আজ রোববার। ২৫শে মার্চ ২০১৯।
কোলকাতা বনাম হায়দেরাবাদ এর কোটিপতি লিগের ক্রিকেট ম্যাচের বাৎসরিক আয়োজনের শুরু, কলকাতাতেই সেই ম্যাচ চলছে। ম্যাচটা দুপুরে শুরু হয়েছে, ক্রিকেটমোদী জনগণ তাই ওই এলাকাতে শহরের গোধূলিবেলার মলিন রূপটা দেখতে পাবেননা। সুউচ্চ বাতিস্তম্ভ থেকে আলোকের ঝর্ণাধারা সবুজ মাঠকে আলোকিত করে তুলেছে, হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হবে কল্লোলিনী তিলোত্তমা।
আপনি কি ময়দানে গোধূলি দেখতে চান? তাহলে চলে আসুন, ইডেনে যাবার আগে যে আইল্যান্ডটাতে একটা সবুজ ঘাসের হাত থেকে ফোয়ারার সুদৃশ্য জল ঝরছে, যার পোষাকি নাম ‘নেতাজি আইল্যান্ড ইকো গার্ডেন’; ওইখানে দক্ষিণ মুখো দাঁড়িয়ে রাজভবনের দিকে পিঠ করলে বাঁহাতে একটু তেরছা ভাবে যে রাস্তাটা সোজা গিয়ে চৌরঙ্গী রোডে মিশছে ওই রাস্তাটার নাম মেয়ো রোড। রাষ্ট্রীয় মর্যাদাতে বঞ্চনার টেষ্ট ম্যাচ চলছে এখানে; উইকেট পড়ল বলে। মেয়ো রোড ধরে কিছুটা হেঁটে আসুন ইডেনকে পিছনে রেখে, দেখবেন আপনার রাস্তাটা যেখানে আরেকটা রাস্তা কাটছে ওই খানে এসে সামান্য বাঁয়ে তাকান। একটু কষ্ট করতে হবে, কারন কোলকাতা পুলিস আগে এই স্থানটিতে বাস দাঁড়াতে দিতনা মোটেই, প্রেসক্লাবে নিত্য মান্যিগন্যি ব্যাক্তিদের আনাগোনা। ঠিক এই মুহুর্তে সেই পুলিশিই সারিসারি বাস দিয়ে শাসকের দুর্নীতি ও কলঙ্ক ডাকার ব্যার্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আরেকটা রাস্তা যেটা মেয়ো রোডকে কাটল, তার নাম ডাফরিন রোড। এখানেই সাইনবোর্ড পেয়ে যাবেন অভিজাত কোলকাতা প্রেশ ক্লাবের। সামনেটা অবশ্য মাটি খুঁড়ে রেখেছে, কারন অজানা। হয়তবা শাসকের প্রতীকী কবর খোঁড়া হল, বা অন্য কিছু। যাই হোক কোলকাতার অন্য অনেক রাস্তার নাম বদলালেও এই মেয়ো বা ডাফরিন নামক ঔপনিবেশিক যুগের নাম গুলোকে আজও প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে বর্তমান দশকের ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে নির্বাচিত একটি ফ্যাসিস্ট সরকার। সেই একই রকমের মেজাজ, অত্যাচার ও বাকি সকল আনুসাঙ্গিক। বৃটিশ রাজে রাণীমা সুদূর ইংল্যান্ড থেকে অত্যাচার পরিচালিত করতেন; ইনিও লন্ডন করতে চেয়েছিলেন, আপাতত নবান্ন নামক লাটভবনের ত্রয়োদশ তলা থেকে সুষ্ঠু অত্যাচার পরিচালিত করেন। ইংরেজ লুন্ঠন করেছিল বনিকের ছদ্মবেশে শাসকের মসনদ দখল করে, ইনিও তাই। সততা বিক্রি করে, তৎকালীন উন্নাসিক ও অযোগ্য বাম নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগে ধাপ্পা দিয়ে বাংলার শাসন ক্ষমতাতে একটা নীতিহীন লুঠেরার দল নিয়ে জাঁকিয়ে বসে রয়েছেন।
একদা ওনার প্রিয় শব্দ ৪০০। তখন একরের গল্প ছিল, এখন ৪০০ জন যোগ্য কর্মপ্রার্থী। অনশনের বীভৎসতা ওনারই সরকারের তুঘলকি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।
