্রকৃতিতে মিশে যায়, সেই জন্যই আমরা গঙ্গার জলে প্রতিমা বিসর্জন দেই। আমাদের হৃদয়ে যে নিরাকার ঈশ্বর রয়েছে, উপসনার জন্য মাটির প্রতিমা তৈরি করে তাকে “সাকার রূপ”দেওয়া হয়।
পূজা শেষে পুনরায় সেই “সাকার রূপ”কে বিসর্জন দিয়ে নিরাকার ঈশ্বরকে হৃদয়ে স্থান দেওয়া হয়। সেই কারণেই দুর্গা পূজার সময় যখন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় তখন মায়ের প্রতি আমাদের প্রার্থনা থাকে, “মা, তুমি আবার এসো আমাদের মাঝে।
যে জন্ম নিয়েছে, তার মৃত্যু অনিবার্য ৷ এটাই প্রকৃতির শাশ্বত নিয়ম ৷ ঠিক তেমনি যাকে আবাহন করা হয়, তার বিসর্জনও অনিবার্য ৷ বিসর্জনের মাধ্যমেই “পুনরায় আগমনের” আশা সঞ্চারিত হয় ৷ এটিই প্রতিমা পূজা ও প্রতিমা বিসর্জনের মূল তাৎপর্য।
___________
সংকলনঃ উন্মাদ হার্মাদ
তথ্যঃ ইন্টারনেট

Sunday, 30 September 2018

।। মিশ্র আদালত ।।




সর্বোচ্চ আদালত, তথা দীপক মিশ্র মোদীকে বাঁচতে একের পর এক কন্ট্রোভার্সি রায় দিয়ে যাচ্ছে।
আপনি আমি খেটে খাওয়া মানুষ, কে পোঁদ মারবে আইনত, কে বৌদির ঝাঁপ খুলবে আইনকে সাথে নিয়ে, মুসলমানেরা কোথায় নামাজ পড়বে, হিন্দুরা কোথায় মন্দির বানাবে, খ্রীষ্টানেরা কি খাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি
সত্যিকরে বলুনতো, এ সবে আপনার কিচ্ছু যায় আসে? এগুলো হবার দরুন আপনার কিছু সুরাহা হয়েছে দৈনন্দিনের আগুনে ঘর খরচাতে? প্রেট্রোপন্য থেকে রুপির দাম, বেনিয়া চোরের কোনো ভ্রুক্ষেপ আছে? চোর গান্ডূটা আজ গান্ধী মুর্তির গলাতে মালা পরাচ্ছে, গত চার বছরে RSS দেশদ্রোহী নাত্থুরাম গডসের মুর্তিতে মালা পড়িয়ে এসেছে।
মুখ থেকে মুখোশ খসে পরেছে। তাই তো আজ সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নামের একটা বুদ্বুদের ছায়াতে নিজেকে বাঁচাতে চাইছে।
যেমন গোটা বিজেপি দলটা রবার্ট ভাদ্রা নামের একটা নামের আড়ালে লুকিয়ে পরতে চাইছে। কারন? কারন চুরি ধরা পরে গেছে, আর অজুহাত দেবার মত কিছু বেঁচে নেই।
সীমাহীন দুর্নীতি আর হিমালয় সম মিথ্যার পর্বতের নিচে চাপা পড়ে আছে একটা ধর্মীয় উগ্রবাদী সঙ্ঘ। এর পরেও মানুষকে বোকাচোদা ভাবছে!!
ঠিক এখনই কেন এই রায় গুলো? যাতে মানুষ বাকি সব সমস্যা ভুলে থাকে, থাকছেও।
এই সেই দীপক মিশ্র, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির চরম অভিযোগ এনেছিল পাঁচ বিচারক।
এর পর খুব শিজ্ঞির "যুদ্ধ যুদ্ধ" ভাব বাজারে চলে আসবে। এখন যুদ্ধ পুজোর প্যান্ডেল গড়া চলছে।
দেশপ্রেমের রজঃস্রাবে ভক্তরা রমন খুঁজে পাবে।
বুঝে পাইনা কজন ভক্ত বা নাগপুরী বলদ/মর্কট সেনাতে আছে? এরা তো ভাবে সেনা বোধহয় এদের বাপের সম্পত্তি। হতেই পারে সেনাদের বাপেরা এদের মায়ের ঘরে এসেছিল।
বাজারে "যুদ্ধ" এলো বলে, অপেক্ষায় থাকুন।
কিন্তু- এবারে ঘুঘু তোমার বাঁচার চান্স নাই-
"খোদা পাহাড়, নিকলা খটমল, চোর"

Friday, 24 August 2018

।। মর্ডান আর্ট ।।


এটা একটা ওয়ারা মার্কা টপিক, কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য। ছবি দেখে কেউ দেওয়ালে বীর্যপাত করিবেননা, ইহা সংরক্ষিত অঞ্চল। দুর্বলচিত্তের মানুষেরা অন্য আরো বন্ধুদের ৩৩৩ টা পোষ্টে চলে যান।


