একটা যা......তা......
*************
অন্তত খাতায় কলমে ১৯৪৭ সালে আমরা তা নাকি লাভ করেছি। আজ দীর্ঘ ৬৬ বছর
অতিক্রান্ত। ইতিহাসের বিচারে হয়তো এ সময় কাল টা হয়তো কিছুই নয়, কিন্তু
গড়পড়তা আম মানুষের অনেকের কাছে, এটা একটা গোটা আয়ুষ্কাল। তাই যখন বিশেষ
বিশেষ কিছু ঘটনা দেখি, স্বাধীনতা টা কেমন যেন অলঙ্কারিক মনে হয়। স্বাধীনতার
বোড়খার আড়ালে যখন একটা বিশেষ সমাজ কে , গোটা অবশিষ্ট বিশ্ব বা বলা ভাল
রাষ্ট্র অবিরত ধর্ষন করে চলেছে, তখন নিজেদের সত্যিই কেমন আতাকেলানে
কূষ্মাণ্ড বলে মনে হয়।মনে হয় স্বাধীন বলে কি সত্যিই কি কোন শব্দ অভিধানে
থাকা উচিৎ??
ঘটনার সুত্রপাত একটু অন্যভাবে হলো। এক অতি ঘনিষ্ট বন্ধুর সাংসারিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে আমি আর আমার আরেক ঘনিষ্ট সহচর রামচন্দ্র, বর্ধমানে কুচুট বলে এক স্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। ঝড় বৃষ্টির দিন আবার যখন তখন ভুমিকম্প হচ্ছে। তাছারা বাড়ি ফিরে “আত্মা”র উপর একটা জাম্পেশ করে রচনা লিখবো বলে মনে মনে তার ভাঁজছিলাম।
পথি মধ্যে ইসলামপুর নামক এক গ্রামে, সেই সুত্রেই গমন। গ্রামে যাবার রাস্তা টা, পাকা রাস্তা থেকে হঠাত সরু হয়ে গেছে MGNRSY এর রাস্তায় এসে, আর এটাও জীর্ন হতে হতে ৮-১০ কিলোমিটারের মাথায় এক্কে বারে কাঁচা আল পথে পরিনত হয়েছে। অনেক কষ্টে আমাদের ড্রাইভার কালু, সে পথ অতিক্রম করে প্রায় ১২-১৫ কিলোমিটার পর গন্তব্যে পৌছালাম, আশ্চর্য হবার তখনো অনেক বাকি ছিলো। এই সকল গ্রামে সাধারনত মোটরবাইক ছাড়া কোন গাড়ি ঢোকে না। তাই বাচ্চা বা বয়স্কদের চারচাকা গাড়ির প্রতি একটা উৎসুখ থাকে, বাচ্চারা তো পিছনে উড়ে চলা ধুলোর সাথে পাল্লাদিয়ে দৌড়ায়। আজকেও দৌড়াচ্ছিলো।
গন্তব্যের একেবারে দোরগোড়ায় আমার হাল ফ্যাসানের সেডান কার পৌছাতে পারলো না, রাস্তা না থাকার দরুন। একটা মোড়ের মাথায় যখন দাড়ালাম। ততক্ষনে আমার দুধসাদা গাড়ি ধুলো আর কাদাতে মোটামুটি পিঙ্গল বর্ণ ধারন করে তার পূর্ব রুপ হারিয়েছে। গাড়ি থেকে নামতেই বেশ কিছু ছেলে চায়ের দোকান থেকে সেচ্ছাসেবকের কাজ করার জন্য দৌড়ে কাছে চলে এলো। গৃহ কর্তার নাম বলাতে , অতি উৎসাহে একটা দঙ্গল সামনে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
তাদের ই মধ্যে মোমিন বলে একটা ছেলের সাথে পরিচয় হলো। রাস্তা নেই কেন জিজ্ঞাসা করাতে , খুব তাচ্ছিল্যের সুরে উত্তর দিলো “শালো দের খেই নিবার পর থাকিলে তো দেবে, প্যেত্যেক সময় ভোটের বাবুরা যখন আসে, তখন বর্ষা, নৌকায় চড়ে আসে, তাই ওরা রাস্তা দেখতি পান না। তবে আমাদের কুনু অসুবিদা নেই, ছোটো থেকে একানেই মানুষ তো” । সরল স্বীকারোক্তি।