যেটা বলছিলাম, ওই প্রেসক্লাবের ছায়া সুনিবিড় গলিপথটার মুখে দাঁড়িয়ে শুধু ঘাড়টা বাঁদিকে একটু ঘোরান, ব্যাস। গোধূলির যাবতীয় মলিনতা দেখতে পাবেন থরে থরে সাজানো কিছু মানুষ্যতর জাতীয় মুখে। উন্নয়ন শুয়ে আছে ফুটপাথে। হয় এরা মানুষ, নতুবা আমরা মানুষ; কারন এরা মানুষ হলে আমরা আবার মানুষ হবার যোগ্যতা হারায়। নিতান্ত ছাপোষা দেখতে, আটপৌরে কিছু যুবক যুবতী ফ্যাকাসে মুখে কিসের যেন প্রতীক্ষায় অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন ফুটপাতে অসহায় হয়ে, বসন্তের রূঢ় প্রকৃতি আর একটা ইতর শাসকের দম্ভের সাথে অসম লড়াই লড়ে চলেছে।
আজ ২৫ তম দিন।
আসলে ছেলেমেয়েগুলো বড় বোকা, তারা কোথাও লেখেনি “মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণাতে...” বাক্যবন্ধটি। লিখলে না জেনেও তিনু সমর্থকেরা অগ্নিকণ্যা জিন্দাবাদ বলে স্লোগান তুলতো। মাননীয়া এখন স্থাবক পরিবৃত্তা, কালিঘাটের বসত বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দুরত্বে প্রায় চারশো SSC পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হবু শিক্ষক তাদের ন্যায্য চাকুরী না পেয়ে, দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে করতে মরিয়া হয়ে আমরণ অনশনে শুয়ে আছে। হ্যাঁ শুয়ে আছে, কারন বসে থাকার মত শক্তি আর নেই তাদের। ২৫ তম দিন!! নাহ, তারা মাননীয়ার মত চকোলেট, স্যন্ডুইচ খেয়ে ধর্ণা দিচ্ছেনা, দেশী বিদেশী মিডিয়ার বুমও নেই। সামান্য মাথার উপরে ছাউনি টাঙাবার অধিকার টুকুও নেই। তবে এরা ধনী, এদের প্রাণশক্তি আছে; দুরাচারী শাসকের চোখে চোখ অহিংস আন্দোলন করার জন্য যোগ্যতা রয়েছে।
এদের ডিগ্রী কোনো ভৌতিক ইষ্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির নয়, আমাদেরই রাষ্ট্রের কোনোনা কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও চাকুরীর চরম পরিক্ষাতেও উত্তীর্ণ। তাহলে এরা চাকুরী পেলনা কেন? কারন এদের চাকুরি বিক্রি হয়ে গেছে অযোগ্যদের কাছে মোটা অর্থের বিনিময়ে। এদের কাছে ঘুষ দেবার মত অর্থ নেই বা থাকলেও দেবেনা। যে ঘুষের পোষাকি নাম এ রাজ্যে ‘উন্নয়ন’, উন্নয়ন থাকলে যোগ্যতার পরিক্ষাও দিতে লাগেনা, কোচবিহারের তৃনমূল প্রার্থী তথা প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী শ্রীমান পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতাকেই দেখুন। ৭৫-২৫ এর অনুপাত মেনে স্থানীয় নেতার মাধ্যমে ঘুষের টাকা পৌঁছে দিন সততার বাড়িতে, আপনার চাকরি হয়ে যাবে। ওই টাকাতে ৭ তলা প্রাসাদে চলন্ত সিড়ি বসবে, বিদেশ থেকে কিলো কিলো সোনা এনে গহনা গড়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি যখন বাহ্যিক লোক ঠকানো টালির চাল আর হাওয়াই চটি দেখে শ্রদ্ধাতে মুর্চ্ছো যাবেন, ততক্ষণে ওনার চ্যালাচামুন্ডারা আপনার পকেট কেটে সাফ করে দেবে। রাস্তাজুড়ে লড়ি থেকে সিভিক আর্মি দিয়ে তোলা তুলতে ব্যাস্ত পুলিস, তাদের সময় কোথায়?
