Monday, 7 July 2014

বালখিল্যতা

ছোট বেলার ঘটনা।

বিচিত্র ইচ্ছা আমাদের অনেকের ই থাকে। আমার সেকেন্ডারি স্কুলের সময়কার ঘটনা, বাবা মাত্র ৫০ পয়সা বরাদ্দ দিতেন, সারাদিনে, স্কুলে যাবার সময়। এখন বিড়ির নেশা থাকার দরুন, জমা তো দুরস্থান, উল্টে প্রচুর ধার থাকতো, যেগুলো উৎসবের মরসুমে পাওয়া ভেট থেকে শোধ করতাম। এক ভদ্রলোক যাকে আমরা সকলেই দাদা বলতাম। তাকে নিয়েই ঘটনা।

তাকে তো আমি সহ আমার বন্ধুমহলের প্রায় সকলেই জাতিশত্রু করে রেখেছিলাম। এই মাস ছয়েক আগে হঠাৎ দেখা, প্রায় ১৬ বছর পর। একটা হোটেলে খেতে গিয়ে। উনি চিনতে পারেন নি সেটাই স্বাভাবিক। আমি কাছে গেলাম, একটু হাসলাম। জড়িয়ে ধরলাম। বললো ওনার একমাত্র ছেলে নাকি বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নাকি আর ফেরেনি। বেঁচে আছে কিনা তাও জানেন না।

বেচারা একটু হতভম্বময় অপ্রস্তুত অবস্থা, বয়স প্রায় ৬০ এর উপর। গরীব, হোটেলের থালাবাসন ধোয় বোধহয়। আমি যথাসাধ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি সহ, কিছু নগদ ওনার হাতে দিয়ে এলাম।

আমার সাথের বন্ধু টি তো আকাশ থেকে পরলো, যে আমার হলো কি। অচেনা লোককে এভাবে...............

তখন ওকে বলিলাম:---
ইনি হলেন নারাণ দা, আমার বাবার ক্লাসমেট ছিলেন। আমার ভালোবাসা টা ওই জন্য নয়। আসলে আমি বহুদিন ওনাকে বাবা হিসাবে কামনা করেছি। এবং বড় হয়ে ওনার মত হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তো আর উনি জানতেন না। তাই আমার মনের এই স্পেশাল ইচ্ছার জন্য, কোন স্পেশাল খাতির ও পেতাম না। সেখান থেকেই রাগের সুত্রপাত।

-আমার বন্ধু টি বললো, তো ওনার সাথে তোর সম্পর্ক কি??

-আমি বললাম, ইনি আমাদের স্কুলের সামনে আলুকাবলি, ছোলা বারোভাজা, আচার, পেয়ারা, কামরাঙা, কয়েতবেল ইত্যাদি বিক্রি করতেন। ওনার একমাত্র ছেলে পরেশ ও আমাদের সাথেই পড়তো। টিফিনের সময় বা ছুটির সময়, ওনার ছেলে ওনাকে হেল্প করতো।

আমার পকেট তখন এমনিতেই গড়ের মাঠ। আমার বন্ধুদের ও তথৈবচ অবস্থা। ওই চটকা খাবার লোভ হতো। মাঝেমাঝে ফ্রি খাওয়াতেন অনেককেই। আবার ধারও দিতেন। সেটা আমি অধিকার ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু রোজ রোজ দেবেন কেন, আর ধার ই বা দেবেন কেন?? তাছারা ধারের কারবারে শোধ বলেও একটা চ্যাপ্টার আছে, আমি তো সেটা মানতাম না। রোজ ফ্রি তো দুরস্থান। তখন এখানে মানুষের অভাব টা একটু বেশিই ছিল। সেই থেকেই আমার রাগের সুত্রপাত।

বহুবার ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহি চেয়েছিলাম, যে ইনা কেই কেন আমার বাবা বানাওনি। কমপক্ষে ওই হেল্পারি করার ফাঁকে রোজ ও গুলো চাখতে তো পারতাম।ওনার ছেলের মত।

শেষে ওতে ফেল হয়ে, সিদ্ধান্তি নিয়ে ফেলেছিলাম। যে বড় হয়ে যদি কিছু হতেই, তো এই স্কুলের সামনে এই রকম একটা স্টল ঈ দেব। বিক্রিবাটা যা হলো হলো। বাকিটা আমিই খাবো। নিজের দোকান তো। সুতরাং পয়সা সেবার ঝামেলা টা থাকবে না।

সেই রাগ। আর রাগ থেকে শত্রু। শেষে তো স্কুলের পিছন গেট গিয়ে যাতায়াত করতাম, তখন ক্লাস সেভেন। তার পর হঠাৎ এই ভদ্রলোক গায়েব। খুব আনন্দ হয়েছিল, যে ব্যাটা ফ্রি দিবি না?? যাহ তোর দোকানটাই উঠে গেলো।

এখন বুঝি, ওনার ফ্রি খায়ানোর চোটে আর ধার শোধ না হিবার কারনে, পুঁজিতে টান পরেছিল, হয়তো অন্য বিকল্প কিছুর পেশা নিয়েছিলেন। বাকিটা আর জানি না। ছেলের পড়াশোনার পাসাপাসি সংসার চালানোর ও খরচ বাড়ছিলো। ক্লাস এইট থেকে নতুন দোকানদার বসতে শুরু করলো।

আমিও বাবার ব্যাবসার পার্টটাইম হেল্পার হয়ে যাওয়াতে, পকেটের টান তো ছিলোই না, উপরন্ত একটা পঞ্চাশ টাকার নোট সকল সময় পেনসিলের বাক্সে থাকতো।

সুতরাং এই নারাণ দা ই, আমার ব্যাবসায়িক জীবনের গুরু, যাকে দেখে নিজে কিছু ব্যাবসা করবো ভাবনা টা মাথায় এসেছিল।

আজকের দিনে নিছক মজার শোনাবে। কিন্তু সেদিনের ওই ১১-১২ বছরের ছেলের স্বপ্ন টাই আজকে ওই মানুষটিকে বুকে টেনে নিয়েছে। সময় চলে যায়, ওই সেইদিনকার হাসিমুখের নারান দার মুখটাকে মনে পরলেই, মনটা খুব নষ্টালজিক হয়ে যায়।

ভালো থেকো নারান দা।

No comments:

Post a Comment