উন্মাদীয় রবিবাসর
সালটা ২০০৮ এর সেপ্টেম্বর। মাঝরাত্রে হঠাৎ ই উন্মাদী খেয়াল মাথায় ভর করলো।
অগত্যা গন্তব্য সেই ভাঙাকুলো সন্তু। ভাল নাম দেবব্রত। তখন রাত বোধহয়
দেড়টা, ল্যান্ড ফোনের অপর প্রান্তে ঘুম জরানো গলায় “হ্যালো কে বলছেন”,
এই আমি রে...
সাথে সাথেই অবস্থার পরিবর্তন, আষাঢ়ের বর্ষনের ন্যায়, বড় কুটুম্ব,
বোকাহাদা, কার যেন ভাই ইত্যাদি তে ভুষিত করে, শেষে শুধালো, বল কি খবর,
বললাম..., “আমার না খুব বেড়ানো পেয়েছে, কোথাও গেলে হয় না রে! ঘরে খুব দম
বন্ধ লাগছে”
...কোথায় যাবি?
...তা জানি না, ঠিক করিনি, এক কাজ কর ভোরে স্টেশনে গিয়ে ঠিক করবো।
সে যাই হোক, বাড়িতে কাওকে কিচ্ছুটি না বলেই ভোর বেলা হাওয়া। সকালে যথারিতী
ট্রেনের টিকিট পেলাম না, অগত্যা ঠিক করলাম, প্রথম বাস টা যে দিকের পাবো
সেটাতেই চাপবো। দেখলাম বহরমপুরের। চলো দিল্লি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। চেপে
পড়লাম। ৩৪ নং জাতীয় নরক থুরি সড়ক ধরে প্রায় চার ঘন্টার অসহ্য যন্ত্রনার পর
বেলা ১১ টা নাগাদ বহরমপুর পৌছালাম। সাথে লাগেজ বলতে সাকুল্যে একটি, দুজনের
মিলিয়ে, যার ভিতর শুধু ২ টো করে হাফ প্যান্ট, রুমাল, স্যান্ডো গেঞ্জি আর
অন্তর্বাস ,আমার ছিলো। পরনের গুলো বাদে এক্সট্রা একটাই টি সার্ট ছিলো।
দরকার পরলে কিনে নেবো, এই ভেবে রওনা দিয়েছিলাম আর কি। আর হ্যাঁ, নমিতা বিড়ি
ছিলো প্যাকেট ৪০ মত, আর আমার প্রিয় ব্রান্ডের সিগারেট গোল্ডফ্লেক গোটা দশ
প্যাক। সাবান, চিরুনি, টর্চ, ক্রিম, টিসু পেপার, বমি-মাথাব্যাথা-পায়খানার-অ
আর এস- গ্লুকোজ, মানে জরুরি ঔষুধ পত্র আমার রুকস্যাকেই থাকে। আর আমার
চিরসখা ল্যাপটপ। সাথে দূটো ফোন আর তাদের চার্জার। গোটা কয়েক এটিএম কার্ড।
দুপুরে লাঞ্চ টা বহরমপুরেই সারা হলো, বহরমপুরের গঙ্গার ব্রিজে কাজ চলার
দরুন প্রায় সারাটা দিনই, ওখানেই কেটে গেলো, রোড জ্যামে। বৈকালে গঙ্গার
পাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে শিলিগুড়ির বাস দে হাওয়া। অগত্যা একটা আলুর
লড়ির ড্রাইভার কে ম্যানেজ করে ডালখোলা পর্যন্ত যাওয়া নিশ্চিত করলাম।
কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ির নাগর দোলায় এক্কে বারে মরণ ঘুম, টানা ১০ ঘন্টা।
ডালখোলা এসেই খালাসি টার ডাকে চোখ খুললাম। তাদের নগদ বখশিশ দিয়ে বিদেয় করে
চা জল খাবার খেয়ে আবার বাসে করে শিলিগুড়ি। ঘন্টা তিনেক লাগলো।
শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ডে হাজার ট্রাভেল দালালের ভিড়। কোথায় যাবো পাজেল হয়ে
গিয়ে শেষে সন্তুর কথায় টস করে সিদ্ধান্ত হলো জঙ্গলে। তাহলে চলো লাটাগুড়ি।
পথের দুধারে অবিশ্রান্ত সবুজ। ঢেউ খেলানো নির্সগবিস্তৃত সবুজ চা বাগান, ছোট
ছোট সোঁতা-সাঁকো, চড়াই উৎরাই রাস্তা। যেন একটা ভাললাগার বই নিজে হতেই আপনা
আপনি পড়া হয়ে যাচ্ছে, যার নিজে থেকে পাতা উলটে যাচ্ছে। রাস্তার দুপাসে
স্থানীয়রা চা- বাগানে কর্মরত, ক্ষেতে কাজ করছে কেউ বা মাছ ধরছে...
