মহা মানে মহৎ, আর জন মানে মানুষ। মহৎ মানুষ। কিন্তু ব্যাবহারিক প্রয়োগে এর অর্থ সম্পূর্ন বদলে যায়। বাস্তবজীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, এই মহাজনেরা অত্যন্ত ক্ষুদ্র মানসিকতা যুক্ত নিন্মরুচীর মানুষ হন। ঠিক তেমনই, আমার কাছে আমার এই জীবনটার মর্মার্থ বা আমার চেতনার বিকাশের সাথে, আমার ব্যাবহারিক তথা আক্ষরিক জীবন , যেটা যাপন করছি সেটার সাথে কোন মিলই পায়না। অনেকগুলো স্বত্তার কলহ দিবারাত্র, আর ততগুলো অদৃশ্য দেওয়াল। বিদ্রোহ আর অন্তর্ঘাতে জর্জরিত প্রান। আমার সঙ্গী সাথীরা অবশ্য আমার এই টানাপড়েনের দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে প্রায় উদাসীন বা হয়ত জানেনইনা। আসলে “ভালআছি” দেখানোটা একটা সু- অভ্যাস। দীর্ঘ অনুশীলন অধ্যাবসায় দিয়ে এটুকুই রপ্ত করতে পেরেছি।
একটা জনপ্রিয়
সংলাপের কথা মনে পরে “ আমার ভাবতেও গা ঘিনঘিন করছে”। সত্যিকারের ওই ঘিনঘিন করাটা
অবশ্য শিল্প। অনেকে সেই ভাবনাটা দারুন ভাবে প্রকাশ করতে পারে। যেমন একটা ছেলে
খিস্তি দিলে ব্যাপারটা একটা স্বাভাবিক, কিন্তু মেয়েরা দিলেই ব্যাপারটা গা ঘিনিঘিনে।
অথচ ব্যাপারটা তো কোন খুন খারাপি নয় বা সমলিঙ্গের মেহনও নয়, খিস্তি একটা ভাষার
অপব্যাবহার বা অপভাষা ভিন্ন আর কিছুই নয়। অথচ নারীমুখের খিস্তি মানেই গা ঘিনঘিনে
ব্যাপার।
কেন এসব লিখছি!!
আসলে লিখতে পারছিনা। ফুরিয়ে গিয়েছে বলার ধৃষ্টতা দেখাবার মুরোদ নেই, কারন মজুত
থাকলে তবেনা ফুরানোর প্রসঙ্গ। লেখা আমার কাছে স্বতঃস্ফূর্ত একটা অন্তর্বাহী
প্রবাহ। যেটার বেগ তীব্রতর হলে তবেই পেনের ডগা দিয়ে সেই প্রবাহের স্ফুরন ঘটে। লেখা
আসলে তবে লেখা যায়, টেনে হিঁচড়ে লেখা যায়না। অনেকেই আনন্দ হলেই সেটা লিখে ফেলেন,
দুঃখ পেলেও যথাযথ বিশেষন সহ উগড়ে ফেলেন, আবার কিছু কাজ না থাকলেও , অবসরটা লিখে
লিখে কাটিয়ে দেন। আমি লিখি, নিজের কথা লিখি, পাঠকের কথা ভেবে নয়, তায় পাঠকে কি
বললেন সেই দায় থেকে মুক্ত। অবশ্য সৌভাগ্যক্রমে যদি কোন পাঠক পড়েন তবেই। তবুও
ভালমন্দের দায় পাঠকেরই। তিনি তার পরিপ্রেক্ষিতে লেখাটা বিচার করবেন, আমি আমার
প্রেক্ষিতে লিখে যাব, যদি লেখা আসে। অনেকেই কবিতা প্রসব করেন। ছন্দ মিল করেন। আমি
চিরদ্বন্দ্বে ভোগা এক ক্ষতবিক্ষত উনপাজুরে জীব। কবিতাবিলাসি হলে কাব্যগর্ভা মোটেই
নই।
আমি নাস্তিক নই, ঈশ্বরে
বিশ্বাস অটুট। তাই ভাবি, আমার সাথে বাকি যে সকল আত্মাকে এই পৃথিবিতে পাঠাবার
কথাছিল, তারা কি সকলেই আমার সাথে এসেছে? জানার শত ইচ্ছা থাকলেও কোন উপায়ই নেই। ইশ্বর
সর্বশক্তিমান হলেও তার সমস্ত উৎপাদন নিখুঁত নয়, হয়তবা ইচ্ছা করেই। তার সৃষ্টিতেও
কিছু জন অন্ধ, বধির, শারীরিক ও মানসিক পক্ষাঘাত ও প্রতিবন্ধী হয়ে থাকেন।
আমি শারীরিক ভাবে
সম্পূর্ন সুস্থ, তবুও আমি ভীরু, প্রানভয়ে বহু সত্য ঘটনাকে দেখতে পায়না, সুতরাং আমি