অসভ্যেরা অসভ্যতামি করবে এটাই দস্তুর। এ যাত্রাতে রাজ্যের শাসক ‘বর্বরতায়’ ফেল করেনি শেষ সাত বছরের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী। কিন্তু আমাদের বিরোধী দলগুলো? শক্তিশালী গণতন্ত্র গঠনে বিরোধী শক্তিশালী না হলে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দেয়। বলছিতো ঠিকিই, কিন্তু মানছে বা করছেটা কে? সত্যিকথা বলতে পার্টি অফিস আর কয়েকজন জীবন্ত জীবাশ্ব নেতা ছাড়া ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কোলকাতার ২০০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে নেই। বিজেপি নামক দলটি ওই দাঙ্গা, মন্দির-মসজিদ, লুঠতরাজ, হুমকি, অশ্রাব্য বার্তালাপ, গরু-শুয়োর আর টিপিক্যাল ধান্দাবাজ প্রজাতি ইত্যাদি গুলোর সাথেই যায়। সভ্য ভদ্র সমাজে আজও বিজেপি-RSS পরজীবি জীবানু রূপেই পরিগণিত হয়, ও আগামীতেও হবে।
বাকি রইল বামফ্রন্ট। ফ্রন্টের কথায় বলি, এ বঙ্গে CPM ছাড়া বাকি শরিকেরা প্রায় সকলেই ছেলে বৌ বা নিজে প্রতক্ষ্য ‘উন্নয়নে’ সামিল হয়েছে লোভে বা ভয়ে। চটির ফিতেতে নতুন করে সংসার বেঁধেছেন ওনারা। বাকি রইল সিপিএম; কেন্দ্রীয় বা রাজ্য নেতৃত্ব। পঞ্চায়েত স্তরে এনারা CPM সেজে বিজেপিতে বা তৃনমূল নেতাদের আশ্রয়েই আছেন অধিকাংশ। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সিপিএম নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যই বর্তমানে মেয়াদ উত্তীর্ণ জীবনদায়ী ঔষুধ। খেলেও মৃত্যু না খেলেও ফল একই, বরং খেলে মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। আমরা যারা শুধুই বাম সমর্থক, বাম আদর্শকে বিশ্বাস করি বা ভালোবাসি তারা রয়ে গেছি আকুলপাথারে। বর্তমান নেতৃত্ব মনে ভাবে জনগণ বোধহয় এনাদের চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্ষমতাতে বসিয়ে দেবে। ৭ বছর অতিক্রান্ত, দীর্ঘদিন ক্ষমতার অলিন্দে বাস করায় আজও বিরোধী রাজনীতির সহজপাঠ টুকু শিখে উঠতে পারেনি। তাই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বা বলা ভাল মমতার ভুলের প্রতীক্ষা করছে প্রভু জগন্নাথ সেজে। শয়ে শয়ে ছটফটানো ইস্যু গুলো হাতের আঙুল গলে চলে যায়, কর্মী সমর্থকেরা চোরের দলের লুঠেরাদের হাতে ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পিষনে পিষতে থাকে। নেতারা বিপ্লবের ভোর খুঁজতে ব্যাস্ত পার্টি প্লেনামে বা কংগ্রেসে।
বিরোধী হিসাবে মমতা ব্যানার্জী আদর্শ হওয়া উচিৎ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে। যেকোনো আন্দোলনকে নিজের অনুকুলে ভিড়িয়ে ‘আমার’ বলে রীতিমত হাইজ্যাক করে পাবলিকের কাছে খবরে থাকতেন। এদিকে অনশনের ২৪ তম দিনে আমাদের বামফ্রণ্ট চেয়ারম্যানের মনে পড়ল ‘ওখানে তো একবার যাওয়া দরকার’। ধিক এই রাজনীতিতে। মহিলা সমিতির নামে পার্টির শয়েশয়ে হোলটাইমারদের কাজটাই বা কি? তারাও কি ওই মেয়েগুলোর সাথে রিলে করে বসতে পারতনা?