গাড়ি থামিয়ে তাদের এক আধটা ছবিও তুলছি, কিন্তু ওরা যেন কেমন একটা তাচ্ছিল্য
ভরা দৃষ্টি তে আমাদের উপস্থিতি কে অগ্রাহ্য করছিলো। মানে মানে পাততাড়ি
গুটিয়ে আবার চলাতে মনোনিবেশ করলাম। অপূর্ব সুন্দুরী ডুয়ার্স তুমি। অদ্ভুত
এক ভালোলাগার মুখোমুখি আমি আর আমার কল্পনারা।
একটা ছোটো বাংলো
বুকিং ঐ বাসস্ট্যান্ডের দালাল বাবুদের কৃপাতেই করা হয়েছিলো। আর জঙ্গল
সাফারির গাড়িটা ও। মূল জঙ্গল থেকে ৫-৬ কিমি দূরে বাংলো টা, ছোট্ট করে। আসার
পথের চারিদিকে অগুন্তি ছোট বড় কাঠ চেরাই কল। কেন জানি না ওগুলো দেখে খুব
ভেতরে ভেতরে যন্ত্রনা হচ্ছিল।
তখন বেলা প্রায় ৩ তে। বাংলোতে পৌছে
স্নানাহার সেরে দে ঘুম। এমনিতেই সেপ্টেম্বর মাস, খুব একটা গরম ছিলো না।
ওদিকে সন্তু বাবা কত্থেকে দেখি একটা নিপ জোগার করে এনেছে, ও জানে আমি ও
রসের রসিক নই, তাই আমাকে চানাচুর শশা আর লেইজের প্যাকেট টা এগিয়ে দিয়ে ও
একা একাই চিয়ার্স করে খানিক পরেই ফুটুর দুম। আমি আর কি করি রাত ন টা
পর্যন্ত একা একাই টিভির চ্যানেল সার্ফ করে অনিচ্ছার ঘুম।
ভোরে
ড্রাইভারের ডাকে ঘুম ভাঙলো। একটা সাফারি জিপ ভাড়া করেছিলাম। ১৫-১৬ বছরের
বাচ্চা ছেলে, নাম সুজয়। বললো , চলুন স্যার, সক্কাল সক্কাল না গেলে অনেক
কিছুই মিস করবেন। প্রথমেই এন্ট্রি ফি। এক ধারে জঙ্গল আর অন্য ধারে চা
বাগান। সবে সূর্য হামাগুড়ি দিচ্ছে, কি যে এক মায়াবী আবেশ...