যেতে যেতে দেখলাম পুকুর ঘাটে সব ইলেকট্রিকের পোষ্ট গুলো শোয়ানো, গ্রামের ছেলে বউরা স্নান করা থেকে কাপর কাঁচা সবই করছে। ইলেকট্রিকের পোল এখানে কেন, জিজ্ঞেস করতে মোমিনের আবার উত্তর , “আর বোলো নি বাবু, কারেন দেবে বলে সেই কবে সরকার থেকে এগুলো পুতে দিয়ে গেছিলো, আমার ই বয়েস এই ধরো ২০ হতে চল্লো, তো আব্বারা সবাই মিলে ওই পুকুরে নাবিয়ে দিয়েচে, কিচু তো একটা কাজে আসচে, আমরা তো আবার মাজে ভেঙে নিয়ে ফুটবলের তেকাঠির বাঁশ বানিয়েছি” ।
কারেন্ট আছে না নেই সেটা জিজ্ঞাস করার সাহস পেলাম না। “হ্যারে তো কত ঘড়ের বাস তোদের এখানে??” , জবাবে পিছন থেকে একজন বলল, তা ধরুন গিয়ে ইসলামপুর-আকবপুর-নিমের-খুজারি-কোদপাড়া মিলে হাজার পনেরো লোকের বাস তো হবেই। মনে মনেই ভাবলাম, ১৫০০০ লোকের বাস, রাস্তা নেই – ইলেকট্রিক নেই!!!! এই পশ্চিমবঙ্গেই!! হায় রে স্বাধীনতা!!
হ্যারে তো মোবাইল চার্জ কোথায় দিস?? না এখানে কারো মোবাইল ই নেই?? আমি শুধালাম। মোমিন বললো,- নেই মানে? বরং বলো একেকজনের কটা করে আছে, একোন তো সব বাড়িতে ২-১ জন একোন কেরল গুজরাত দুবাই এ থাকে গো, টেকার গাদা সবার কাছে। ওই সকালে বাজারে গিয়ে চাজ দিয়ে নিয়ে আসে, ছোরা ছূরিরা তো আবার চাইনা মোবাইল নিয়েচে, ২-৩ টে করে বেটারি।
অভিষ্ট গন্তব্যে পৌছে মিনিট দশেকের একটা সাক্ষাতপর্ব সেরে নিয়ে, সদর দিয়ে বেড়োতেই একটা জটলা চোখে পড়লো। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতেই – একজন মধ্যবয়স্কা বৃদ্ধা পিছু থেকে ডাক দিলেন, “এ বাবু, সব লিয়া হয়ে গেচে”। আমি কিছু টা হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, আ...আমি তো কিছু নিতে আসিনি। এই এরসাদ চাচার সাথে একটু দেখা করতে এসেছিলাম। আবার বললেন “তো আমাদের নিয়ে যান না কেনে”। আমি আমল না দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। তার পর খুব করে কাকে বা বলা ভালো কাদের উদ্দেশ্যে, ঐ মহিলা গালি দিতে লাগলেন, উচ্চশ্বরে বিলাপ করে।
ব্যাপার টা আরো পরিষ্কার হলো যখন গাড়ির কাছে পৌছালাম, দেখি বেশ কিছু গ্রাম মেয়ে আমার গাড়ি প্রায় ঘেড়াও করে রেখেছে। সকলের ই বয়স অই ১৪-২০ এর মধ্যেই হবে। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে, একটু এদিক ওদিক তাকাতেই আমার ড্রাইভার, কালু কে ক্লিষ্ট অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। আমি ওকে ডেকে একটু খাটো গলায় বললাম, এরা কারা?? এক্সিডেন্ট করেছিস নাকি?? কালুর বেদনাতুর জবাব, “এরা সব পুবে খাটতে এসেছে, আমন ধান কাটার মুনিষ। ঝাড়খন্ড মেদনিপুর, মুর্শিদাবাদ আসাম থেকে সব এসেছে”।
