১.
কাল বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আয়োজক দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজের বক্তব্য রাখলেন নিজের ভাষাতেই। এবং স্বাভাবিকভাবেই আমরা কেউই কিছু বুঝলাম না তিনি কী বললেন! এবং আরও স্বাভাবিকভাবেই এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এর যুগে 'নিজেদের আইডেন্টিটি বাবলগাম ফুলিয়ে যত বড় করা যেতে পারে তত বড় করব' মতের অন্যতম ধারক বাঙালি ফেসবুকে আবেগজর্জর স্ট্যাটাস দিলো 'পুতিন যদি এমনধারা করতে পারে তাহলে বাংলা মায়ের সন্তান কেন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে?' হ্যাশট্যাগ বাংলা_বাঙালি_বাংলামিডিয়াম।
নিজের স্কুলজীবন পুরোটাই বাংলা মাধ্যম। শুধু তাই নয়, মাতৃভাষা- শুধু এই দাবীর জন্য বাংলাকে গড়পড়তা যতটা ভালোবাসা যায় তার চেয়ে বোধহয় কিছুটা বেশিই ভালোবেসেছি, বাসি এখনও। মনে পড়ে, মেডিকেল কলেজে ইংরেজিতে ডায়াসিং করার দীর্ঘ ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাতেই গর্বের সাথে ডায়াসিং করার কথা এবং নিজের ও নিজ অর্গানাইজেশনের বক্তব্য সেই ভাষাতেই সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তাকে সামান্য হলেও জনপ্রিয় করার কথা। মনে পড়ে দু'বছর আগে নিট-কে সর্বভারতীয় পরীক্ষা করার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যে যে যুক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম নিজের মতো করে কিছুটা হলেও, তারও একটা বড় জায়গা ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে দেওয়ার যুক্তিই। এবং একই সাথে মনে পড়ে নিজের হাসি কান্না ভালোবাসা যুক্তিবোধ অভাব অভিযোগের ভাষার নামও বাংলাই। তবু বাবলগামে যে আলপিনটি না ফোটালেই নয়।
২.
দেশ হিসেবে ভারত একটি বহু ধর্ম এবং বহু সংস্কৃতির দেশই শুধু নয়, সে একটি বহু ভাষার দেশও বটে। সংবিধান স্বীকৃত বাইশটি ভাষা আমাদের, বাংলা অবশ্যই যার মধ্যে একটি। এবং অতি অবশ্যই উল্লেখ্য, হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা নয়। আমাদের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই। হিন্দি হ'ল ভারতের অফিশিয়াল ভাষা, অর্থাৎ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত একটা দেশ চালানোর জন্য দৈনন্দিনে যে লক্ষকোটি অফিশিয়াল কাজ করতে হয় তার ভাষা হিন্দি। এবং হ্যাঁ, ইংরেজিও।
ফলে আপিস কাছারিতে একটা ফর্ম থেকে শুরু করে জজসাহেবর রায়ের কপি থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এই দুই ভাষা ব্যবহৃত হয়। অন্তত, হওয়াটা উচিত। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, এদেশে পরীক্ষার দিক থেকে সবচেয়ে কুলীন ইউপিএসসি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাটির (চলতি কথায় আইএএস পরীক্ষা) আপনি পুরো মেইনস এবং ইন্টারভিউ (যদ্দুর জানি) নিজের মাতৃভাষাতেই দিতে পারেন। আপনি চাইলে সরকার আপনাকে সে সুযোগ দিতে বাধ্য, এবং সরকার সে সুযোগ আপনাকে দেয়ও।
থিয়োরেটিক্যালি পারেন তো অবশ্যই, কিন্তু সেটা সম্ভব কি? সম্ভব হলে একটু ডেটা দিয়ে বলবেন আজ পর্যন্ত ক'জন বাঙালি/ বা অন্য ভাষার লোক নিজস্ব মাতৃভাষায় পরীক্ষা দিয়ে সিভিল সার্ভিস ক্র্যাক করেছে? শতাংশের হিসেবে সেটা কত? থিয়োরেটিক্যালি সে তো আপনি ইউনাইটেড নেশনসের প্রেসিডেন্টও হতে পারেন, বা প্রথম মঙ্গল অভিযাত্রী। সম্ভাবনার দিক থেকে ডেটা দিয়ে বিচার করলে সেটা প্র্যাক্টিক্যাল কি আদৌ?