কটা দিন আগেই জাতীয় পতাকা নিয়ে কিছু স্বঘোষিত দেশপ্রেমী রাস্তায় রাস্তায় দেশদ্রোহী খুঁজে নিয়ে বেদম হুমকি বা মারধর করছিল। আজ তাদেরই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আপনারা যারা তৃনমূল সমর্থক তারাও কি এতটুকু খোঁজ নিয়েছে? আপনাদের ছেলেপুলেদের চাকরীর দরকার নেই? ভুলে যাবেননা শকুনের কোন বাছবিচার থাকেনা।
ত্রিশ ফুট বাই দশ/বারো ফুটের একটা ফুটপাত, সেখানে পশুখামারের মত গাদাগাদি করে কিছু ভদ্রঘরের শিক্ষিত সন্তান না খেয়ে অধিকার রক্ষার জন্য অহিংস লড়াই চালাচ্ছে। এদের অন্যায় এরা চপশিল্পকে অগ্রাহ্য করে পড়াশোনা চালিয়ে শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখেছিল। তাই ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মশার কামড়কে ছোঃ বলে হেলায় উড়িয়ে নির্ধ্বিধায় বসে থাকতে শিখেছে। ফুসফুসে ও মূত্রাশয়ে সংক্রমণ, নিন্ম রক্তচাপ, পিত্তবমন, স্নায়ু শৈথিল্য সহ নানান ধরনের অজানা রোগ বাসা বাঁধছে ওদের শরীরে। সরকারী হাসপাতালে গেলে থুড়িবুড়ি করে স্যালাইন দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে, চিকিৎসা নৈব নৈব চ। রাজ্যজুড়ে প্রার্থী তালকাতে কত নামের আগে ডাঃ শব্দটি লেখা। মুখ্যমন্ত্রীর সাধের কন্যাশ্রী, রুপশ্রী প্রকল্পের গালভরা প্রচারের সাথে নারী শক্তির উপরে জোর দিয়ে শতাব্দী, অর্পিতা ঘোষ, মুনমুন সেন থেকে মিমি বা ধর্ষকের প্রেয়সী ও প্রশ্রয়দাত্রী নুসরত যখন স্নো পাউডার মেখে লোক ঠাকাতে ব্যাস্ত, তখন অনাহার, অপুষ্টি ও শহুরে বাতাসের জীবানু পোকামাকড়ের কামড় মেয়েগুলোর শ্রী’তে চর্মরোগ সৃষ্টি করেছে। এরা প্রতীকী, আসলে গণতন্ত্রের কাঠামোতে ঘুণ ধরে গেছে।
বেকারত্বের হরেক জ্বালা; সাথে আত্মসম্মান বোধ থাকলে তো পোয়া বারো। স্বাভাবিকভাবেই ভাঁড়ারে টান পড়লেও পাবলিক ফান্ডিং এর নাম শুনলেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখগুলোতেও ফুটে উঠছে প্রত্যয়- “আমাদের টাকার দরকার নেই, পাশে থাকুন। সাহস যোগান দয়াকরে”। তার পরেও মানবিক খাতিরে টিম অকপট সামান্য কিছু ORS সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রায় জোরকরে যখন দিয়ে এলো, আবেগে ওদের চোখে জল। তীব্র অভাব ওই একখন্ড ভূমি যেন আফ্রিকার সোমালিয়া। পানীয় জলের হাহাকার, প্রাত্যহিক বাহ্যকর্মের জন্যও ‘ব্যাওসা’ চলছে নিত্য। ড্রেনের দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলেও সইতে হচ্ছে, দরকার কিছু ব্লিচং পাওডারের; কিন্তু দিচ্ছেটা কে। যাননা এক কেজি ব্লিচিং নিয়ে ওই অনশন ফুটপাতে।
অদূরেই সাপ্তাহিক পুলিশি মাসোহারার বিনিময়ে গড়ে ওঠা গুমটিগুলোর ছায়াতে খোঁচা খোঁচা দাড়ির কঙ্কালসার অনসন কারী ছেলেগুলো জুলজুল চোখে ধুঁকছে। স্বপ্নগুলো একটু একটু করে হয়ত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, অনেকেরই আর পরীক্ষাতে বসার জন্য বয়স নেই। হয়ত জেদের বসে লাশ হয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের শকুনের প্রখর নজরে পাহারারত।
