Thursday, 20 October 2016

লেবুজল

জল সংকল্প
------------- 

স্নান করার মধ্যে যে কি পরিমান মজা লুকিয়ে থাকতে পারে, তা কেবল রসিক জনেই উপলব্ধি করতে পারে। আর পারে স্নানগবেষকেরা। অবশ্য সেটা যদি একটা তীব্র আকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশ হয় তবেই।

বিড়িতে একটা দীর্ঘ শেষ সুখটান দিয়ে, অবশিষ্টাংশটা খানিকটা ক্যারামের ঘুঁটির ঢঙে দীর্ঘদিনের নিখুঁত অভ্যাসে, বৃদ্ধাঙ্গুল আর মধ্যমা সহযোগে, উপবৃত্তাকার পথে এক্কেবারে রাস্তার উপরের ফুটপাথে ছুরে ফেললেন। ইজিচেয়ারে গা এলিয়েই উপরের কথাগুলো কিছুটা স্বাগতোক্তির মতকরে বললেন লেবুদা।  

এক বিখ্যাত মহাপুরুষের মতে, এই স্বাদ থেকে আনাড়ীরা চিরবঞ্চিত। এবং যথারীতি এটা ভেবে ঠোঁটের কোনে একটা হাসির ঝিলিক খেলে গেল এই ভেবে, যে ওই মহাপুরুষটি তিনিই স্বয়ং নিজে

আপনারা সকলেই জানেন, লেবুদা নিজেকে সমাজবিজ্ঞানী ভাবতে ভালবাসেন। তাই সামান্য  অবসরেও প্রায় প্রতি দিনিই কিছুনা কিছু পরিক্ষা নিরিক্ষা গবেষনা ইত্যাদি করেই থাকেন। আর স্নানের এই বিষয়টাও যে- তারই সেই গবেষনালব্ধ ফসল, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

নতুন কেনা এন্ড্রোয়েড ফোনে কিছুদিন আগে লেবুদার একটা ফেসবুক একাউন্ট করে দিয়েছিল শ্যালক বীরু। লেবুদা অবশ্যি অতো কিছু মোটেই বোঝেননা। তবে সময় সুযোগ পেলে মাঝেসাজে একআধবার খুলে বোঝার চেষ্টা করেন বটে অবশ্য ফ্রির wi-fi পেলে তবেইকারন তিনি মোবাইলে ইন্টারনেটের ব্যালেন্স কোনদিনিই ভরেননি। আর এই wi-fi ব্যাপারটা গেলবার পুরী যাবার সময় ছেলে মুঙলা হাওড়া স্টেশনে বসে ব্যাপারটা শিখিয়ে দিয়েছিল।

হপ্তাখানেক আগে শেয়ালদা স্টেশনে এক ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করতে গিয়ে, কিছুক্ষন অপেক্ষার সময়টুকু, ফ্রির wi-fi পেয়ে ফেসবুক খুলতেই, একটা পোষ্টে চোখ আঁটকে গেল লেবুদার“জল ও আমাদের ভবিষ্যৎ” শীর্ষক একটা পোষ্টে তার যাবতীয় আগ্রহ শোষন করে নিলযথারীতি মন দিয়ে বার করেক সেটা পড়লেন। তার পর সারাদিনের কাজকর্মের ব্যাস্ততায় জলের বিষয়টা ভুলে গেলেও, রাতে শুয়ে শুয়ে আবার জলের কথাটা মনে আসতেই আগামী পৃথিবীর কথা ভেবে কপাল থেকে নিঃসৃত ঘামরূপী জলে নিজের মুখমন্ডলটা ভিজিয়ে ফেললেন।

সেই রাতেই তিনি ভাবতে বসলেন, জল বাঁচাতে তিনি ঠিক কি কি করতে পারেন বা এই মুহুর্তে কি করা উচিৎ। সেই ভাবনা মত প্রথমেই স্নানের ঘাড়ে প্রথম কোপটা এসে পড়ল। তবে বাঘা বৌদির হালুমের ভয়ে ব্যাপারটা নিজের মধ্যেই রেখে দিলেন।

“প্রতিদিন স্নান করাটা কি খুব জরুরী? মাছেদের কথা নাহয় ছেরেই দিলাম, মানুষ ছারাও পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ পশু পাখি পোকামাকর কৃমি ইত্যাদি আছে তারা কি রোজ স্নান করে! কিম্বা ধরা যাক তুষারমানবেরা বা ঠান্ডার দেশের মানুষেরা, বরফের মাঝে জলটা পাবে কোথায় শুনি, যে তারা রোজ স্নান বিলাস করবে! মরু অঞ্চলের লোকেদের পরিস্থিতিও তাই। তাহলে আমাদের কাছে জলের প্রাচুর্য আছে বলেই কি এমন একটা ধ্বংসাত্বক অপসংস্কৃতি সমাজে চালু করতে হবে! ঘোর কলি না হলে কি সমাজের এমন অবনতি হয়! পুরাকালের মুনিঋষিরাও বছরের পর বছর ধরে ধ্যান করেছেন, তারা কি তখন রোজ স্নান করতেন! নাকি স্নানের জন্য তাদের সিদ্ধপুরুষ হওয়া আটকেছে!”