মর্ডান তো ছেড়েই দিন, হেরিটেজ আর্ট বলুন বা এপিক কিছু-
আর্টের 'আ' তে আমি পাক্কা আবাল, এবং এ রোগ জন্মগত।
তবে হ্যাঁ, পিসির ছবিতে ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্রটা বুঝেছিলাম কারো সাহায্য ছাড়াই।
বাকি সবই ছবি বা আর্ট আমার কাছে একই লাগে, যেমন মোনালিসা পেইন্টে আজও আমি খুঁজি- ওতে আছেটা কি?
তবুও ঠিকিই ছিল এ পর্যন্ত, শুভাপ্রশন্নের কাক দেখে কয়েকবার আমি মাথা আর অণ্ডকোষ একই সাথে সমান তেজে চুলকে নুনছাল তুলে বিপ্লবও করেছি এক কালে। আজ ন্যাতানো যৌবনে বিপ্লব পুরো অনুপম খেরের মাথা, এক খেই ও বাল নেই।
এক ঢোক জল খেয়ে নিই দাঁড়ান। যদিও এই মধ্যরাত্রে পিসির জামানাতে মাল না খেলে নিজেকে তৃনমুলিই মনে হয়না, যাকগে সে অন্য কথা।
কিন্তু এর পরে ভুদ্ধিজীভীরা কহিবেন- ফ্রান্স- ডট ডট ডট এন্ড এটসেট্রা এটসেটরা.....
জানি বাবা জানি, অজান্তা-ইলোরার গুহাচিত্র বা প্রাচীন ভারতে কতশত স্থানেই নাকি মৈথুনরত যুগলের খোদিত মুর্তি আছে- তা বলে তো আর কেউ সেখানে ন্যাংটা হয়েও ঘোরেনা, আবার প্রকাশ্যে লাগায় ও না। ও সকল কিছু একটু লজ্জা লজ্জা হয়ে, ঘেরা অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানের করা ভাল। মুড বলেও তো একটা ব্যাপার আছে- না কি!
আমি বাপু মানুষের পরিশ্রমই দেখি ওতে মানে ওই স্থাপত্যে, যেহেতু শিল্প বুঝিনা তাই হাতে রইল শুধু একটা ধর্ষকামী চোখ ও খেঁচুরে মানসিকতা। পানু সিনেমাতেই শরীর গরম হয়না তো ওতে হবে এমন বালখিল্য বাল ওঠার আগেও করিনি কোনোদিন। তাই স্বমেহনে ছিটকিনি।
পুরুষের জীবন কি কেবল মেয়েদের দুই পায়ের ফাঁকে আবর্তীত হয়? কার হয় জানিনা, আমার অন্তত নয়। ওটা পার্ট ওফ লাইফ এন্ড আর্ট অফ লাইফ। একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বাজারে ঘণ্টা মুল্যে পায়ের ফাঁক বিক্রি হয় ৫ মিনিটের জন্য।
বাকি রইল বুক। এ ভাই, দুধ বা ভদ্রভাষাতে স্তন- এটাকে যৌনাঙ্গ হিসাবে না দেখে আমি বাচ্চাদের খাবারের আধার হিসাবেই দেশি দেখি, তা বলে আমি ঋতুপর্ণ নই। ফোরপ্লে ওটা ছাড়া হয়না। আমি স্ট্রেট সেক্সের কথা বললাম, যারা হোমো বা লেসবো, তারা এডিট করে নিয়েন নিজ গুণে।
এবার বিষয়ে আসি, এলোমেলো ভনিতা অনেকটা করে ফেলেছি, অবশ্য এভাবে ছড়ানোটা আমার বদ অভ্যাসের গুণ। তার উপরে নারী শরীর-
বং ক্রাশের পেজে ছবিটা পেলাম। কেন এঁকেছে এ ছবি জানিনা, কে এঁকেছে লেখা আছে। আগেই বলেছি আর্টের বিন্দুবিসর্গ বুঝিনা। কার উপকার হবে সেটাও জানিনা, কার ক্ষতি হবে সেটাও অজানা। শিল্পীর কতটা অর্গাজম ঝড়েছিল সেটাও অজানা। তাই X=প্রেম ধরে এগোলাম।
আমি গরীব বাঙালী, বোধ জ্ঞানগম্ম্যি সামান্যের চেয়েও কিছুটা কম, খেটে খাই, মুনিষ গিরি করে। স্বাভাবিক নারী শরীরে আকর্ষন আর পাঁচটা সুস্থ সমর্থ পুরুষের মতই- তবুও মন অস্থির হচ্ছে-
জানিনা কেউ প্রশ্ন তুলবে কিনা- এই প্রদর্শিত শরীরটার জাত কি? মেয়েটা বাপের খেয়ে গোল্লাই গিয়ে ন্যাংটা হয়ে পোজ দিয়েছে? না কি পেটের দায়ে সমাজের গভীর অসুখ ঢাকতে সেবিকার ভুমিকাতে অবতীর্ণ।
কেউ কি মেয়েটির চোখের মায়া, গায়ের রঙ দেখবে? মাথার সুদৃশ্য টোপরটি? সুতনু কটিদেশ?
কিন্তু লম্বা চুল অন্যত্র ভাল্লাগলে এখানে বেশ বিরক্তই লাগবে আশঙ্কা রাখি।
নাহ, চোখ আঁটকে বুকে আর পদের বিভাজিকাতে।
এ ছবি তোলার জন্য, কেউ কেউ তো শিল্পীর মা বোন করছে, আবার কেউ শীল্পিকে মানে ফোটোগ্রাফারকে প্রশংসাতে চান করিয়ে দিচ্ছে।
১) এই ছবিটাতে ভাল কি আছে?
২) এই ছবিটাতে খারাপই বা কি আছে?
কোনো কিছুই তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা, এর চেয়েও অনেক বেশি আজকালের হিন্দি সিনেমাতে দেখা যায়। অবশ্য আমাদের সব বিষয়টা তো এমন লুকোচুরির খেলা।
পরেশ অধিকারী কেন তৃণমূলে এসেছে, তার মেয়ের উন্নতিতে জানা গেল, সিরিয়াল ধর্মঘটও শেষ হল, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পড়ে রুপা গাঙ্গুলি অস্থিভষ্ম নিয়ে নৃত্যাঙ্গাদাও হয়ে দেখালেন, কিন্তু এটা বুঝলামনা মোটে-
যদিও সব জানতেই হবে এমন দিব্যি মোদীজির জামানাতে কেউ দেয়নি-
তবুও প্রশ্ন একটা রয়েই যায়-
আর সেটা হল-
______________________________
শেষ কথাঃ এদের দাবিটা কি ওয়ারা?
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°