বিক্ষিপ্তভাবে অনেকেই আসছেন, আসবেও। কোটিপতি ক্রিকেট লীগের খেলাতে হাজার লোকের জমায়েত হয়েছে ফুর্তির জন্য, হাওয়াতে উড়ছে কোটি কোটি টাকা, অতঃপর উল্লাসের শব্দব্রম্ভও ঢাকা দিতে পারবেনা নৃশংস নীরবতার অনশন উদযাপনকে। গর্ভবতী মায়েরই কেবল গর্ভপাত হয়নি, বন্ধ্যা রাষ্ট্রও তৃনমূল নামক একটি অশিষ্ট দলের সাথে অবৈধ সঙ্গমে গণতন্ত্রের গর্ভপাত করিয়েছে।
এরা হেরে গেলে আপনিও আপনার সন্তানের জন্য হয় ২০-৩০ লক্ষ জোগার রাখুন নতুবা চপশিল্পে তার ভবিষ্যৎ লগ্নি হয়ে যাবে আপনা থেকেই। চাকরি অবশ্য দুটো থাকবে, প্রথমত দলদাস হয়ে চাটুকারবৃত্তি ; দ্বিতীয়টা সিভিক আর্মির মত মমতা ব্যানার্জী সৃষ্ট সরকারী চাকুরী। দৈনিক ২০০ টাকা রোজে।
বড় লজ্জা হয় বর্তমানে যারা পেশাগত ভাবে ইস্কুলে পড়ান। এদের সকলকে আমি শিক্ষক বলতে নারাজ, শিক্ষক হতে প্রয়োজন শিক্ষা, আর শিক্ষা আনে চেতনা। শিক্ষক পদে চাকুরীজীবি অধিকাংশই মানুষরূপী জীবজন্তু সম্প্রদায়ের; চেতনাই তো নেই, শিক্ষা পেয়েছে কোথায়? শিক্ষা বিনে শিক্ষকই কেমনে? ভালকে ভাল আর খারাপকে খারাপ যে বা যারা বলতে পারেনা তারা আর যাই হোক শিক্ষিত নন। মাসিক বেতনের সুরক্ষা এদের বিবেকের ঘরে মোটা স্বার্থপরতার আস্তরণ ফেলে দিয়েছে, যা প্রায় অভেদ্য। চোখে বেহায়াপনার ঠুলি লাগিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই বসন্ত উৎসবে মত্ত, এদেরই প্রায় প্রত্যেকের সন্তান বেসরকারি স্কুলে পড়ে। যারা বড় হয়ে ডাক্তার, প্রফেসর, বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে হয়ত, যদি না হয়? এমনই অনশনের জন্য প্রস্তুত থাকুন আপনারা। সেদিনও আপনি একা হয়ে যাবেন আজ যদি আপনি না যান। একই কথা বলব পুলিস সম্প্রদায়ের জন্য। আপনাদেরও DA নেই, আর যা পে-স্কেল, তাতে তুমুল পরিমাণে ঘুষের টাকা না জমাতে পারলে আপনার ছেলেকেও রেলের হকারি বা চপ সেন্টার খুলতে হবে।
তবে সবচেয়ে করুণা হয় সাংবাদিকতা পেশা যাদের তাদের জন্য। সংবাদ পত্র বা চ্যানেলের কেউ না কেউ মালিক থাকে, যাদের থাকে রাজনৈতিক পরিচয়। কাগজের সাংবাদিক বা চ্যানেলের এঙ্করকে ব্যাবসা দিতে হয় মালিকের সংবাদ ‘কোম্পানির’ জন্য। তাই যেখানে পয়সা, তাদের চাহিদা মত করেই খবর পরিবেশনা করা হয়। বাকি রইল কিছু ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিক, তাদের যা মেধা তাতে মুদি দোকানে কর্মচারিটি হওয়ারও অযোগ্য অতএব সাংবাদিক হয়ে যাও। স্বাভাবিক ভাবেই অনশনের ২০ দিন পর্যন্ত গণশক্তি কোনো মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে অনশনের খবর ছিলনা। প্রেসক্লাবের উঠোনেই কিন্তু এই অনশন চলছে, গুণে গুণে ২০ হাত দূরে তারা মঞ্চ বেঁধে বসন্ত উৎসব চালাচ্ছে।