আমি কিছুটা বিরিক্ত হয়ে বললাম, তো আমার আছে আবার চাঁদা টাদা নেবে নাকি?? দশ বিশ টাকা দিয়েই তো ঝামেলা বিদেয় করতে পারতিস। কালুর উত্তরটা আসা করিনি। বলল, “ওরা কাজের জন্যে এসেছে, তোমার খামারে ওরা কাজ করবে। এখন তুমিই ওদের বিদেয় করো”। যাই হোক, আমার তো জমি সব ভাগে দেওয়া আছে, আমার নিজের কোন চাষ নেই, এখানে এমনিই এসেছিলাম... ইত্যাদি বলে, ওদের হাতে ৫০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে বললাম , এগুলো ভাগ করে নিস, ৯-১০ জন ছিলো। ওরা মোটেও খুশি না হয়েই সরে দাঁড়ালো। এগিয়ে চললাম কুচুটের দিকে, এখান থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার।
যেতে যেতে রামচন্দ্র বললো, কাকা এরা কেন তোমার কাছে এসেছিলো বলো তো?? বললাম কেন? বলল, তোমার দামি গাড়ি দেখে, বড় গেরেস্ত বাড়ি কাজে যাবার বাসনায় এসেছিলো। এরা ওই সুদুর দেশ থেকে কেউ কেউ ৪-৫ দিন আগে, এক্কেবারে অক্ষম বৃদ্ধ ছাড়া পুরো ফ্যামিলি এই বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পরে, রোজগারের আশায়। জিজ্ঞেস করলাম, কার বাড়ি আসে? এদের চেনাজানা কে আছে? রাম বলল , কেউ নাই কাকা, এমনিই এরা আসে, বিভিন্ন বড় গ্রামের মোড়ের মাথায়, বট তলায় বা বাসস্ট্যন্ডের বিশ্রামাগারে, কারো বৈঠকখানার বারান্দা- পোড়ো বাড়ী, যেখানে সেখানে এরা বসে থাকে, ১ দিন, ২ দিন ৩ দিন। তার পর কোন গেরেস্তর সাথে চুক্তি হয়ে গেলে, তাদের বাড়ির গোয়াল ঘরের পাসে অস্থায়ি ত্রিপল বেঁধে আগামি ১৫-২০ দিনের ঠিকানা হবে, তারপর মজুরি আর সিধের চাল নিয়ে যে যার দেশে ফিরে যাবে। আবার বললাম এতে করে পোষায়?? ও বলল, নিশ্চই পোষায় না হলে আসে কেন!!
তাছারা ওই আছে তো, আমি বললাম কি?? ওই গো। যার জন্যে ওই ছুঁড়ি গুলো তোমার কাছে এসেছিলো।
- কি জন্য রে?
- ভালো বাবু পেলে সুন্দুরীদের খাতির একটু বেশী হয়, তাহলেই খেপে ৫০০-১০০০ টাকা বেশী রোজগার। খেয়াল করো নি, যে ওরা কেমন সেজেগুজে ছিলো!!
- না রে, কই তেমন তো কিছু খেয়াল করিনি। আর আমার ও সব দিকে নজর ও ছিলো না, তোর যেমন বিশাক্ত নজর।এবার তোর বিয়ে না দিলেই নয় দেখছি।
- আরে না গো, ওরা কি আর তোমার আমার বাড়ির মেয়ে বউ দের মত সাজবে, না সে সমর্থ ওদের আছে?? ওরা হাতে কাঁচের চুড়ি পরেছিলো, চুলে খোপা বেধেছিলো লাল কৃষ্ণচূড়া দিয়ে, ১ -২ জন তো আবার ঠোঁটে লিপস্টিক ও দিয়েছিলো। আর ওই মেয়ে মানুষ টা তো এদের কে ই গাল দিচ্ছিলো।
- কেন রে?