Monday, 6 August 2018

।। উন্মাদীয় বন্ধুত্বঃ সেকাল ও একাল ।।




যখন কোনো কারন ছাড়াই বন্ধুত্বটা এক লহমাতে হয়ে যেত, তখন বুঝতামনা বন্ধুদিবস কাকে বলে, বা কোনোদিন বোঝার দরকারও পরেনি। মনে আছে, নার্সারিতে দ্বিতীয় বেঞ্চের কর্ণারে বসে খুব কেঁদেছিলাম প্রথমদিন। একটা ছেলে আমার পাশেই বসা, সেও আমারই সাথে তারস্বরে কেঁদে চলছিল; কিন্তু এরই ফাঁকে আমাকে তার টিফিন থেকে একটা ক্রিম বিস্কুট এগিয়ে দিতেই আমরা বন্ধু হয়ে গেছিলাম অজান্তেই। তার নাম শুভেন্দু, পরবর্তীতে আজ ৩০ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, সময় আমাদের অদৃষ্টের লিখন অনুযায়ী ভিন্নমুখী গন্তব্যে নিয়ে চলেছে। নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ তো দূরস্থান, নিয়মিত ফোনটুকু পর্যন্ত হয়ে উঠেনা। কিন্তু দেখা মাত্রই- “বুকে আয় ভাই” বলে শুরু, তার পর নিজেদের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ চালু হয়ে যায়। তাই বন্ধুর কথা মনে এলে সবার প্রথমেই যে নামটা মগজে ভেসে উঠে, সে নাম শুভেন্দু’ই।

তখন বন্ধুত্বটা একটা লজেন্স (চকোলেট নয়) দু’ভাগ করে খেতেখেতেই হয়ে যেত, বা স্যারের পানিশমেন্টে রোদে নিলডাউনের সাথী হয়ে। আর সেই চুক্তিপত্রটা থাকত ডানহাতের বুড়ো আঙুলের ছোঁয়াতে। কড়ে আঙুলের ডগে আড়িটা থাকলেও, সেটা ভুলে যাবার জন্য আলাদা কোনো কারন লাগতনা। শিশু বয়সে আমরা সর্বজ্ঞ থাকিনা, তাই অহং বোধটাও জন্মায়না, যেটা বন্ধুত্বের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা। সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে রাত টুকুর বিরাম, পরদিন আবার সেই বন্ধুদের সাথে হৈহৈ চৈচৈ।

এর পর যখন স্ট্যান্ডার্ড ফোরে পড়ি, ততদিনে বিড়িখোর হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বিকৃতি না পেলেও যেকোন প্রতিযোগিতাতে নাম দিলে নিশ্চিত পদক জিতব এমন ধারার নেশাড়ু হয়ে উঠেছি। এ সময় বন্ধু বলতে আমাদের ফার্টিলাইজার দোকানের অন্যতম কর্মচারী রসিদ। আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় ছিল, অভাবের সংসারে পেটের দায়ে দোকানে ফাইফরমাইস খাটত। এর ছিল তখন হিন্দি সিনেমার গল্পের প্রচুর স্টক, আর আমার বাড়িতে টিভি রান্নাঘরে পৌঁছেছে মায়ের কল্যাণে, রবিবার ছাড়া ছোঁয়া পাপ। সুতরাং বিড়ির আগুনের যোগান আর সিনেমার গল্পের সন্ধানে রসিদ ভাই ‘বন্ধু’ হয়ে উঠতে দেরি হয়নি।

ক্লাস ফাইভ; আমি তখন ভীষণ বেঁটে ও রোগা সাধারণ বাচ্চাদের তুলনাতে। বাবা নতুন কয়লার ব্যবসা শুরু করার দরুন সপ্তাহে ৩-৪ দিন পর পর বাড়ি ফিরতেন। অগত্যা স্কুলের পড়ার সময়টুকু বাদে, ঐ বয়সের খাজাঞ্চি/মুন্সি বিনয় দাদুর সাথে দোকানে টাটে বসতে শুরু করলাম। তখনই কোনো একসময় ভেবেছিলাম পড়াশোনা করে আসলে লাভটা কি হয়? মিছিমিছি খরচ বাড়ানো, সেই তো এই দোকানেই বসব, যেমন ভাবা তেমন কাজ। মনে মনে ‘আমিই মালিক’ ভাবটা জন্মানোর সাথে সাথেই বাহ্যিকভাবে তার প্রদর্শনও শুরু হল। বাড়িতে খবরটা পৌছাতে মায়ের মুষড়ে পরার পাশাপাশি দাদু তো আনন্দে আত্মহারা, বুঝেছিলাম নতুন একটা বন্ধু জন্মালো।

আমাদের দোকানের ঠিক গায়ে একটা চায়ের দোকান ছিল, মানে আজও আছে। প্রোডাকশন ব্যবসাতে চলে আসার দরুন আমাদের দোকান ব্যবসা কাকার হস্তগত হলেও, চায়ের দোকানটা আজও বিদ্যমান। তো ওই ক্লাস ফাইভের মাঝামাঝি কোনো এক শীতের দুপুরে দোকানের বারান্দাতে লাট্টূ ঘোরাচ্ছি, দেখি চায়ের দোকানেও আমারই বয়সি একটি ছেলে উনুন থেকে পোড়া কয়লার ছাই বেড় করছে। পরদিন আলাপ হল, জানলাম তার নাম পোসোন। ভালনাম প্রশেনজিৎ কর্মকার। এফ পি স্কুলের পাঠ সমাপ্ত, তার বাবা আর দাদার সাথে দোকানের চায়ের এঁটো কাঁচের গ্লাস ধোয়ার ডিউটিতে সদ্য বহাল হয়েছে। সে ও ছিল বিড়িখোর, সুতরাং বন্ধু হওয়াটা ছিল শুধু সময়ের প্রতীক্ষা। জীবনের অনেকটা সময় জুড়ে পোসোনের অবস্থান রয়েছে। বন্ধু পোসোন।