আমরা, হ্যাঁ, আমরা ‘অকপট’ দলগত ভাবে, ফেসবুকে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পোষ্ট হওয়া ‘অনশন’ খবর গুলোকে জঙ্গি আন্দোলনের জন্য তীব্রভাবে প্রচার চালায় অনশনের ১৭ তম দিন থেকে। আজ ফেসবুক ভরে গেছে অনশনের পোষ্টে, মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। তাবড় রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব থেকে সামাজিক বরেণ্য মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমরা আমাদের উদ্দেশ্যে সফল; বন্ধু জয় ব্যানার্জী সহ সুব্রত মণ্ডল, তন্ময় হক, সৌরভ মাঝি, প্রদীপ শাসমল, তমাল বোসের মত যারা এই লড়াই এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাদের সাধুবাদ জানানোর ভাষা নেই। ওনাদের পাশে যান, কাছে যান, আপনাকে ভীষণ প্রয়োজন ওদের। অনেক অনেক সাহায্য প্রয়োজন তাদের, যা পৌছাচ্ছে তা বিস্তীর্ণ মরুভূমে একফোটা জল সম, আরো অনেক প্রয়োজন। আপনারা এগিয়ে আসুন সভ্য সমাজ।
স্বঘষিত কবিদের গোপনাঙ্গে ফুসকুড়ি উঠলে সেই ব্যাথাতে দুই পক্ষকালীন বেদনার কাব্য উৎসব চলে। যদিও উৎসবে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর একচেটিয়া পেটেন্ট, জঞ্জালসম কবিতা লিখনেও যেকোনো ফেবু সেলেব কবিকে গুণে গুণে ১০ গোল দেবেন। ফেসবুকের প্রায় প্রত্যেক কবিই আজ ভয়ঙ্করভাবে নিশ্চুপ, ব্যানানা ফ্লেভারের এক্সট্রা ডটেড কাব্যে নিজের সেলফি সহ কবিতার আস্তাকুড় জুড়ে থিকথিক করছে তাদের টাইমলাইন; শুধু এই ছেলেমেয়েগুলোর জন্য অবাক করা নিশ্চুপতা।
পশুপ্রেমীরা দোলে কুত্তাকে রঙ মাখানোর বিপক্ষে ইয়াব্বড় ধমকিওয়ালা পোষ্ট করেছে, কিন্তু অনশনে? মোটেই না। এরপর গালে রঙ মেখে প্রো-পিক বানিয়ে লাইক গুণে কমেন্টে ‘নেকুপুসু’ একঘেয়ে ঘেয়ো শব্দবন্ধ পড়ে পড়ে অর্গাজমের ফিলিং নিতে ব্যাস্ত। সমাজকর্মীদেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা, তারা বোধহয় কালীঘাটের ইশারার প্রতীক্ষাতে। তার সাথে রয়েছে ভোট রঙ্গ। প্রার্থীরা বেকারত্ব ঘোচাতে পাশে আছেন দলমত নির্বিশেষে। শুধু অনশনমঞ্চের ছেলেমেয়েগুলোই বিষয়টা জানতে পারলনা, তাদের বাড়িতে অবশ্যই হবু জনপ্রতিনিধিরা গিয়ে কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেবেন। সত্যিই আজ উন্নয়ন ফুটপাতে জীবন যৌবন বাজি রাখে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এটা দেখিয়ে কি কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার আসবে মমতার ঝুলিতে?
অপদার্থ শিক্ষামন্ত্রী, মাৎস্যন্যায়ের যুগ বলে কটা বছর ক্ষমতা ভোগ করে নিল। কাঠপিঁপড়ের ঝাঁকে এনাকে বসিয়ে দিলে সংলাপবাজি ভুলে পথে আসবেন এনারা। মমতা দক্ষিণ কোলকাতার স্তাবক ছাড়া কাওকে ক্ষমতা দেননি। সবকটা পদই আ-পদ। নিতান্ত অসভ্য এনারা, নুন্যতম লজ্জা শরমের বালাই টুকু নেই। ক্ষমতা আর অহংকারের দম্ভে এরা সপ্তমে চড়ে বসে। সামনেই ভোট, এবারে ভুল করলে গোটা রাজ্যজুড়ে ফুটপাত কম পড়বে অনশনে বসার জন্য।
রামায়নে রামচন্দ্র বনবাসে গেলে, ভাই ভরত দাদাবৌদিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জেদে যখন ঘাসের উপরে শুয়ে অনশনের প্রতিজ্ঞা করে বসলেন তখন দাদা রামচন্দ্র বুঝিয়েছিলেন- অনশন ব্রাহ্মণের কাজ ক্ষত্রিয়ের কর্ম লড়াই করা। ব্রাহ্মণের ধার কেউ পরিশোধ না করলে তারা গৃহস্থের দোরের সামনে অন্নবস্ত্র পরিত্যাগ করে শুয়ে থাকত। ব্রহ্ম হত্যার পাপ থেকে বাঁচতে গৃহস্থ যতশীঘ্র সম্ভব ধার পরিশোধ করত। মমতা ব্যানার্জী আপনি তো ব্রাহ্মণ কন্যা, ও নারী; একটু তো লজ্জা করুন। খান তিনেক প্রজন্মকে বেকারত্বের অভিশাপ দান করেছেন, এরাই আপনাকে ক্ষমতাতে এনেছিল। আজ রাষ্ট্রীয় পেশীশক্তি দমন করছেন।