অন্ধ। অপ্রিয় হবার ভয়ে ন্যায়ের কথা বলতে পারিনা, স্বার্থের খাতিতে সত্য গোপন করি,
সুতরাং আমি বধির। অন্যের বিপদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি অংশগ্রহন করতে পারিনা
নিজেকে সুরক্ষিত রাখার তাগিদে, সুতরাং আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী। আর আজ পর্যন্ত ভাল
কোন কিছু করা তো দুরস্থান, হিতকর কিছু ভাবতেও পারিনি, সুতরাং সম্পূর্ন না হলেও আমি
বেশ অনেকটাই মানসিক পক্ষাঘাতের শিকার। আমি প্রকৃতপক্ষে সুস্থমানুষের ছদ্মবেশে একজন
পরিপূর্ন শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধীর বিজ্ঞাপন। আর এটা কেবল আমিই জানি।
থাকার মাঝে আছে
শুধু কিছু অনুভুতি। সেগুলো নাকি সবটা সমাজ স্বিকৃত নয়। যাব তো যাই কোথায়। বস্তুত
ওই অনুভুতিগুলোর সর্বমোট যোগফলই তো আসল আমি। আর সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ, যেটা চেষ্টা
করলে হয়ত পারতাম, কিন্তু সেটার অনেকটা আবার নিষিদ্ধ। আধুনিকতা নেই শুধুই আদিমতা।
তাই ওই পথেও হাতে রইল পেনসিল। যা দিয়ে লেখার কথা , সেটা দিয়ে খোঁচায়, সামনে পিছনে
চারিপাসে কেও থাকলে তাদের, নাহলে নিজেকেই, চুলকাতে থাকি।
আবার ফিরি সেই
ঈশ্বরের প্রসঙ্গে, আমি যে লটের উৎপাদন, সেই লটে সম্ভবত কিছু প্রতিবন্ধী আত্মাকে
মানুষের দেহ প্রদান করেননি ঈশ্বর মহাশয়। আর তাদের সেই আত্মাগুলোর কিছুজনকে বহন করে
চলার ভার আমার উপরেই ন্যাস্ত। আর সেই কারনেই আমি একসঙ্গে এতোগুলো অসমঞ্জস্য খুঁতে
পরিপূর্ন। অনেক সময় আমি নিজের আমিতে যখন মগ্ন হয়ে থাকি, তখন অনেক ক্ষেত্রেই কেন
জানিনা এই দশাশই চেহারাটা কেমন গায়েব হয়ে যায়। আমি ছাড়া আমার উপস্থিতি আর কেওই টের
পায়না। আমি যেন কেবলই একটা আত্মা। অনেকটা সন্ধ্যার নিভু নিভু পার্কের আলোতে জোড়ায়
জোড়ায় প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের মধ্যে উপস্থিত পাহারাদার। যার উপস্থিতি অগ্রহ্য
করাটা প্রায় দায়িত্বের মধ্যে পরে। তেমনই অনেক স্থানে, যেখানে আমি নিজেকে জাহির
করতে গেছি, অথচ সেখানে আমি থেকেও, আমার উপস্থিতিকে কেও আমলই দিলনা। অতএব ধরে
নেওয়াই যায়, আমায় কেও আসলে দেখেইনি। জড় শরীরটা তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে, আমি তখন শুধুই
একটা আত্মা। আর সবটাই একপেশে উপলব্ধি কোন বহিঃপ্রকাশের সুযোগ নেই।
আমার বন্ধুরা আমার
উপরে চোখ বন্ধ করে অবিশ্বাস করতে পারেন, দায়িত্ব নিয়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করতেই পারেন।
কারন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তাদের সাথে লাগাতার ধাপ্পাবাজি করে যাচ্ছি। সুতরাং
একটা খাজা- অকর্মন্য- লজ্ঝরে ব্যাক্তিত্বের অধিকারী হয়ে বহাল তবিয়তে, বড্ড গা
ঘিনঘিনে অবস্থায় বেঁচে আছি।
আমিও মহাজন।
অভিধানিক মতে মহা মানে অতিবড় ও হয়, আর জন মানে একটা মৃতদেহ বা শব। আমি আসলে তো
তাইই। একটা “অতিবড় লাশ”।
No comments:
Post a Comment