- এদের জন্যেই নাকি ওরা শাঁসালো বাবু পাচ্ছে না। বুড়ি হয়ে যাচ্ছে না।
রামচন্দ্র আরো অনেক কিছুই বলছিল। আমার আর সে দিকে মন ছিলো না। ভাবছিলাম, এই কি ৬৮ বছর বয়স্ক আমাদের স্বাধীনতা!! এ আমাদের কেমন অর্থব্যাবস্থা?? এতো সরকারি প্রকল্প, এতো উন্নয়নের বন্য, আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতি। সব মিথ্যা। পৌরসভা নির্বাচন, IPL, মোদীর মেট্রো যাত্রা, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঋণ নীতি, নেপালে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের সংখ্যা--- সব মিথ্যা।
পেটই শুধু সত্য। আর খিদে, ভাতের খিদে। আজ ও মানুষ কে কুকুর বেড়ালের মত অন্য মানুষের মত দুয়ারে দুয়ারে ঘুড়ে বেড়াতে হয়, কাজের জন্য। খোঁয়াড়ের মধ্যে শুতে হয়। নির্লজ্জের মত সুন্দরী সাজতে হয়। মজার বিষয় হলো এই কাজ করতে আসা মানুষ গুলো নিজেদের মানুষ ভাবতে ভরষা হয় না, আর প্রায় অধিকাংশ গেরেস্ত এদের মানুষ বলে স্বিকার করে না। কারন এরা তো মুনিষ।
এরা জানে!! স্বাধীনতা কি?? মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধই হোক বা আমেরিকার বিদেশ নীতি বা আমাদের এই ভার্চুয়াল দুনিয়া, এরা হয়ত নাম ই শোনেন নি। কেও শুনে থাকলেও সেটা বড়লোকের খেয়াল ব্যাতিত আর কিছু এরা ভাবতে পারবে না। সর্বগ্রাসী পেটের তারনায় এরা ছুটে বেড়াচ্ছে, এদেশ থেকে ওদেশ। এদের জন্য বিমা নেই, এদের জন্য কেও অনশন করে না, এদের ইউনিয়ন নেই, হরতাল নেই, বুদ্ধিজীবি-মোমবাত্তি- ফি সন্ধ্যায় টিভি চ্যানেলে কুকুর কেত্তন। কিচ্ছু নেই। তবে এরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এনারাও গনতন্ত্রে বাস করেন।অনেকে আবার ভোট নাকি দেন, কাজ না থাকলে।
অন্ধকার হয়ে আসছিলো, ঘন কালো করে মেঘ করেছে... তাই মুখ লুকাতে কষ্ট করতে হলো না। এসি চলছিলো বলে আগেই জানালার কাঁচ তোলা ছিলো। এসির ঠান্ডা হাওয়াতেই বোধহয় চোখে একটু জল এসেছিলো। আমার আবার ঠান্ডায় এলার্জির ধাত আছে কিনা, আসলে সুখী মানুষ তো!! ওরা হয়তো এর তার বাড়ির দাওয়াত কোনমতে মাথা গুঁজেছে। আচ্ছা, ওই মেয়ে গুলো কি মনের মোতো কোন বাবু পেল?? আর ওই মধ্যবয়সী মেয়েমানুষ টা?? আর ওদের সাথে থাকা বাচ্চা গুলো, যারা তাদের বাবা মায়ের নিয়ে আসা যথসামান্য মালপত্রের বস্তার উপরে বসে, আদতে সেটা পাহাড়া দিচ্ছিলো?? সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো...............
দু এক ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো, এক্ষুনি ওরা ঝমঝমিয়ে এসে পরবে, ওরা তো স্বাধীন। ওদের গনতন্ত্র লাগেনা। বৃষ্টির জলে রাস্তার সমস্ত ধুলো কাদা ধুয়ে আরো নিকশ কালো অজগরের মত শুয়ে রয়েছে। স্বাধীনতা আরো নতুন নতুন পাঁকের মাঝে রোজ একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। রামচন্দ্র তখন ও কিছু একটা বলেই চলেছে। দু ধারে সোনালী ধানের ক্ষেত ওই দূরে দিগন্ত কে স্পর্শ করেছে। গাড়ির সাদা রঙ টা নিশ্চই এতোক্ষনে আবার ফিরে এসেছে।
মোবাইলের ঘন্টিতে, হঠাত চকিতে ঘোর কাটলো, উইন্ডস্ক্রিনে বৃষ্টির ধারা প্রচন্ড ক্রুদ্ধতার সাথে করাঘাত করছে। ওয়াইপার গুলো যেন “ওদের” মত একবার এদেশ আর ওদেশ করে চলেছে, নিরন্তর ভাবে। কুচুট ও এসে পরব খানিকক্ষণের মধ্যেই। এর মধ্য কালু বাবা দেখি মিউজিক সিষ্টেমে গান লাগিয়েছে......