মাধ্যমিকের পর আমি সায়েন্সে যেতেই অধিকাংশ বন্ধু বিচ্ছেদ হয়ে গেল সময়ের অভাবে। তবে নতুন বন্ধুও এসেছিল, যদিও সেটা সংখ্যাতে খুবই কম। বরং তদ্দিনে বন্ধুর চেয়ে বান্ধবী পেতে বেশি মন হাঁকুপাঁকু করত। দু-ক্লাস উঁচু বুড়োদার সাথে বন্ধুত্বও করেছিলাম শুধু মাত্র এই কারনে যে, ও যাকে লাইন মারত সে আমার সাথেই পড়ত- নাম শ্রেয়সী। আমিও তাকে হেব্বি ইয়ে করতাম। বুড়োদাও ব্যাপারটা জানত, তারও পরে আমার থেকে এটা-সেটা খাওয়ার লোভে ওকে দেখার পার্মিশন দিত। তবে সেসব এক দিন ছিল। এর পরে অভিশ্রীর জন্য তো অনেক বন্ধু বিচ্ছেদও হয়েছিল, সে আলাদা কাহিনী। খেলার মাঠেও কি কম বন্ধু হয়েছিল! জয়দেব, গোপাল, ভোঁদা, পচা, তারক, যতীন, রফিক, সঞ্জয়, আসিফ, রিন্টু সহ কত নাম নেব! এক্ষেত্রে বয়সের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিলনা অন্য ক্ষেত্রগুলোর মত।

এভাবেই, প্রদীপ, সন্তু, ছট্টু, গৌরাঙ্গদের মোটাতাজা স্মৃতি নিয়ে বান্ধবীহীন হয়ে একদিন কোলকাতায় এসে পৌছালাম কলেজে ভর্তি হবার দরুন। যাদবপুরের মেসে যেতেই নিলুদা, সতীনাথদার সাথে পার্থ বারুই ও প্রদীপ নন্দী এমন ভাবে মিশে গেল, যেন আমার বন্ধু হবে বলেই অপেক্ষায় ছিল। সময় কিছুদিন যাবার সাথেই জীবনের একটা বড় ট্রাজিক অংশ ওই সময়ে আমার জীবনের সাথে জুড়ে গেল। একটি মেয়ে, ধরুন তার নাম ‘পাখি’। আমার জীবনের একমাত্র চরম বন্ধু বলে যদি কেউ থাকে তাহলে সেটি সে। আমার কাছে তার বন্ধুত্বের মূল্য এতটাই যে, তার নামটা পর্যন্ত আমি নিতে অপারগ। উল্টোদিকে বন্ধুত্বের খাতিরে আজ সেও সব ছেড়েছুঁড়ে নতুন একাকী জীবন বেছে নিয়েছে ভিনদেশে।

যাই হোক, কোলকাতার পাঠ শেষ করে ওই যে বেড় হলাম মুক্ত পৃথিবীতে, তার পর থেকে দীর্ঘদিন আর নতুন বন্ধু জোটেনি আমার। মাস্টার্স করতে হায়দ্রাবাদ গেলাম, চেনাজানা হল অনেকের সাথেই, কিন্তু বন্ধু? নাহ হলনা। এরপর পারিবারিক ব্যবসাতে ঢুকলাম, সেখানেও অনেক নতুন নতুন নামের সম্পর্ক তৈরি হল বা আজও হয় রোজই, কিন্তু বন্ধু! নৈব নৈব চ!

এরই মাঝে রেডিফ বোল, MSN মেসেঞ্জার, অর্কুট পর্ব পেরিয়ে এসেছি। ২০১১ থেকে ফেসবুক যুগের সুত্রপাত হল আমার জীবনে। অবশ্য সেই ২০০৮ এর শেষের সময়েই এই প্ল্যাটফর্মে এসে গেছিলাম। তখন কেউই ফেসবুককে সিরিয়াসলি নেয়নি আজকের দিনের অনেকের মত।

এখানে যেটা বুঝলাম, বস্তুজীবনে আগে চেনা হয় জানা হয়। মানুষটাকে খেয়াল করে তার সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হওয়ার মধ্যে দিয়ে বন্ধু নামের সম্পর্কটা অজান্তেই গড়ে উঠে। এই ভার্চুয়াল মাধ্যমে নিয়মটা অনেকটাই অন্যরকম। এখানে বন্ধুতালিকা নামে একটা খাঁচা করা রয়েছে। আগে সেই খাঁচাতে একে অন্যকে স্থান দিলে বা স্থান পেলে তবে সময়সারনী বেয়ে জানা ও চেনার সুযোগ ঘটে। তার পর অনেকটা দিন যাবার পর ঠিক হয় এরা বাস্তবের মাটিতে বন্ধু হবে কিনা। নতুবা ভার্চুয়াল স্তাবক বা চুলকানিবাজ বা কমল হাসানের পুষ্পক হয়ে রয়ে যায়।

