ছোটবেলায় বাবা বলতেন "শাগ খেলে বাঘের বল"। যদিও তিনি ওটাকে শাকই বলতেন আমরা কচি কানে বাঘের সাথে মিলিয়ে শাগ শুনতাম।
এহেন পরিস্থিতিতে প্রতিদিননের মধ্যাহ্নভোজনে একটা বড় স্থান জুড়েই ছিল শাক অধ্যায়। আজও রয়েছে, তবে পছন্দের শাক গুলোই, অপছন্দ সব ডিলিট।
তখন সবে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু "বাঙালেরা" থিতু হয়ে আমাদের একালাতে একটা মিশ্র সংস্কৃতি নিয়ে এসেছেন। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মতা যারা এলাকার ২-৩ শ বছরের স্থায়ী বাসিন্দা তাদের হেঁসেলেও সেই পরিবর্তন কিছুটা হলেও ছাপ ফেলেছিল। বাজারে হরেক ধরনের শাকের চোখজোড়ানো ঢলঢলে উপস্থিতি, বাজারু মানুষকে কতদিন আর না টেনে পারবে।
অত:পর শৈশব থেকে সেই শাকের গল্প শুরু। এই শাক দিয়ে দিব্ব্যি মাছ টুকু ঢাকা দিয়ে দিতাম, সুতরাং পরিমান অনুমেয়।
যেটা খাওয়া মোটে পছন্দ করতামনা সেটা দিয়েই শুরু করি।
কুলেখাড়া নামের একধরনের গাঢ় কালচে সবুজ বর্ণের শাকের রস আমাদের দুই ভাইবোনের কাছে রীতিমত বিভীষিকা ছিল। যেমন তেতো, তেমন বিশ্রীভাবে একটা বোঁটকা গন্ধ যুক্ত। আজ নিজে খাওয়া ছেড়েছি, আর বাড়ির ছোটরা আমাদের শিশুকালের ত্রাসের দিনে ফিরে গেছে।
এর পর ছিল কালো কচি নিমপাতা সহযোগে কচি বেগুন ভাজা, ওটি ভাতে মিশিয়ে খেতে হত। সেটাও ছিল একধরনের থার্ডডিগ্রি।
ভাতে ঘি মেখে খাবেন শান্তিকরে? না তার উপায় টুকুও ছিলনা, ঘি এর মধ্যেই থাকত ভেজে পোড়া 'ব্রাহ্মী শাক"। যেটা মোটের উপরে তেতোই বটে। স্মৃতিশক্তির বৃদ্ধিতে নাকি এই শাক ভীষন উপকারি।
এছাড়া তেতোর দুনিয়াতে সজনে শাক, হেলেঞ্চা, শিউলিফুল, দ্রোণ ঝোঁপ এমনকি চিরতাও থাকত চক্রাকারে নিয়ম করে। আসলে পিত্ত, কৃমি আরো হরেক ভয়ঙ্কর(!) বিষয়- যেগুলো সম্বন্ধে মা নিজেও জানতেননা, সেই সব অজানা ভয়ে উপর্যুপরি আমাদের তেতো গেলাতেন।
এরই মাঝে কিছু সুখ ছিল, যেমন মিঠা পাট। রসুন দিয়ে পাটশাক ভাজা বৈশাখের দুপুরে, আহা সে যেন অমৃতসম। যিনি এ রসে বঞ্চিত তিনি কল্পনাতেও আনতে পারবেননা কি সুখ লুকিয়ে আছে পাটশাকে। এর পর ধরুন কলমি শাক ভাজা, বা শরু লন্বা লম্বা করে কাটা আলু আর কয়েকদানা ছোলাডাল সহযোগে চচ্চড়ি- এ স্বাদের কাছে আর কি লাগে!