প্র্যাক্টিক্যাল নয় তার কারণ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যে সমস্ত বিষয় পড়তে হয় এবং বাজারে তার যা স্ট্যান্ডার্ড বই আছে সেগুলি সবই ইংরেজিতে। আপনি নিজের মাতৃভাষায় ইন্ডিয়ান পলিটি এবং ইকোনমির ওপর একটি (ঠিকঠাক) বইও খুঁজে পাবেন না। পেলেও তাতে ব্যবহৃত একটি নির্দিষ্ট 'টার্ম' এবং তার ব্যাখা আসলে ইংরেজিতেই, কারণ তার বাংলা হয়ই না। পরীক্ষা দিলেন মাতৃভাষায়, ধরা যাক সুযোগও পেলেন, কিন্তু এসডিও হিসেবে পোস্টিং বেলগাঁও বা দিসপুর। মাতৃভাষাকে সম্বল করে কাজ চালাতে পারবেন তো?
তাই থিয়োরেটিক্যালি হলেও প্র্যাক্টিক্যালি অনেকেই আটকে যান ভাষার প্রশ্নে। একটা পুরো পেপার Essay, সেটা ইংরেজিতে লিখতে হবে ভেবে বাঙালি পরীক্ষার্থী দু'বার ঢোঁক গেলে।
আমি হিন্দি নিয়ে একটা এক্সট্রা শব্দও খরচ করতে চাই না। সেটা একটা রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডার অংশ হতে পারে, আমার তা নিয়ে আপত্তিও আছে। এবং বাংলা বনাম হিন্দি কাবাডিতে অন্তত আমি বাংলার দলেই। যদিও কাজের সূত্রে বা নিতান্ত ঘুরতে এ বঙ্গের বাইরে পা বাড়িয়ে দৈনন্দিনে নিজেই হিন্দি ব্যবহার করেছি, করতে বাধ্য হয়েছি। থ্যাঙ্কস টু সেট ম্যাক্স অ্যান্ড আজ তক। তবে সেটুকু পেরিয়ে ঘরে ফিরলে প্রেমে পকোড়ায় পার্কস্ট্রিটে আমি হার্ডকোর বাঙালি এবং আমার ভাষা বাংলা।
কিন্তু বাংলা বনাম ইংরেজিতে? আসুন দেখা যাক।
৩.
হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে গলা ফাটানো ধুতি পাঞ্জাবির অনেক বাঙালিকে চিনি আমি। পড়াশুনো মেডিকেল কলেজ- হার্ভার্ড। যে পরীক্ষা দিয়েছিলেন, এবং দিতে হয় তাদের নাম জিআরই এবং টোয়েফল। যে ভাষায় কাজ, পড়াশুনো এবং নামের পাশের ডিগ্রী আসা তার নাম ইংরেজি। এবং হ্যাঁ, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও আরও আরও অনেকের গল্পটা একই। প্রতিটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে হবে ইংরেজিতে, প্রতিটা পিপিটি স্লাইড বানাতে হবে ইংরেজিতে, প্রতিটা মেইল করতে হবে ইংরেজিতে, প্রতিটা সেমিনারে বক্তব্য রাখতে হবে ইংরেজিতে এবং স্যার এবং ম্যাডাম সেটা করবেনও, কিন্তু ফেসবুকে ঢুকে আবেগী স্ট্যাটাস দেবেন ইংলিশ মিডিয়াম হায় হায়, জয় বাংলার জয় মর্মে। কারণ ফেসবুক সত্য, জগত মিথ্যা। তার লাইকে আর 'বাহ' এর ডিজেলে ইগোর ইঞ্জিন চলে। তাতে আরেকটা বাবল তৈরি করতে হলে করি না আমি, যে বাবলের ভেতর বসে অন্য একটা মফস্বল থেকে উঠে আসা আজীবন বাংলা মিডিয়ামের অন্য এক ছাত্রী ভাববে যে তার ইংরেজি না জানলেও চলে যাবে, কী যায় আসে!