বস্তুজীবনের শত্রুরাও ভীষণ চেনাজানা হয়। ভার্চুয়ালি অচেনা মানুষের সাথে অযথা তর্কাতর্কি হয়ে না থাকা সম্পর্কটি শত্রুতাতে পরিণত হয়। বস্তু জীবনে যাদের সাথে কখনই নুন্যতম আলাপ আলোচনা হতনা সামাজিক, অর্থনৈতিক, অবস্থানগত পার্থক্যের কারনে, ভার্চুয়ালি অবশ্য তা অহরহ হয়। আপনার বাড়ির ফাঁকিবাজ চৌকিদার ‘দামু’ আপনাকে আসাম NRC বিষয়ে অনেকটা জ্ঞান বিলিয়ে দেবেন অনুকুল চন্দ্র বিশ্বাস ID হয়ে। মুড়ি মিছড়ি অনেকটা এক দড় এই পাড়াতে। নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার ব্যাস্ত সিডিউলে বন্ধু খোঁজার ফুরসৎ কই? স্তাবক চাই স্থাবক, পোষাকী নাম ফ্যান। যাদের বাণী হল- অপূর্ব, দারুণ, চমৎকার, দুর্দান্ত, শুভেচ্ছা রইল, অভিনন্দন, অনবদ্য ইত্যাদি।

এখানে দুপুর পাশ অটোরিক্সার খালাসিও কেমিস্ট্রির অধ্যাপকের ক্লাসনোটসের ভুল ধরে। বাংলাতে ফেল করে মুদি দোকানের কর্মচারীটিও বাংলাদেশী পেজ থেকে কবিতা ঝেঁপে কোনো নতুন পত্রিকাতে নিজের নাম তোলে। B-16 ক্যামেরার কল্যাণে মালু বৌদি কচি প্রেমিকা ধরছে, শরীর বাঁচিয়ে। একটু সুশ্রী মেয়ের ছবি DP তে দেখলেই তার সাথে বন্ধুত্ব করতে ৮ থেকে ৮০ এর পুরুষেরা হামলে পড়ে। কেন পরছে, ধরছে ও করছে? কারন এই মাধ্যম তাকে এসব করতে সুযোগ দিয়েছে তাই ধরছে। জ্ঞান আছে না নেই এ প্রশ্ন এখানে অবান্তর। এর মাঝে কেউ কেউ অবশ্য গুগুল করেও নেয়, বাকিরা নিজ বিষয়ে সর্বসময় ভীষণ কঠোর, আপন বাপন চৌকি চাপন। পান থেকে চুন খসলেই আপনাকে দলবেঁধে একঘরে করে ২ মাসের ফাসিতে লটকে দিয়ে যাবে, সে আপনি রাজা উজির যে ই হননা কেন। তাই এখানে বন্ধু হওয়াটা প্রতিপদে পরীক্ষা দিয়ে রীতিমত যোগ্যতমের উদবর্তন সুত্রের নিত্যতার ফলিতায়নের মধ্যদিয়ে অতিক্রম করতে হয়।

বস্তু জীবনে আপনি ১৭ বার মেট্রিকে ঘায়েল হলে পাড়ায় আর মুখ দেখাতে পারবেননা। ভার্চুয়ালি তাতে আপনার বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই, বরং আমি চূড়ান্ত অভিজ্ঞ ওই বিষয় অবধি। আপনি ট্রাম্পের বিদেশনীতি থেকে কাশ্মীরের পণ্ডিত সমস্যা হয়ে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট, সর্বত্র সমানতালে মন্তব্য করে যেতে পারেন। কেউ কিচ্ছুটি বলবেনা। আগেকার সময়ে উমেদার তোষামোদকারীরা বেতনের বিনিময়ে রাজসভাতে বিরাজ করত আর সর্বজ্ঞেরা চায়ের দোকান বা বটতলা চণ্ডীমণ্ডপে। আজকাল এনারাই সকলে ফেসবুকে থাকেন, কবি লেখকদের সাথে সহাবস্থান করেন, খিল্লি করেন। চুম্বকে এই হল ফেবু বন্ধুত্ব, আজ আছে তাই আছে, কাল একটা ব্লক বা আনফ্রেন্ডের খোঁচাতে ভ্যানিস।

বন্ধুত্বটা অনেক ভারি শব্দ। দুম করে যাবার নয়। আর যেটা চলে যায়, সেখানে বন্ধুত্বটা বোধহয় থাকেনা। আজকাল অনেকেই বাবা, মা, বোন, স্ত্রী, সন্তানদেরও বন্ধু হিসাবে গন্য করে। আমার কাছে বন্ধু হল সে, যার কাছে প্রত্যেকের কথা নির্দ্বধায় শেয়ার করে নিতে পারি। বাবা, মা, বোন, স্ত্রী, সন্তানদের কাছে ‘সব’ কথা শেয়ার করা যায়না, কারন অধিকারবোধ আর ভালো থাকা ও রাখার দায়ে অনেক কিছু চেপে যেতে হয় তথা মানিয়ে নিতে হয়।

ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব বলে আসলে কিছু হয়না, চেনাজানার মাধ্যম হিসাবে এটা সুত্রধরের কাজ করে মাত্র, মঞ্চ; এর বেশি কিছুনা। বাকি যাবতীয় বন্ধুত্বের শর্ত গুলো, মানে যদি কোনো শর্ত থাকে আর কি, সেগুলোকে বাস্তবের মাটিতে রূপ দিয়ে লালন করতে হয়। তাই ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিষ্টে আছে মানেই সে বন্ধু নয়।

২০১৪ পরবর্তী জীবনে এই ফেসবুকই সুধা’র সাথে আমার পরিচয় ঘটিয়েছিল। পরে পরে আরো অনেকেই বন্ধু বৃত্তে মনের কাছাকাছি অবস্থান করে রয়েছেন ফেসবুক সুত্রে। এই পথ ধরেই শেহনাজেরও আগমন, অবশ্য সে পথ বেঁকে অন্যত্র মোড় নিয়েছে, বিষয়টা পারিবারিক সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। যেমন শ্রীকুমারদা, কিংশুকদারা বন্ধুত্বের মোড়কে দৈনন্দিন পারিবারিক সুখদুঃখের সাথী হয়ে গেছেন। জগদীশদা, জয়ন্ত, সুপর্ণা, গোপালদা, সুব্রত, দেবু, শবনমদি, মতিদা, প্রশান্ত, সৌরভ, তাপসদা, আসাদ ভাই, পারমিতাদি সহ অনেক অনেক মানুষগুলো নিশ্চিতভাবে রোজ জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কে, কি, কেন ইত্যাদির উর্ধ্বের আমাদের রোজকার ভাললাগা মন্দলাগা গুলোকে নিজেদের মধ্যে বিলিবন্টন করে, সুখ কুড়িয়ে বাঁচি।