এবার
আমাদের সাথে একজন গাইড কে দেওয়া হলো, নাম মংলু, আদিবাসী সুঠাম ছেলে, আমাদের
সমবয়সীই হবে। সে বললো, পশুপাখিদের কোন খাবার দেওয়া যাবে না, প্লাস্টিক
ফেলা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। গায়ে জলপাই ছোপের পোশাক, আমারাও হাফ প্যান্ট
পরে, ফুলস্লিভ টিসার্ট, আর পায়ে স্নিকার্স, সন্তুর পিঠে রুকস্যাক, আমার
গলায়, বাইনোকুলার আর ছবি তোলার জন্য হাতে ক্যামেরা আর হালে কেনা আইফোন টা।
এক দিনের জন্য চার জনের পর্যাপ্ত খাবারদাবার আর জল।
প্রথমে লাল
সুড়কি বিছানো পথ। আসতে আসতে চলছি যতটা নিঃশব্দে যাওয়া যায়।। যত এগোই পথের
লাল সুড়কিও ধীরে ধীরে এল্যিফ্যান্ট ঘাসের দখলে যেতে যেতে ক্ষীণকায় গাড়ির
চাকার রেখাতে পরিনত হয়েছে। পথের দুধারে গামারি, লুম্পাতি, সিমুল, পানিসাস,
চিকরাসি , টুন কত অজস্র আরো নাম না জানা গাছের সারি, না গুলো গাইড ই
চেনাচ্ছিলো। মাঝে মাঝেই এক দুটো ময়ুরের দেখা মিলছে , নানা ধরনের চেনা অচেনা
পাখীর দল এই জঙ্গলের নীরবতা ভঙ্গ করে চলেছে। গাছে গাছে কত নিত্য নতুন
ধরনের লতানে ফুলের সাথে সুন্দর অর্কিড। পাতারই যে এতো বাহার হতে পারে, যে
না এসেছে তিনি কল্পনাও করতে পারবেন না। উঁচু লম্বা লম্বা গাছ গুলোর শাখা
প্রশাখা আর সবুজ ভেদ করে সূর্য কখনো কখনো ই মাটিতে এসে পৌছাচ্ছে, তাই হালকা
সবুজের সাথে গাঢ় সবুজ এই আলো আধারীর সাথে মিলেমিশে এক অদ্ভুত সম্মোহিত
পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
আশেপাশে আমরা চারজন ছারা কেও কোথাও নেই।
অরন্য যেন নিশির ডাকের মত হাতছানি দিয়ে ডাকছে।গন্তব্য ছিলো মেদলা, হাতি
সাফারি করার জন্য। যাত্রামঙ্গল ওয়াচ টাওয়ার থেকে শূন্য হাতে রওনা দিলাম
চুকচুকি ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। সেখানে মূর্তি নদীর তীরে গোটা কয়েক গন্ডার আর
দু একটা হরিণ ছারা আর কিছুই দেখতে পেলাম না। মনটা কেমন যেন উতালা হয়ে গেল।
আমি আর সন্তু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিলাম।
চুকচুকি থেকে ফেরার পথে
আমার আর সন্তুর মাঝে টেলিপ্যাথিতে আলোচনা পর্ব টা শেষ হয়ে গেলো, চোখ ছিলো
মাধ্যম। মিনিট পনেরো পরেই মারলাম গাড়ি থেকে ঝাঁপ। আর নেমেই দুজন মিলে
উদ্ধশ্বাসে দৌড়।এখানে একা একা জঙ্গলে যাওয়ার পার্মিসন পাওয়া যায় না। প্রায়
টানা মিনিট পনেরো কুড়ি ওই জঙ্গলের মাঝ খান দিয়ে এক উন্মাদ আর তার সাথী
মাতালের মত দৌড়াচ্ছে, সে এক চুরান্ত উন্মাদীয় এডভেঞ্চার। পিছন পিছন
ড্রাইভার আর গাইড খানিকটা এসেই হাল ছেরে দিয়েছিলো।
একটা বড় গাছের
গুড়ির নিচে বসলাম, এটা রিজার্ভ ফরেষ্ট হওয়ার জন্য মরা গাছ গুলোও কঙ্কাল
সমেত এখানেই পরে থাকে। কত নানারকমের পোকামাকরের যে ভিড় তার ইয়াত্তা নেই।
একটু হালকা টিফিন খেয়ে নিয়ে জুড়লাম হাটতে।পথের ধারে কত রংবেরঙের লতা, পাতা
ফুলের সমাহার, সত্যিই এভাবে না এলে জঙ্গল কে জানাই হলো না। পাইকারি হারে
প্রচুর ছবি তুললাম। বিকালের দিকে একটা নদীর ধারে পৌছালাম, জানি না কি তার