“ভগবান হ্যায় কাহা রে তু......” কে জানে ইনি স্বাধীন কি না!!!
*************
আমরা স্বাধীন?
ঘটনার সুত্রপাত একটু অন্যভাবে হলো। এক অতি ঘনিষ্ট বন্ধুর সাংসারিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে আমি আর আমার আরেক ঘনিষ্ট সহচর রামচন্দ্র, বর্ধমানে কুচুট বলে এক স্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। ঝড় বৃষ্টির দিন আবার যখন তখন ভুমিকম্প হচ্ছে। তাছারা বাড়ি ফিরে “আত্মা”র উপর একটা জাম্পেশ করে রচনা লিখবো বলে মনে মনে তার ভাঁজছিলাম।
পথি মধ্যে ইসলামপুর নামক এক গ্রামে, সেই সুত্রেই গমন। গ্রামে যাবার রাস্তা টা, পাকা রাস্তা থেকে হঠাত সরু হয়ে গেছে MGNRSY এর রাস্তায় এসে, আর এটাও জীর্ন হতে হতে ৮-১০ কিলোমিটারের মাথায় এক্কে বারে কাঁচা আল পথে পরিনত হয়েছে। অনেক কষ্টে আমাদের ড্রাইভার কালু, সে পথ অতিক্রম করে প্রায় ১২-১৫ কিলোমিটার পর গন্তব্যে পৌছালাম, আশ্চর্য হবার তখনো অনেক বাকি ছিলো। এই সকল গ্রামে সাধারনত মোটরবাইক ছাড়া কোন গাড়ি ঢোকে না। তাই বাচ্চা বা বয়স্কদের চারচাকা গাড়ির প্রতি একটা উৎসুখ থাকে, বাচ্চারা তো পিছনে উড়ে চলা ধুলোর সাথে পাল্লাদিয়ে দৌড়ায়। আজকেও দৌড়াচ্ছিলো।
গন্তব্যের একেবারে দোরগোড়ায় আমার হাল ফ্যাসানের সেডান কার পৌছাতে পারলো না, রাস্তা না থাকার দরুন। একটা মোড়ের মাথায় যখন দাড়ালাম। ততক্ষনে আমার দুধসাদা গাড়ি ধুলো আর কাদাতে মোটামুটি পিঙ্গল বর্ণ ধারন করে তার পূর্ব রুপ হারিয়েছে। গাড়ি থেকে নামতেই বেশ কিছু ছেলে চায়ের দোকান থেকে সেচ্ছাসেবকের কাজ করার জন্য দৌড়ে কাছে চলে এলো। গৃহ কর্তার নাম বলাতে , অতি উৎসাহে একটা দঙ্গল সামনে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
তাদের ই মধ্যে মোমিন বলে একটা ছেলের সাথে পরিচয় হলো। রাস্তা নেই কেন জিজ্ঞাসা করাতে , খুব তাচ্ছিল্যের সুরে উত্তর দিলো “শালো দের খেই নিবার পর থাকিলে তো দেবে, প্যেত্যেক সময় ভোটের বাবুরা যখন আসে, তখন বর্ষা, নৌকায় চড়ে আসে, তাই ওরা রাস্তা দেখতি পান না। তবে আমাদের কুনু অসুবিদা নেই, ছোটো থেকে একানেই মানুষ তো” । সরল স্বীকারোক্তি।
যেতে যেতে দেখলাম পুকুর ঘাটে সব ইলেকট্রিকের পোষ্ট গুলো শোয়ানো, গ্রামের ছেলে বউরা স্নান করা থেকে কাপর কাঁচা সবই করছে। ইলেকট্রিকের পোল এখানে কেন, জিজ্ঞেস করতে মোমিনের আবার উত্তর , “আর বোলো নি বাবু, কারেন দেবে বলে সেই কবে সরকার থেকে এগুলো পুতে দিয়ে গেছিলো, আমার ই বয়েস এই ধরো ২০ হতে চল্লো, তো আব্বারা সবাই মিলে ওই পুকুরে নাবিয়ে দিয়েচে, কিচু তো একটা কাজে আসচে, আমরা তো আবার মাজে ভেঙে নিয়ে ফুটবলের তেকাঠির বাঁশ বানিয়েছি” ।
কারেন্ট আছে না নেই সেটা জিজ্ঞাস করার সাহস পেলাম না। “হ্যারে তো কত ঘড়ের বাস তোদের এখানে??” , জবাবে পিছন থেকে একজন বলল, তা ধরুন গিয়ে ইসলামপুর-আকবপুর-নিমের-খুজারি-কোদপাড়া মিলে হাজার পনেরো লোকের বাস তো হবেই। মনে মনেই ভাবলাম, ১৫০০০ লোকের বাস, রাস্তা নেই – ইলেকট্রিক নেই!!!! এই পশ্চিমবঙ্গেই!! হায় রে স্বাধীনতা!!