তবে বন্ধু আর অবিভাবক এক হয়না। যার হয় সে অতিরিক্ত ভাগ্যবান। আমার সৌভাগ্য দু-দু’জন এমন মানুষ রয়েছেন। যারা না থাকলে আমার জীবনটা অন্য খাতে বইতেই পারত। একজন অবশ্যই ওই মোটাসোটা গুঁফো মোড়ল মশাইটা, সুব্রত মণ্ডল। অন্যজন- প্রসেনজিৎ গুহ, আমাদের জয়দা। আমার স্বঘোষিত গুরুদেব। প্রথমজনের জ্ঞান আর দ্বিতীয়জনের খিস্তি জীবনে না থাকলে জীবনটা অসম্পূর্ণ থাকত, বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটাও।

এনাদের জন্যই সারাবছরই আমার কাছে বন্ধুদিবস। কারন বন্ধুরা ছাড়া জীবনের মূল্যমান শূন্য।

ভাল থেকো সবাই।   

Saturday, 4 August 2018

।। রাশিভ্রম ।।


“এই যে আপনি, শুনিতেছেন; আপনার সহিত আমার যাবতীয় সম্পর্ক এই অবধিই সমাপ্ত হইল। আজি হইতে আমা সহিত কোনো প্রকারের যোগাযোগ করিবার প্রচেষ্টা করিবেননা, আশা রাখি। দুরাভাষ যন্ত্র যোগে ক্রমপীড়ন সহ সর্বপ্রকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আমাকে নিষ্কৃতি প্রদান করিবেন কামনা করি। প্রসঙ্গত, সমুদায় এ সকল আখ্যায়িকার অবতারনের হেতু হইল, আমার অভিভাবকেরা পাণিগ্রহণ নির্ঘন্ট চূড়ান্ত করিয়াছেন পাত্র উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা। উক্তদিবসের প্রীতিভোজে আপনার সপরিবারে নিমন্ত্রণ রইল, অন্তিমবারের মত শ্রীমন্তের পাদস্পর্শে আমাদিগকে ধন্য করিলে বাধিত হই। অবশ্য ইহাতে অস্মদীয় ‘প্রথম ও অন্তিম’ অবেক্ষণ পর্বটিও বরদাস্ত করিয়া লইব।
শুভায়ু ভবত”

চলমান দূরাভাষযন্ত্রের প্রদর্শন যবনিকার উপরিতলে দৃষ্টিপাত করিয়া- দেবাহুতির অন্তিম বৈদ্যুতিন-বার্তাটি বারংবার পড়িতেছিল বভ্রুবাহন দেবাহুতি তো তাহার প্রণয়াসঙ্গী ছিল না! তথাপি তাহার এই মনবেদনার হেতু কি? বক্ষদেশের বামপার্শ্বেও মৃদু শূলনাভুত হইতেছে। মনে হইতেছে যেন, অতি মূল্যবান কোনো বস্তু হারাইয়া যাইবার উপক্রমক্ষণ উপস্থিত হইয়াছে!

সংযোগ রাশির ভ্রমবসত, চলমান বার্তাযন্ত্রের মাধ্যমে কিয়ৎ পরিমাণ অদ্ভুত ভাবে পরিচয় ঘটিয়াছিল বভ্রুবাহনের সহিত দেবাহুতির। বভ্রুবাহন স্মৃতিপথ বাহিয়া ঠিক এক বৎসর পূর্বে পশ্চাতধাবন করিল।
-       অপরপ্রান্তে কে রহিয়াছো সুহৃৎ?
-       আজ্ঞে আমার নাম বভ্রু, বভ্রুবাহন শুভার্থী। আপনি কে প্রিয়ংবদা?
-       আমি! আমি আপনার সখী...
-       সখী? কোন সখী?  কি বলিয়া সম্বোধিত করিব আপনারে?
-       দেবাহুতি, আমার নাম দেবাহুতি
-       দুঃখিত, এ নামধারী কেহ আমার পরিজনবৃত্তে ঠাহর হয়না।
-       তাহাতে দোষের কি হইল, ভাবিয়া নিন আজি হইতেই পরিচয় হইলআমি আপনার নতুন সখী! হিহিহি...
 
গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা মতে উহা ছিল বিশ্বমৈত্রী দিবস। অনর্থক তামাসাজনিত কারনেই, আপন দূরাভাষ সংযোগ-রাশি-ক্রমঙ্কন সমন্বয়ের বিন্যাস বিচ্যুতি ঘটাইয়া, উদ্ভুত রাশিতে দূরাভাষ সংযোগ করিল দেবাহুতি অতঃপর সেই যন্ত্রচালিত আহ্বানটি বভ্রুবাহনের মুষ্ঠিযন্ত্রে অবলোকিত হইয়াছিল, বাকিটা ইতিহাস