নাম। সারাদিন হেঁটে বেশ ক্লান্ত ও লাগছিলো। সামান্য কিছু খেতে বসলাম। নদীর
জল প্রচন্ড রকমের পরিষ্কার। পাসের গাছগুলোতে বাঁদরের দল জিমনাষ্টিক
দেখাচ্ছিলো।
কিছুটা এ্যালিফ্যান্ট ঘাস ছিড়ে নিয়ে তার উপর একটু চিৎ হয়ে
শুলাম, আকাশ শরৎ এর আকাশের মত, বনটিয়া-ময়না-বসন্তগৌড়ি- তিতির- কাঠঠোকরা-
ছাতারে- বুলবুল- দোয়েল, কত্তোরকম পাখীরা গাছের ফাঁকফোকরে লুকোচুরি খেলছে।
আর হ্যাঁ, একটা ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ সারাক্ষণ এই জঙ্গলে শোনা যায়, সেটা ধনেশ
পাখীর উপস্থিতি। রাতের বেলায় এই জঙ্গলে ভ্রমনের অনুমতি জোগাড় খুবই
কষ্টসাধ্য, মন চাইছিলো রাতে থেকে যেতে, কিন্তু তক্ষনি জঙ্গল থেকে কি ভাবে
লোকালয়ে ফিরবো, সেই ভাবনাই মাথায় জেঁকে বসল। এই জঙ্গলে তো চারটি নদী, এটা
কোন নদী! মূর্তী না জলঢাকা না গরাতী না ইংডং?? মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো,
সাথে সন্তুর অজস্র বাক্যবাণ।
এই জঙ্গলে ল্যেপার্ড ও থাকে বলে
শুনেছি, হাতি যেখানে সেখানে থাকতে পারে, বাঘ- সিংহ নেই তো আবার?? নিদের
পক্ষে পাইথন!! গোখুরো, চন্দ্রবোড়া কেউটে তো দু চার খানা দেখেও ফেলেছি, কি
জানি ও গুলো দাঁড়াস সাপ ও হতে পারে, ভয়ের চোখে সব যেন জাত সাপ দেখছি।
সকালেই তো মাতাল গাউর দের খ্যাপামি দেখেছি। কাদা পাঁকে ভরা নদী তীর, ইতস্তত
বেতের ঝাড় , মুলিবাসের বন। ওদিকে সূর্য ডুবেছে, আলোর রেশ টুকুও মিলানোর
পথে। টর্চ টা হাতে নিলাম, সারাদিন মোবাইলে ছবি তুলে চার্জ খতম, সন্তুর
নোকিয়া ১১০০ সেট, সিগনাল নেই। সম্পূর্ন দিশাহারা। তবে আজ ভাবি... ঠিক এটাই
তো চেয়েছিলাম।
তখন চাঁদ উঠেছে, আধ খাওয়া, এখন জঙ্গল ঘন অন্ধকার।
হাতড়ে হাতড়ে পথ খুজে চলেছি, একটা মর্কটের দল আমাদের পিছন পিছন চলেছে, বোধ
হয় তাদের হেব্বি মজা লাগছে আমাদের এই উন্মাদীয় পরিস্থিতি। মাঝে মাঝে এক
আধটা বনমুরগির ডানার ঝটপট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ভাম বা বনবিড়ালের হাত থেকে
পরিত্রান পেতে বোধ হয়।
কিছু দুরেই ঝোপ টা খানিক নড়ে উঠলো, আর একটা
অদ্ভুত ধরনের আওয়াজ, আঁতকে উঠে দুপা পিছিয়ে গেলাম, এমনিতেই আজ মশাদের নর
রক্তের নিমন্ত্রনের দিন, আমরা তাদের নিমন্ত্রন না করলেও তারা কিন্তু দলবেধে
আসতে ভুল করেনি। আবার ঝোপটা নড়ে উঠলো। সাহষ করেই টর্চ টা মারলাম। ভূত দেখার
মত চমকে উঠলাম। দেখি একটা মিসমিশে কালো মানুষের মতই কিছু একটা, ভূত হয়
তো?? আমাদের শহরে তো তেমন আর জাইগা নেই হয়তো ভূতেদের, তাই জঙ্গলেই আশ্রয়
নিয়েছে। সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আবার লাইট টা মারলাম, এবার সেই
জন্তু(!) টি দৌড় লাগালো সামনে। তখন বুঝলাম ওটা মানুষ ই। দু চার সেকেন্ড পর
সম্বিৎ ফিরিতেই আমরাও মরিয়া দৌড় শুরু করলাম, আর তার সাথে সন্তুর গগনভেদী
চ্যাঁচানো, দাঁড়া ব্যাটা দাঁড়া।
মিনিট পাঁচ সাত ওই রকম দৌড়ের পর
মানুষ টি থামলো। কাছে গিয়ে টর্চ টা জ্বালাতেই দেখি একটা বালক, ১০-১২ বছরের
বেশী বয়স হবার কথা নেই। কিন্ত এখানে এই জঙ্গলে মানুষ!! এই রাত্রিবেলা! শিশু
