Wednesday, 18 July 2018

।। শিশুর ভালোবাসা ।।

ভালবাসার কোনো ভাষা হয়না, শর্তও হয়না। আবারও তা প্রমাণিত।
আমার ছোট মেয়ে সারাহ, বয়স সবে চার শেষ করেছে, কয়েক মাস হল স্কুলও যাচ্ছে। কথাবার্তা এখনও আধোআধো।
আজ স্কুল থেকে আসা অবধিই সমানে ফুঁপিয়ে কান্না। এমনিতে দস্যি, কোথাও না কোথাও চোট লাগাবেই। প্রথমে ওর মা ভেবেছিল তেমনই কিছু। কারন সারাহ এখনও গুছিয়ে কিছু বলতে পারেনা, মাঝেমাঝেই খেলা করছে - আবার কাঁদছে।
ভুল ভাঙল সন্ধ্যার পর। ওর স্কুলের ম্যাম ফোন করেছে সারাহকে। তার মন খারাপ, তাই সারার সাথে কথা বলবেন।
প্রথমে যবে শুধিয়েছিলাম তোমার মিসের নাম কি বাবু? সারাহ বলেছিল “পারোতা আর তিসিটা ম্যাম”।
এর মাঝে পাকা পেয়ারা, টফি, লজেন্স ইত্যাদি মাঝেমাঝেই দেখি ঘরে আসে, মেয়ের ব্যাগ বয়ে। মেয়ের গালেও লিপস্টিকের দাগ, পোষাকে সুগন্ধি পায় মেয়ের মা। বুঝতে অসুবিধা হয়না, ক্লাস টিচারের কোনো একে জন বা দুজনেই এই দুগ্ধপোষ্য শিশুটির বা শিশুগুলোর মনে অনেকটা স্থান করে নিয়েছেন।
আজকাল শিক্ষিক শিক্ষিকারা বড় ভয়ে ভয়ে থাকেন, এই বুঝি অতিরিক্ত আদর দিলে বা কিছু এদিক সেদিক হলে গার্জেনকুল সহ স্কুল কতৃপক্ষ বাপান্ত করে তোলেন। কারন সময় বড় অস্থির, নরম সম্পর্কগুলোর মাঝে কিছু জানোয়ার বিষাক্ত বাতাস ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেখানে সারাহর মায়ের তরফে এই ভালবাসা গ্রহনে কোনো আপত্তি না থাকাতে সম্পর্কটা এতোটাই গভীরে, যে আজকের পরিস্থিতি। ইয়ে, আমি অবশ্য এতো কিছুর খবর জানতামই না। আপনাদের মতই আমিও খানিক আগেই জানলাম।
জানিনা এই প্রাইভেট ইংরাজি মাধ্যমের স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা কত বেতন পান, নিশ্চই যোগ্যোতার তুলনাতে অতি সামান্য। অনেকেই দূর দুরান্ত থেকে আসেন, শুধু মাত্র বেকার বদনাম ঘোচাতে বা সত্যকারের কিছু ভদ্রস্থ রোজগারের কারনে। শিক্ষাগত যোগ্যোতার সাথে কিন্তু এনাদের অতিরিক্ত যেটা থাকে সেটা হল এই আপন করে নেবার ক্ষমতা। শিশু চারাগাছে এনারাই জ্ঞানের প্রাথমিক সার-খোলটা দিয়ে আগামীকে তৈরি করেন।
আজ সেই তিসিটা ও পারোতা ম্যাম, সরি পারমিতা ও তিস্তা ম্যাডাম সারাহ’র গলা জড়িয়ে কেঁদেছে, বেলুন দিয়েছে, চকলেট দিয়েছে, সারাহর নোটবুকে ফোন নাম্বারও লিখে দিয়েছে আর অনেক অনেক আদর করে বলেছে- আমি আর আসবনা।
হয়ত কোনো বেটার অপারচুনিটি পেয়েছে মেয়েদুটি, বা হয়ত কোনো পারিবারিক অসুবিধা বা সুবিধার কারনে তারা আমাদের মেয়েদের মন ভেঙে নিজের দেশে বা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই অবোধ শিশুর কান্না ওদের কর্মের সার্থকতা বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শিশুরা স্বার্থ বোঝেনা, তারা ভালোবাসা বোঝে, তাই একটা ক্ষণে আমার নিজেরও মনটা একটু ভারি হয়ে গেছিল। শিশু মন নিশ্চই অচিরেই তার পারোটা আর তিসিটা ম্যামকে ভুলে যাবে- ম্যামও কালের নিয়মে সারাকে ভুলবেন।
মেয়েদুটি আমার বোনের চেয়েও বয়সে অনেক ছোট, ২১-২২ এর কোঠায়, আগে কোনোদিন দেখিনি ভবিষ্যতেও কখনো আর দেখা হবেনা, কিন্তু তারা ভালবাসার গুণে, সারাহর শিশুকালের সাথে আমাদের স্মৃতিপটে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিল। যতটা ভাবনা মনের মাঝে ছিল ততটার ২০%ও লিখতে পারলাম না। একটা অদ্ভুত খুশি অনুভূত হচ্ছে এই ভেবে যে, মেয়ে আমার আদরে শিখছে। এটাই চাই, শাসনের আদরে বড় হোক। শাষন করা তারই সাজে আদর করে যে।
কোমল নিঃস্বার্থ ভালবাসার প্রকৃত উদাহরন। ব্যাবসাতেও লেনদেন হয়, পেশাদারিত্বের মোড়কেও অনেক কিছু বিকিয়ে যায়, কিন্তু ভালোবাসার বন্ধন থাকলে তা জীবনের মাত্রা পায়, দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। অম্লান হোক এমন সকল শিশু-দিদিমনি সম্পর্ক।
থ্যাঙ্কু “পারোতা ম্যাম তিসিটা ম্যাম”, আপনারা দুজনে গিয়ে জানিয়ে গেলেন ভালবাসার পথটাই একমাত্র পথ, বাকি সব শূন্যগর্ভ বা মানিয়ে নেওয়া মাত্র।

No comments:

Post a Comment