প্রারম্ভকালীন সময়ে বভ্রুবাহন কন্যাটিকে উপেক্ষা করিলেও, অনতিবিলম্বেই দুইজনের মধ্যে অন্তরাল মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপিত হইয়া গেলললনাটি কিঞ্চিৎ প্রগলভ স্বভাবজাত ও বাচাল, তথাপি এই চারিত্রিক বৈশিষ্টটিই বিশেষভাবে মনে ধরিল বভ্রুবাহনেরবভ্রুবাহনের সরলতায় সম্পৃক্ত গম্ভীরভাবে বলা কথাগুলিও হৃদয়াবৃত্তিতে নাড়া দিতে লাগিল দেবাহুতির
ইতিপূর্বে এইরূপে কোনো রমণীর সংস্পর্শে আসিবার সুযোগ ঘটেনি বভ্রুবাহনেরবাল্যকাল হইতে মা ব্যাতিত অন্য স্ত্রীজাতি হইতে নিজেকে গুটাইয়া রাখিয়াছিল কোনো নির্দিষ্ট কারন ব্যাতিরেকেই। সহসা অনাহূত আগুন্তকের ন্যায় তাহার জীবনে আসিয়া পরা দেবাহুতি নাম্নী কন্যাটি তাহাকে পরিপূর্ণ রূপে বদলাইয়া দিল। হৃদয়ের অন্তঃপুরে এই কন্যার নিমিত্ত প্রাসাদও নির্মিত হইল যতনেবভ্রুবাহনের উপলব্ধি করিল, এই কন্যাটি তাহার আগত ভবিষ্যতের জন্য একমাত্র ভরসা যোগ্য

সত্য সত্যই এই কন্যাটির মধুর কথাবার্তাতে একটা নিঃসংশয় আস্থাভাব ফুটিয়া উঠিয়াছিল। মায়াবতীর ন্যায় প্রতিটি বাক্যে একটু একটু করিয়া বভ্রুবাহনকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল। বভ্রুবাহনেরও মানসপটে কন্যাটির পরিপূর্ণ একটি চিত্র অঙ্কায়িত হইয়াছিল, উহা যতটা না বাহ্যিক তাহা হইতেও চিত্তগত অধিক ছিল। অতএব আগামী জীবনটুকু অতিবাহনের জন্য জীবনসঙ্গী হিসাবে ইহার থেকে উত্তম আর কাহাকে ভাবিতে পারিলনা উভয়েই, তাহাদের প্রত্যেকর ভাবনা জুড়িয়া অপরজন বিরাজ করিতে লাগিল এমনভাবে যে, অন্য কাহারো প্রতি ভাবনা ও দৃষ্টিই যাইতনা।

বভ্রুবাহন দেবাহুতির অন্তিম বার্তাটির প্রতি নিষ্পলক দৃষ্টিপাত করিয়াই রহিয়াছে। চক্ষু দুইটি ক্রমশ ঝাপসা হইয়া আসিতেছিল রোদনবাষ্পের প্রভাবে, ভাবিতেছিল মনুষ্যের প্রনয় জীবন কেনইবা এমন নিষ্ঠুর হইয়া থাকে! যেন ভয়াবহ কোনো গোলকধাঁধাঁর পরিলেখতে জীবনটি চিরতরে আঁটকা পড়িয়া রহিয়াছে, যাহা হইতে মুক্তি নাই।

আজ দেবাহুতির গৃহে বিবাহঅনুষ্ঠানের আসরসমস্ত গৃহখানি রঙ্গিন সুদৃশ্য বাহারি আলোক সজ্জায় ঝিকমিক করিতেছে। বভ্রুবাহন ভাবিতেছে, হয়ত অনতিবলম্বেই অশ্বপাল তাহার বিত্তের প্রদর্শন স্বরূপ দামি বাহনে চড়াইয়া দেবাহুতিকে তুলিয়া লইয়া যাইবে। সমগ্র অনুষ্ঠানবাটিকা শশব্যস্ত নানাবিধ অনুষ্ঠানাচারেবভ্রুবাহন একটি অট্টালিকা স্তম্ভের কোণায় দাঁড়াইয়া নিবাসটির অঙ্গসজ্জার প্রতি স্থাণু দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিয়াছেআঁখিপল্লব দুইটি আজ যারপরনাই পরিমাণে দুর্বহ অনুভূত হইতেছে অচম্বিতে বভ্রুবাহনের চলমান দূরভাষ যন্ত্রে, বার্তা আগমনী সুরটি বাজিয়া উঠিল;  দেবাহুতি কিছু সন্দেশ পাঠাইয়াছে-

-
আপনি কি আসিয়াছে?

বভ্রুবাহন ঈষৎ বিবেচনা করিয়া দেখিল, শিষ্টাচার বসত যেহেতু আচারঅনুষ্ঠানে উপগত হইয়াছেই সুতরাং অন্তিমলগ্নে প্রতুত্তর না দেওয়ার মত দুর্বিনীত হইতে অন্তর সায় দিলনা। অতঃপর জবাব দিল-

-
হুম, আসিয়াছি।
- আমি আপনাকে দেখিতে পাইতেছিকষ্ট করিয়া ক্ষণকাল অপেক্ষার আর্জি রাখিলাম, আমি স্বয়ং আসিতেছি সাক্ষাৎ অভিপ্রায়ে
পাদঘন্টা মুহুর্তের মধ্যেই অতিক্রান্ত করিল বভ্রুবাহন, অতঃপর মনোহরা গোলাপশোভিত এক অপরূপা উর্বশীসম কন্যা বভ্রুবাহনের সম্মুখে আসিয়া মৃদুভাবে বভ্রুবাহনের নাম উচ্চারণ করিতে তার চকিতভাব কাটিল। আজিই প্রথববারের জন্য চাক্ষুষ করিল দেবাহুতিকে, তাহা আবার রক্তিম সাজে। কি অপূর্বই না লাগিতেছে, যেন স্বর্গ হইতে কোনো দেবী মর্তধামে আসিয়াছে, নতুবা বভ্রুবাহন কল্পলোকে বিরাজিছে। পুনঃর্বার চকিতভাব কাটিল আলাপনের প্রশ্নে-
-
আপনিই বভ্রুবাহন?
- আজ্ঞে আমিই
- আপনি তো দেখছি ভক্ষ্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত লালস প্রজাতির ব্যাক্তি? আপন গৃহে কি যথেষ্ট পরিমাণে ভোজন সামগ্রী বাড়ন্ত? আসুন মণ্ডপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করুন। আমিষদ্রব্য, মণ্ডামিঠাই সহ ষোড়শোপাচারে আপ্যায়নের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা রহিয়াছে, প্রাণভরিয়া উদরপূর্তি করিতে দ্বিধা করিবেননা।
- তাহার আর প্রয়োজন নাই, ধন্যবাদ সাক্ষাতের জন্য। এ অভিপ্রায়েই আসিয়াছিলাম, অতএব এবারে আমি চলিলাম, বিদায়।
- ঠিক আছে, আপনার মনোকামনাই পূর্ণ হউক। তবে একটি প্রশ্ন ছিল, আপনার অক্ষিগোলক কি এমনই স্বাভাবিক রঞ্জিত রক্তাভ বর্ণের!