সেই ছাত্রীটিকেই বলছি, না, চলবে না ইংরেজি না জেনে। আজ চলবে না, এদেশে চলবে না, এবং সামনের দিনগুলোয় সামনের কোনও জায়গাতেই চলবে না। দৈনন্দিন কাজ চালানোর জন্য, নিজের কেরিয়ার এবং কাজের স্বার্থেই ইংরেজি ভাষায় সড়গড় হতে হবে। আমরা একটা বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বাস করি যার যোগাযোগের মাধ্যম ইংরেজি। হয় তুমি সেই ভাষা শেখো এবং পৃথিবীর উঠোনে এসে দাঁড়াও নয় জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নিজের মাতৃভাষা নিয়ে ঘরের এককোণে পড়ে থাকো। যারা তোমায় এই ফেসবুকে বাংলা নিয়ে আবেগী করে দেয় তারা কাজের জগতে প্রত্যেকে ইংরেজিতে পারদর্শী। তাদের সাহিত্য, সিনেমা, পড়াশুনো থেকে শুরু করে নিজস্ব কাজের জগত ইংরেজির। এই মুহূর্তে বা অদূর ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের সন্তানেরা পড়বে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলেই কারণ তারা ফেসবুকে আর চায়ের দোকানে যাই বলুক তারা নিজেরা বিলক্ষণ জানেন আজকের পৃথিবীতে ইংরেজি না জানা মানে তুমি শুরুই করছ একধাপ পিছিয়ে থেকেই। তারা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হয়ত করছে না, কিন্তু রোজরোজ বাংলা নিয়ে এবং শুধুই বাংলা নিয়ে যেটা করছে সেটা আদতে তোমাকে একটা আবেগমাখা মিষ্টিমিষ্টি ছায়াবাবলের ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে যার মধ্যে থেকে তুমি ভাবছো নিজের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কিছু না জানাটাই যেন তোমার 'অধিকার'এর মধ্যে পড়ে। ভুল ভাবছো।
তুমি পুতিন নও (এবং বলে রাখা ভালো পুতিন নিজস্ব ভাষায় গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে নিজের বক্তব্য রেখে বিশাল কিছু ঠিক কাজ করেননি। আমরা কেউ জানিই না উনি কী বলেছেন। প্রশ্নটা জাত্যাভিমানের নয়, প্রশ্নটা প্রয়োজনীয়তার) এবং তোমার জন্ম এমন কোনও দেশে হয়নি যার একটাই রাষ্ট্রভাষা এবং অফিশিয়াল ভাষা। এ নিয়ে অভিমান করা যেতে পারে, রাগ করা যেতে পারে, আন্দোলনও করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগে তোমায় একটা সিভি তৈরি করতে হবে ইংরেজিতে, মেইল করতে হবে ইংরেজিতে, ইন্টারভিউ দিতে হবে ইংরেজিতে, গেম অফ থ্রোন্স দেখতে হবে ইংরেজিতে। আমার বোনকে সংস্কৃত নামক একটা সম্পূর্ণ ভাষানির্ভর বিষয়ে শিক্ষকতা করার জন্যও এ শহরের সমস্ত স্কুলে ইন্টারভিউ দিতে হয় ইংরেজিতে। ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চাকে বাড়িতে গিয়ে পড়ানোর প্রশ্নে তার বাবা ফোনের ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করেন 'আপনি ইংলিশ মিডিয়াম তো?'- না শুনে ভদ্রভাবে 'ওকে' বলে ফোন রেখে দেন। বাংলা আমার মাতৃভাষা এই আবেগ পেরিয়ে যে বাস্তবে ভাত আসে সেখানে বলা বাহুল্য, ধুতি পাঞ্জাবির কাউকে দেখা যায় না। আর জন্মসূত্রে যা পেয়েছি তার বাইরে নিজে থেকে কিছু অর্জন করব না, চেষ্টা করব না, শিখব না এটাই বা কোন দেশীয় যুক্তি হতে পারে!
দশকের পর দশক ইংরেজি শিক্ষাকে ব্রাত্য করে রেখে এ রাজ্যের পূর্বতন মহান শাসকগোষ্ঠী অলরেডি যা ক্ষতি করার করে দিয়ে গেছেন। বাকিদের কাছে অনুরোধ বাংলায় লিখুন, বাংলায় কথা বলুন, বাংলায় গান করুন কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ইজ ইক্যুয়ালস টু ইংরেজি না শিখলেও চলবে এই ভুল তথ্যটি ছড়ানো বন্ধ করুন। একসাথে দু'টো ভাষা শেখা যায়, মাতৃভাষাকে ব্রাত্য না করেই ইংরেজি যে একটি অত্যাবশ্যক ভাষা সেই কথা জোর দিয়ে বলা যায়। যে রবীন্দ্রনাথকে ফটো করে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছি তার কাজ বাংলায়, কিন্তু 'বিশ্বকবি' হয়ে ওঠা ইংরেজিতে এই সত্যিটা স্বীকার করি চলুন। যে বিবেকানন্দকে সামনে রেখে কর্মযোগের দীক্ষা তার বিশ্বমানব হয়ে ওঠা 'মাই সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অব আমেরিকা...' দিয়ে সেটা আরেকবার বলে উঠি চলুন। যে সত্যজিৎ রায়, নীরোদ সি চৌধুরী আর অমর্ত্য সেনকে বাঙালি বলতে পেরে ধন্য হই তাদের ইংরেজী ভাষার ওপর দখল এবং ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ কী অসামান্য উচ্চতার সেটাও একই সাথে মনে পড়াই চলুন।
এবং এই সুযোগে এটাও বলি, বাংলা ভাষার ফর্ম নিয়ে এই আদেখলাপনাটাও বন্ধ করুন। বাংলায় লিখছি আর বলছি মানে তার সব হতে হবে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায়, বাংলা শব্দে- এই হরপ্পা সভ্যতায় যারা এখনও বাস করেন তাদের একটা ছোট্ট স্মৃতি শেয়ার করেই লেখা গোটাচ্ছি। সেটা সাত আট বছর আগে হবে বোধহয়। এবিপি আনন্দ 'সেরা বাঙালি'র মঞ্চে সুনীল গাঙ্গুলিকে পুরষ্কৃত করার পরে সুমন প্রশ্ন করলেন "আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি ইত্যাদি... সুনীল বাবু, আজ থেকে একশ বছর পরেও বাংলা ও বাঙালি যার লেখা পড়বে সে কি আপনিই? আপনার কী মত?" উনি বলেছিলেন "আজ থেকে একশ বছর পরে বাংলা ভাষা থাকবে বলে আমার মনে হয় না, আমাকে পড়া অনেক দূরের কথা..." একথা সুনীল গাঙ্গুলির! বাজারি কিন্তু বিগত কয়েক দশকে সর্বাধিক পঠিত ও শ্রদ্ধেয় বাংলা লেখকের!
ভাষা অনবরত বদলায়। সময়ের সাথে, তাকে ব্যবহারকারী মানুষের সাথে, পৃথিবীর সাথে, তার প্রয়োজনীয়তার স্বার্থে। বাবলগাম না ফুলিয়ে প্রয়োজনীয়তা এবং ভবিষ্যতের স্বার্থেই মাতৃভাষার বাইরে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অন্তত ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব স্বীকার করে সেই পাঁচজন ছাত্রীকে বলি চলুন যে ইংরেজিটা শিখতে হবে।
দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ।
এর বাংলা কী কে জানে!
No comments:
Post a Comment