হ্যারে তো মোবাইল চার্জ কোথায় দিস?? না এখানে কারো মোবাইল ই নেই?? আমি শুধালাম। মোমিন বললো,- নেই মানে? বরং বলো একেকজনের কটা করে আছে, একোন তো সব বাড়িতে ২-১ জন একোন কেরল গুজরাত দুবাই এ থাকে গো, টেকার গাদা সবার কাছে। ওই সকালে বাজারে গিয়ে চাজ দিয়ে নিয়ে আসে, ছোরা ছূরিরা তো আবার চাইনা মোবাইল নিয়েচে, ২-৩ টে করে বেটারি।
অভিষ্ট গন্তব্যে পৌছে মিনিট দশেকের একটা সাক্ষাতপর্ব সেরে নিয়ে, সদর দিয়ে বেড়োতেই একটা জটলা চোখে পড়লো। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতেই – একজন মধ্যবয়স্কা বৃদ্ধা পিছু থেকে ডাক দিলেন, “এ বাবু, সব লিয়া হয়ে গেচে”। আমি কিছু টা হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, আ...আমি তো কিছু নিতে আসিনি। এই এরসাদ চাচার সাথে একটু দেখা করতে এসেছিলাম। আবার বললেন “তো আমাদের নিয়ে যান না কেনে”। আমি আমল না দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। তার পর খুব করে কাকে বা বলা ভালো কাদের উদ্দেশ্যে, ঐ মহিলা গালি দিতে লাগলেন, উচ্চশ্বরে বিলাপ করে।
ব্যাপার টা আরো পরিষ্কার হলো যখন গাড়ির কাছে পৌছালাম, দেখি বেশ কিছু গ্রাম মেয়ে আমার গাড়ি প্রায় ঘেড়াও করে রেখেছে। সকলের ই বয়স অই ১৪-২০ এর মধ্যেই হবে। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে, একটু এদিক ওদিক তাকাতেই আমার ড্রাইভার, কালু কে ক্লিষ্ট অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। আমি ওকে ডেকে একটু খাটো গলায় বললাম, এরা কারা?? এক্সিডেন্ট করেছিস নাকি?? কালুর বেদনাতুর জবাব, “এরা সব পুবে খাটতে এসেছে, আমন ধান কাটার মুনিষ। ঝাড়খন্ড মেদনিপুর, মুর্শিদাবাদ আসাম থেকে সব এসেছে”।
আমি কিছুটা বিরিক্ত হয়ে বললাম, তো আমার আছে আবার চাঁদা টাদা নেবে নাকি?? দশ বিশ টাকা দিয়েই তো ঝামেলা বিদেয় করতে পারতিস। কালুর উত্তরটা আসা করিনি। বলল, “ওরা কাজের জন্যে এসেছে, তোমার খামারে ওরা কাজ করবে। এখন তুমিই ওদের বিদেয় করো”। যাই হোক, আমার তো জমি সব ভাগে দেওয়া আছে, আমার নিজের কোন চাষ নেই, এখানে এমনিই এসেছিলাম... ইত্যাদি বলে, ওদের হাতে ৫০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে বললাম , এগুলো ভাগ করে নিস, ৯-১০ জন ছিলো। ওরা মোটেও খুশি না হয়েই সরে দাঁড়ালো। এগিয়ে চললাম কুচুটের দিকে, এখান থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার।
যেতে যেতে রামচন্দ্র বললো, কাকা এরা কেন তোমার কাছে এসেছিলো বলো তো?? বললাম কেন? বলল, তোমার দামি গাড়ি দেখে, বড় গেরেস্ত বাড়ি কাজে যাবার বাসনায় এসেছিলো। এরা ওই সুদুর দেশ থেকে কেউ কেউ ৪-৫ দিন আগে, এক্কেবারে অক্ষম বৃদ্ধ ছাড়া পুরো ফ্যামিলি এই বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পরে, রোজগারের আশায়। জিজ্ঞেস করলাম, কার বাড়ি আসে? এদের চেনাজানা কে আছে? রাম বলল , কেউ নাই কাকা, এমনিই এরা আসে, বিভিন্ন বড় গ্রামের মোড়ের মাথায়, বট তলায় বা বাসস্ট্যন্ডের বিশ্রামাগারে, কারো বৈঠকখানার বারান্দা- পোড়ো বাড়ী, যেখানে সেখানে এরা বসে থাকে, ১ দিন, ২ দিন ৩ দিন। তার পর কোন গেরেস্তর সাথে চুক্তি হয়ে গেলে, তাদের বাড়ির গোয়াল ঘরের পাসে অস্থায়ি ত্রিপল বেঁধে আগামি ১৫-২০ দিনের ঠিকানা হবে, তারপর মজুরি আর সিধের চাল নিয়ে যে যার দেশে ফিরে যাবে। আবার বললাম এতে করে পোষায়?? ও বলল, নিশ্চই পোষায় না হলে আসে কেন!!
তাছারা ওই আছে তো, আমি বললাম কি?? ওই গো। যার জন্যে ওই ছুঁড়ি গুলো তোমার কাছে এসেছিলো।
- কি জন্য রে?
- ভালো বাবু পেলে সুন্দুরীদের খাতির একটু বেশী হয়, তাহলেই খেপে ৫০০-১০০০ টাকা বেশী রোজগার। খেয়াল করো নি, যে ওরা কেমন সেজেগুজে ছিলো!!
- না রে, কই তেমন তো কিছু খেয়াল করিনি। আর আমার ও সব দিকে নজর ও ছিলো না, তোর যেমন বিশাক্ত নজর।এবার তোর বিয়ে না দিলেই নয় দেখছি।
- আরে না গো, ওরা কি আর তোমার আমার বাড়ির মেয়ে বউ দের মত সাজবে, না সে সমর্থ ওদের আছে?? ওরা হাতে কাঁচের চুড়ি পরেছিলো, চুলে খোপা বেধেছিলো লাল কৃষ্ণচূড়া দিয়ে, ১ -২ জন তো আবার ঠোঁটে লিপস্টিক ও দিয়েছিলো। আর ওই মেয়ে মানুষ টা তো এদের কে ই গাল দিচ্ছিলো।
- কেন রে?