বভ্রুবাহন বাকশক্তি হারাইয়াছে, যেন কোনো অপ্রার্থিব শক্তি তাহার গ্রীবাদেশে সর্বশক্তি প্রদান করিয়া পেষন করিতেছে। 
-
আমাপ্রতি আপনার অনুষঙ্গ ঠিক কোন পর্যায়ের? উহাকে কি প্রণয়প্রীতি হিসাবে গ্রহন করিতে পারি?
দেবাহুতির এই বাক্যাটি শ্রবণমাত্র ভীষণ বিষম খাইল বভ্রুবাহনমেকি হাসি হাসিয়া বভ্রুবাহন কহিল-“ নাহ, মোটেই নয়। কেন তাহা হইবে। আপনার সহিত...! সামান্যটুকুও না”।

অন্তিম শব্দটিকে, বক্ষদেশের অভ্যন্তরের দলাপাকানো একরাশ বেদনা ও ক্ষোভ- ঈষৎ কম্পিত করিয়া দিল। সাথে সাথে দুই ফোঁটা অশ্রুও চিবুক পর্যন্ত শিক্ত করিয়া তুলিল, যাহা দেবাহুতির অগোচরে রহিলনা

দেবাহুতি কহিল, “আচ্ছা, প্রণয় বা ভালো না হয় না ই বাসিলেন,  এক্ষণে অন্দরমহলে তো চলুন। ভোজনাদিও নাহয় একসাথে মিলিয়াই করিব, সত্বর চলুন, অবকাশ অত্যন্ত কম। বরযাত্রী আসিল বলিয়া, দিদিকে তাহারা অচিরেই লইয়া যাইবে”

বভ্রুবাহন পেল্লাই আকারের বিষম খাইয়া ও বিহ্বল হইয়া বিস্ফোরিত চক্ষু করিয়া দেবাহুতির পানে চাহিয়া রহিল। দেবাহুতি কপট ক্রোধ প্রদর্শিত করিয়া কহিল, “ভারি অসভ্য মানুষ বটে আপনি, কি ভাবিয়াছেন, সখ্যতাও আমি যাচিয়া করিয়াছিলাম, তথাপি ভালোবাসার প্রস্তাবনাও আমাকেই করিতে হইবে? মহা বেহায়া ধরনের ধৃষ্ট পুরুষ আপনি। যে কাজ পুরুষের তাহা আমি কোনো অবস্থাতেই করিবনা, আই বলিয়া দিলাম, হ্যাঁ।  

এতক্ষণে অন্তঃপুরে কনে’র ঘরে পৌঁছাইয়া গিয়াছে উভয়ে, উপস্থিত সকলের সহিত বভ্রুবাহনকে আপন বিশিষ্ট বন্ধু হিসাবে পরিচয়ের সাথে সাথে বধুবেশী কন্যাটিকে আপন জ্যাষ্ঠো ভগিনী হিসাবে উল্লেখ করিয়া উপর্যুপরি খিলখিলাইয়া হাসিয়া উঠিল দেবাহুতি। যাহা বভ্রুবাহন ব্যাতিরেকে অবশিষ্ট সকলের মাঝে সংক্রামিত হইল

বধুরূপী হিরন্ময়ী কহিল, আমার তো গতি হইল, কিন্তু আমার ভগিনীর প্রেমিকপ্রবরটি ঠিক কতখানি প্রণয়াশক্ত সেইটি দেখিবার জন্যই এই নাটিকার অবতারণা, যাহা হউক আপাতত যবনিকা পরিল ভাই। তুমি আমাদের পরমাত্মীয়, ক্ষণকালের এই মনকষ্টের জন্য বড় দিদি ভাবিয়া মার্জনা করিয়া দিও”। ঘরে পুনঃরায় হাসির রোল উঠিল।

দেবাহুতি কৌশলী দন্তবিকাশ করিতে করিতে বলিল , আমি কিন্তু কখনো বলিনাই আমারই বিবাহবভ্রুবাহনের হতচকিত পরিস্থিতি অনুধাবন করিয়া আকাশ বাতাস কম্পিত করিয়া আবার সকলে খিলখিলিয়ে হাসিয়া উঠিলমুগ্ধতা ছড়ানো সেই হাসিতে সমস্ত পৃথিবির যাবতীয় সুখের সন্ধান পাইতেছিল বভ্রুবাহন, সে দেবাহুতির প্রতি নির্নিমেষে চাহিয়া অপার মুগ্ধতায় ভাসিয়া যাইতে লাগিল
 
অভাগা লেখকও এমনই কোনো অযাচিত দূরাভাষের প্রতীক্ষায়, যদি পাঠককূলের কোনো সহৃদয় ললনা আকৃষ্ট হয়, অকৃতদার তকমাটি ঘুচে তাহা হইলে।

-সমাপ্ত