টারজান নয় তো! চোখে পিচুটি, মাথার চুল গুলো যেন হাসুয়া দিয়ে কাঁটা,
পাঁজরের সব কটি হাড় গোনা যাচ্ছে, কয়লা ও এর গায়ের রঙ দেখে লজ্জায় লাল হয়ে
যেতেই পারে। পড়নে... কি আবার , কিচ্ছু নেই। আমি যা প্রশ্ন করলাম তাকে,
সন্তু করলো তার চার গুন। কিন্তু সেই ব্যাটা নিরুত্তর। আচ্ছা ধারিবাজ তো রে।
তারপর কিছু নতুন ভাবার আগেই বালকটি হাটা জুড়লো, এমন ভাবে যে, শেষ
আধা ঘন্টায় যেন কিছুই হয় নি। আমরা উপায়ান্তর পিছু নিলাম। এখানে চাঁদের আলো
স্পষ্ট। রাস্তা বলে কিছু নেই, দুধারে মালাসা আর চেপাটি ঘাসের পুরু বন
সরিয়ে সরিয়ে যাওয়া। মিনিট ৪০ হাটার পর একটা তুলনা মুলক পরিষ্কার স্থানে
এলাম। টর্চের আলোয় যেটুকু বুঝলাম, এটি একটি পল্লী। এদিকে কিছু শাল,
শিরিষ,আমলকি চালতা নানা ধরনের গাছ। কিন্তু গ্রাম বটে, নিচে কোন ঘর নেই।
খানিক পরে জনা কুড়ি পুরুষ মহিলার আগমন, এবং তাদের মধ্যে একজনই পরিষ্কার,
মানে আমাদের বোধগম্য বাংলা জানেন, তার অজস্র প্রশ্নমালা রাহুল্ল দ্রাবিড়ের
স্টাইলে খেলে, মনে হল ওনারা মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়েছে।
ওদিকে সন্তু
এই গ্রামে আশা ইস্তকই, মাঝে মাঝেই মুর্চ্ছা যাচ্ছে। ভেবেই নিয়েছে আজ জংলী
দের হাতে প্রান যাচ্চছেই, কনফার্ম। ওকেই নাকি শিক কাবাব করে খাবে। ভেউ ভেউ
করে কাঁদছে মাঝে মাঝে। আমার মনেও যে সে ভাবনা আসেনি, তা নয়, তবুও তারমধ্যেই
কিছুটা নার্ভ শক্ত রেখেছিলাম। খানিক পর আমাদের একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।
চারিধারে সুপারি বা ঐ শ্রেনির খূটি জাতীয় গাছ, মাটি থেকে কমপক্ষে ১৫-২০ ফুট
উচুতে, বাস-কাঠ-আর বেত দিতে ছোট্ট ছোট্ট খুপরি ঘর। পাতি বাংলায়
‘ট্রি-হাউস’। উপরে শন- আর শুকনো ঘাস দিয়ে ছাওয়া। বন্য জন্তুদের রক্ষা পাবার
একটা প্রয়াস। কষ্ট বলতে শুধু একটু বোটকা গন্ধ।
রাতেই আমাদের রাজসিক
নৈশভোজের ব্যাবস্থা হল। পোড়া মাটি-আলু, হালকা নুন আর লংকার পেষ্ট দিয়ে
ঝলসানো বুনোমুরগি, আর জীবনে প্রথম খাওয়া পিঁপড়ের ডিম। সারাদিনের ক্লান্তিতে
সেটাই গোগ্রাসে খেলাম। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল। খেতে খেতেই শুনলাম,
ওই ছেলেটি বোবা। সারাদিন বনে বনেই ঘুড়ে বেড়াই। নামটা কি যেন একটা বলেছিল।
ওরা নাকি আদিবাসী নয়। তারা আর্য। সেটা নিয়ে দেখলাম বেশ একটা গর্ব আছে। আরো
অনেক কথাই বলেছিলো, প্রচণ্ড ঢুলুনির চোটে সে সব আর খেয়াল নেই। সকালে এক জন
বিট অফিসের কিছু কর্মীর ডাকেই ঘুমটা ভাঙলো। তাদের জিপে করেই রওনা দিলাম,
ওই পল্লীকে বিদায় জানিয়ে। বহুকিছু জানার ইচ্ছা অপূর্ন রেখেই রওনা দিলাম।
এর পর সরকারি মুচলেকা আর জরিমানা দিয়ে, বনবাংলো হয়ে সন্ধের সময় NGP তে এসে
উপস্থিত হলাম। রাতের ট্রেনে বাড়ি।
সেদিন বাড়িতে খড় জাতীয় কুছুর নরম গদিতে শুয়ে
একটা স্বপ্ন দেখে ছিলাম, দেখি সেই জংলী ছেলেটা আমাকে বলছে জাগো... উন্মাদ
জাগো, সেদিন তুমি অনেক প্রশ্ন করেছিলে , আজ আমি এসেছি তোমাকে সেই সকল
প্রশ্নের উত্তর দিতে... জাগো... বলেই সে বলতে শুরু করলো...