- এদের জন্যেই নাকি ওরা শাঁসালো বাবু পাচ্ছে না। বুড়ি হয়ে যাচ্ছে না।
রামচন্দ্র আরো অনেক কিছুই বলছিল। আমার আর সে দিকে মন ছিলো না। ভাবছিলাম, এই কি ৬৮ বছর বয়স্ক আমাদের স্বাধীনতা!! এ আমাদের কেমন অর্থব্যাবস্থা?? এতো সরকারি প্রকল্প, এতো উন্নয়নের বন্য, আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতি। সব মিথ্যা। পৌরসভা নির্বাচন, IPL, মোদীর মেট্রো যাত্রা, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঋণ নীতি, নেপালে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের সংখ্যা--- সব মিথ্যা।
পেটই শুধু সত্য। আর খিদে, ভাতের খিদে। আজ ও মানুষ কে কুকুর বেড়ালের মত অন্য মানুষের মত দুয়ারে দুয়ারে ঘুড়ে বেড়াতে হয়, কাজের জন্য। খোঁয়াড়ের মধ্যে শুতে হয়। নির্লজ্জের মত সুন্দরী সাজতে হয়। মজার বিষয় হলো এই কাজ করতে আসা মানুষ গুলো নিজেদের মানুষ ভাবতে ভরষা হয় না, আর প্রায় অধিকাংশ গেরেস্ত এদের মানুষ বলে স্বিকার করে না। কারন এরা তো মুনিষ।
এরা জানে!! স্বাধীনতা কি?? মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধই হোক বা আমেরিকার বিদেশ নীতি বা আমাদের এই ভার্চুয়াল দুনিয়া, এরা হয়ত নাম ই শোনেন নি। কেও শুনে থাকলেও সেটা বড়লোকের খেয়াল ব্যাতিত আর কিছু এরা ভাবতে পারবে না। সর্বগ্রাসী পেটের তারনায় এরা ছুটে বেড়াচ্ছে, এদেশ থেকে ওদেশ। এদের জন্য বিমা নেই, এদের জন্য কেও অনশন করে না, এদের ইউনিয়ন নেই, হরতাল নেই, বুদ্ধিজীবি-মোমবাত্তি- ফি সন্ধ্যায় টিভি চ্যানেলে কুকুর কেত্তন। কিচ্ছু নেই। তবে এরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এনারাও গনতন্ত্রে বাস করেন।অনেকে আবার ভোট নাকি দেন, কাজ না থাকলে।
অন্ধকার হয়ে আসছিলো, ঘন কালো করে মেঘ করেছে... তাই মুখ লুকাতে কষ্ট করতে হলো না। এসি চলছিলো বলে আগেই জানালার কাঁচ তোলা ছিলো। এসির ঠান্ডা হাওয়াতেই বোধহয় চোখে একটু জল এসেছিলো। আমার আবার ঠান্ডায় এলার্জির ধাত আছে কিনা, আসলে সুখী মানুষ তো!! ওরা হয়তো এর তার বাড়ির দাওয়াত কোনমতে মাথা গুঁজেছে। আচ্ছা, ওই মেয়ে গুলো কি মনের মোতো কোন বাবু পেল?? আর ওই মধ্যবয়সী মেয়েমানুষ টা?? আর ওদের সাথে থাকা বাচ্চা গুলো, যারা তাদের বাবা মায়ের নিয়ে আসা যথসামান্য মালপত্রের বস্তার উপরে বসে, আদতে সেটা পাহাড়া দিচ্ছিলো?? সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো...............
দু এক ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো, এক্ষুনি ওরা ঝমঝমিয়ে এসে পরবে, ওরা তো স্বাধীন। ওদের গনতন্ত্র লাগেনা। বৃষ্টির জলে রাস্তার সমস্ত ধুলো কাদা ধুয়ে আরো নিকশ কালো অজগরের মত শুয়ে রয়েছে। স্বাধীনতা আরো নতুন নতুন পাঁকের মাঝে রোজ একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। রামচন্দ্র তখন ও কিছু একটা বলেই চলেছে। দু ধারে সোনালী ধানের ক্ষেত ওই দূরে দিগন্ত কে স্পর্শ করেছে। গাড়ির সাদা রঙ টা নিশ্চই এতোক্ষনে আবার ফিরে এসেছে।
মোবাইলের ঘন্টিতে, হঠাত চকিতে ঘোর কাটলো, উইন্ডস্ক্রিনে বৃষ্টির ধারা প্রচন্ড ক্রুদ্ধতার সাথে করাঘাত করছে। ওয়াইপার গুলো যেন “ওদের” মত একবার এদেশ আর ওদেশ করে চলেছে, নিরন্তর ভাবে। কুচুট ও এসে পরব খানিকক্ষণের মধ্যেই। এর মধ্য কালু বাবা দেখি মিউজিক সিষ্টেমে গান লাগিয়েছে......
“ভগবান হ্যায় কাহা রে তু......” কে জানে ইনি স্বাধীন কি না!!!
*********
উন্মাদ হার্মাদ
*********