তবে ক্ষত্রিয়ের হাতে কি কিছুই নেই? আছে আছে, রাজা কৌশিক বশিষ্ঠের আশ্রম আক্রমণ করে হেরে গোহারা হয়ে ব্রহ্মতেজের জন্য শিবের উদ্দেশ্যে অনশনে বসে রাজর্ষী বিশ্বামিত্র হয়ে ছিলেন। মুনিঋষিদের যে ধ্যান, সে তো অনশনেরই নামান্তর। মহিষাসুর সহ তাবড় দৈত্যকুলপতিরাও অনশনের অস্ত্রে দেবতার বর লাভ করেছিলেন। শুধুই কি সনাতন ধর্মে অনশন সিদ্ধ? মোটেই না , ইহুদিদের মোজেসও সিনাই পর্বতে দীর্ঘদিন অনশন করে তবেই অগ্নিগোলক রুপী ঈশ্বরের দেখা পেয়েছিলেন। ইসলামে মুহাম্মদ (সাঃ) হেরাগুহাতে অনশন করেছিলে আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য। খ্রীষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্মেও অনশনের গুরুত্ব অসীম। হোগেলপন্থী যুব মার্কসও নানা সময়ে অনশনের আশ্রয় নিয়েছিলে। তাই অনশন এক অতি প্রাচীন অস্ত্র।
প্রাক খ্রীষ্ট যুগে প্রাচীন আয়ারল্যান্ডে প্রথমবার অনশনকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। এটা ‘সিলাকান’ নামে পরিচিত ছিল সেই কালে। ১৯২৩ সালে এক ঘটনার পরিপেক্ষিতে প্রায় ৮০০০ মানুষ অনশন করেন। বিংশ শতকে বিভিন্ন ব্রিটিশ কারাগারে বন্দিদের মধ্যে অনশন আন্দোলন ভীষণ জনপ্রিয় ছিল, যাদের মধ্যে মেরিল ডানলপ নামে এক বন্দিকে মুক্তিও দেয় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। কারন তারা চায়নি ডানলপ শহীদ হোক। ১৮৬১ সালে প্রথমবারের জন্য ভারতে অনশনের লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়।
অনশনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, দেশীয় রাজনীতিতে স্বাধীনতার আগে যতীন দাস, গান্ধীজী, ভগত সিং ও স্বাধীনতার পরে পট্টী শ্রীরামালু থেকে ইরম শর্মিলা চানু হয়ে আজকের এই ছাত্রছাত্রীরা। কাকে খুঁজছিলেন? উনি চকোলেট আর স্যান্ডুইচ খেয়ে ধাষ্টামো মেরেছিলেন, ওটা অনশন ছিলনা- ছিল নাটক। যেমন আন্না হাজারে, আরেক বড় অনশন শিল্পী। অনেকেই জানেনা নরেন্দ্র মোদীও অনশন করেছে ৭২ ঘন্টা, এসি ঘরে বসে। আর সেটা ছিল ‘সম্প্রীতি ও সদ্ভাবনা’ শীর্ষক। হ্যাঁ ঠিকিই পড়ছেন। আরেক অভিনেত্রী তথা জননেত্রী জয়ললিতাও কাবেরী নদীর ইস্যু নিয়ে অনশন করেছিলেন।
ইডেন উদ্যানেও অন্ধকার নেমেছে, ক্ষণিকের উত্তেজনা সমাপ্ত হলে, অনেকগুলো টাকা খরচা করে ফুর্তি করে ফেরা জনগণ একবার হলেও দেখে যেতে পারেন, কিভাবে রাষ্ট্র মানুষকে পশুর মত করে তুলতে পারে। আজকাল কত রকমের ট্যুরিজম হয়, এটা নাহয় অনশন ট্যুরিজম বা ‘উন্নয়ন’ ট্যুরিজম এর নামে এদের কাছে একবার ঘুরে গেলেন। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, হতাশ হয়ে ফিরবেননা। বিবেককে জবাব দিয়ে পারবেননা দায়িত্ব নিয়ে বলছি। যেভাবেই হোক এদের পাশে ও সাথে থাকুন। এরা বড় অসহায়।
উন্মাদ হার্মাদ
২৪/০৩/২০১৯