শীতে পালং শাক বেগুন দিয়ে, মুলো শাক ভাজা। এর সাথে ছিল বাঙাল ডাঁটা বা কাটোয়া ডাঁটা নামের ফুট তিনেক লম্বা শাকের আমদানি। বেশ মিষ্টি মিষ্টি লাগত এই শাক। বিয়ে বাড়ির ল্যাবড়া নামক তরকারিতে এই বাঙাল ডাঁটা ছিল অপরিহার্য, আজও আছে।
পুঁইশাক সহজলভ্য, হরেক উপায়ে রান্না হত, আজও হয়। কুমড়ো আলু দিয়ে, কচু আর ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে, ছ্যাঁচড়া, শুটকি বা নোনা ইলিশ দিয়ে রসা, পুঁইডাঁটা চেবানোর মজাই আলাদা। আজকাল বাজারে গেলে মায়ের অর্ডারি- ঢাকঢাক পাতা, মাচার পুঁই আনবি ডগ ডগ দেখে।
এর পর নটে, লাল নটেতে ভাত রাঙিয়ে খাবার শিশুশুলভ খেলা খেলেনি এমন মানুষ কম। সাদা নটে বাড়ির আশেপাশেই পাওয়া যেত, যেটা সিদ্ধ করে কাচা পেয়াজ, কাঁচালঙ্কা, নুন আর পাতিলেবু সহযোগে ভাতে মাখলে এমনিতেই পাত খালি হয়ে যেত। যদিও কাঁটানটে দেখলেই তখন নিজেকে বদল বলদ মনে হত, আসলে গোয়ালের গরুদের দুপুরের খাবারে বা জাবনাতে কাঁটানটে-খুদ সিদ্ধ থাকত, গাই এর দুধ আর হেলের বল বাড়েতে।
লাউ শাকের চচ্চড়ি, ভাজা, ভাপা, কুমড়ো শাকেরও ওই ধরনেরই রেসিপি হত। পলতা বা পটলের শাক, রাঙা আলুর লতি, বাদাম শাক, এগুলোও মুখরোচক পদেই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ছোলাশাক, তেউরা শাক, খেসারী শাক ইত্যাদি তো লোভনীয় পদ।
পাশের বাড়ির ডাক্তার ঠাকুমা আবার খারকোন নামের একটা শাক খেতেন বড় আমোদ করে। যেগুলো বাড়ির স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের কোনে জন্মাতো। পচা খড়ের পালুইতে যে ব্যাঙের ছাতা গজাতো, 'বিলেতিশাক' নামে সেই মাশরুম যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল পরিচিতমহলের রসুইঘরে। আমাদের রান্নাঘরে অবশ্য তা কখনও ঢোকেনি।
বাড়ির শাক বলতে মনে পড়ল, থানকুনি, শুশুনি, কুমড়োশাক, পুঁইশাক, বেতোর শাক, কচুডাঁটা, কচুরলতি, ওলের ডাঁটা, দণ্ডকলস, টক আমরুল, ঢেঁকিশাক, তেলাকুচা লতা, ঝুড়ি শাক ইত্যাদি কিনতে হতনা। হয় বাড়িতেই হত নতুবা বাড়ির আশেপাশে ফেলা জমিতে দেখাযেত, যা চাষ করতে হতনা, আপনা থেকেই জন্মাতো।
শাক হিসাবে না গন্য করলেও; ধনেপাতা, লেবুবাতা, আমড়াপাতা, কারিপাতা, পুদিনাপাতা ইত্যাদি কিছু গরুর মত চিবিয়ে খাওয়াই হয় বা হত।
আজকাল শহর তো ছেড়েই দিলাম, গ্রামাঞ্চলেও বাড়ির আশেপাশে বনবাদাড় তেমন থাকেনা, অনাবাদী জমিও তেমন নেই, মাঠ আলেও হরেক ঘাসমারা আর কেয়ারিকরা বাগিচার দাপটে এই মাঠঘাটের শাক বৈচিত্র্য আজ বাংলার বুকে হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রাম বাংলা বা মফস্বল শহরে যে ছোট ছোট ডোবা থাকত, তার পাড়েও থাকত বুনো শাকেদের রাজ্য। শাকের ঐতিহ্য বাঙালীর চিরন্তন। গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষ এই লতাপাতা কন্দকান্ড খেয়েই পুষ্টি ও ঔষধি পেতেন। আজ আমরা সেটা দায়িত্ব নিয়ে নষ্ট করেছি ও করে চলেছি।
এর উপরে আছে পার্থেনিয়ামের সর্বগ্রাসী অভিযান, নতুবা রেললাইনের ধার দিয়ে বা পাকা রাস্তার নয়ানজুলী বরাবরও একটা সময় মেঠো শাকের স্বর্গ ছিল। তারই মাঝে একটা আধটা বহল, আকন্দ, ঢোলকলমি, ফলসা, বুনো জাম, ছোট ফলন্ত তালের গাছ, শ্যাওড়া গাছের আঁশফল, বকুল, জামরুল বনে শৈশব ছুটে বেড়াতো। কেটেছড়ে গেলে দূর্বাঘাস চিবিয়ে দেওয়া বা চিড়চিড়ে গাছের কষ লাগিয়ে চিকিৎসা করা। সবই শাকের সাথেই বিদায় নিয়েছে আজকের শৈশব থেজে। আজ সেই রাস্তায় প্রচুর বাইক, মোটরভ্যান ট্রাকের দাপট। ধানচাষীর লোভ নয়ানজুলীকে বীজতলা বানিয়েছে। শৈশবও অগি-সিঞ্চ্যানে বন্দি।
তাই ভূত চতুর্দশী পালনে ১৪ শাক আজ প্রতীকি শাস্ত্রপালা হিসাবেই রয়ে গেছে।
আপনার অভজ্ঞিতা কি এই শাক নিয়ে?
_____________
©উন্মাদ হার্মাদ
No comments:
Post a Comment