আমি মণ্ডলীর শ্রেনিবিন্যাসের খন্দ,
যার স্পর্শতে সদা সর্বদা শঙ্কা,
মদীয় সৃষ্ট অশৌচ গুপ্তি, প্রক্ষালিত ঋষভ
বিষ্ঠাতে লব্ধকাম, মানবতার ডঙ্কা।
শ্লীলতার উপকন্ঠ হইতে বিযুক্ত আমি, দূরে...
কোন স্বতন্ত্র পল্লিতে, গোষ্ঠীগত;
ইতিহাস সাক্ষ্য, বেদের নির্যাস আরোপিত,
অচ্ছুৎ সংজনন, চর্তুবর্ণে নিহত।
জগুপ্সিত অভিধেও, প্রসব কালের সাথেই,
মদীয় ভগিনী প্রনরেনি ভার্যা,
রমন ক্রীড়া সরঞ্জাম তুল্য, অতিন্দ্র অস্পৃশ্য !
অঘোরীয় নহে, অতীব পূন্য কার্যা।
দীপনের রশ্মিবিচ্ছুরণ, দেবসেবা, আত্ম তেজ!
যদিত্ত সকলি ব্রাম্ভন্য সম্পদ;
আমরা জন্মদোষে দোষী, অস্বীকৃত কর্মযোগী
নিপীড়নের বর্ণশ্রম, শ্বাপদ।
মনুস্মৃতি আকর শাস্ত্র, যুদ্ধে কেবল ক্ষত্রীয়
অসূয়াভর শুশ্রূষা, কিন্তু আমি আর্য,
উৎপীড়নের সাধনি অঙ্গ, উদ্গমাখ্যান?
মঙ্গল্য হরষে উচ্ছিষ্ট যত বীর্য।
বেনিয়া চাতুর্য কুসীদ! তালুক! স্থাবর-অস্থাবর
অলীক কল্পন; সবই বৈশ্য কুক্ষিগত;
বাকি সমাজের যাহা কিছু বর্জ্য, উহাই মদীয়
নিষ্কার্য, আয়ুস্কালভর শুদ্ধিরত।
অনুলোম পরিপূরণে সবর্ণা সিদ্ধ, নষ্ট কেবলি
স্বীয়নারী, ভোগ্যবস্তু আরত্তা;
ব্রহ্ম পাদ সৃষ্ট মোরা, রদবার্ত্ম ধনোপার্জন,
আগড়া বসনে অস্তিমান সুদত্তা।
উন্নাসিক মনোবৃত্তি! সে আমারে নাহি সাজে,
আমি দীন, অতি হীন ক্ষুদ্র,
নীদাঘের কৃষ্ণবর্ন অম্বুদ রাজীর ন্যায় বৈভাষিক
আমিই সমাজের নিকৃষ্টতম! “শূদ্র”।
হঠাৎ ধরপড়িয়ে ঘুম টা ভেঙ্গে গেল, দেখি সামনে মা বলছেন, মানা করলে তো শুনবি
না, ঘুমের ঘোরে কি রকম ভুলভাল বকছিলি বল দেখি। আরো অনেক কিছুই বলছিলেন,
কিন্তু মন টা কি রকম যেন একটা অদ্ভুত ভাললাগার গ্রাসে ছিলো যে সে সব আর
শোনাই হয়ে উঠেনি।
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য, উন্মাদীয় বানানবিধিতে সজ্জিত একটি সম্পূর্ন উন্মাদীয় ভাবনার ফসল)
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
No comments:
Post a Comment