এক ধাক্কায় এতো গুলো ভাবনা ভেবে ভীষন ক্লান্ত হয়ে, লেবুদা দু ঢক জল খেয়ে পুনরায় ভাবতে বসলেন ইয়ে মানে শুলেন। তবে এবার আর মোটেই ভাবনা এলো না, বরং একটা গাঢ় ঘুম এলো।

পরদিন আপিসে যাবার আগে যথারীতি প্রাত্যহিকি সকল কাজই করলেন, শুধু স্নান টুকু আর করলেন না। ওদিকে বাঘাবৌদি দুবার গজনাদ স্বরে হাঁক পেরেছেন- “বলি মাথায় দু-মগ জল চড়িয়ে আসবে না কি! ভাতে যে মাছি জমবে... ইত্যাদি”। লেবুদা বাঘাবৌদির সাধের চাঁপার তেল দু ফোটা মাথায় মেখে, বেসিনের কল থেকে এক আঁচলা জল দুহাতে লেপ্টে নিয়ে, মাথায় চোখে মুখমন্ডলে ছেটালেন, আর ভিজে হাতটা বুকে আর পেটে বার দুয়েক বুলিয়ে, চুলটা আঁচড়ে শান্তশিষ্ট হয়ে ভাতে বসে গেলেন। 

পচা শেষা ভাদরে এক্কেবারে ঘেমেনেয়ে অস্থির হয়ে বাড়ি ফিরলেন সন্ধ্যেয়। পাখাটা চালিয়ে বসে গা-এর ঘাম মুছে নিয়ে, যতটুকু খরচা না করলেই নয়, ততটুকুই জল দিয়ে হাত পা মুখ ধুয়ে নিলেন। গামছা টা ভাল করে বালতির জলে ভিজিয়ে নিয়ে সারা শরীরটা মুছে নিলেন। বালতির জলটা অবশ্য শৌচকর্মের জন্য বালতিতেই মজুদ রেখে দিলেন। চুরান্ত জল সংরক্ষণ।  

সামনেই উৎসবের দীর্ঘ মরশুম, তার জন্যই ইলেকট্রিকের তারে মেরামতির কাজ চলছিল। সুতরাং লেবুদার পাড়ায় এদিন রাতে কারেন্ট ভোকাট্টা। দুপুরে নিমন্ত্রিত একটা শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের বকেয়া ভোজ, আপিস ফেরতা সন্ধ্যাবেলা ঠেসে খেয়েছেন লেবুদাসুতরাং এই ভ্যাপসা গরমের সাথে টানা স্নান না করা শরীরের গরম, মিলেমিশে লেবুদার পেট ফাঁপিয়ে তুলল। সারা রাত চোঁয়া ঢেকুর আর গন্ধবায়ুর ঝঞ্ঝার প্রকোপে, বাঘাবৌদির রণচন্ডী রূপ ধারনের আগেই সসম্মানে তিনি বারান্দায় শয্যা নিলেন।

পরদিন সকালেও তিনি স্নানের নামটি পর্যন্ত করলেন না। সমাজের স্বার্থে বৈপ্লবিক গবেষনাতে এমন একটু আধটু ত্যাগ তো করতেই হবে, নাহলে আর বিজ্ঞানী বা বিপ্লবী কিসের! কারেন্ট না থাকার দরুন বাড়ির জলের ট্যাঙ্কিতে মজুত জলের যোগান ক্রমেই ফুরিয়ে আসলপাড়ার সরকারি কলে গিয়ে স্নান করার মত ধৈর্য বা পরিস্থিতি কারোরই ছিলনা, সুতরাং বাড়ির কারোরই আর সেদিন স্নান হলনা। লেবুদা মনে মনে বেশ প্রসন্নই হলেন। আবার কারেন্টের প্রতি বেশ রাগও হল। কারেন্ট পূর্ববর্তী যুগে মানুষ বেশ নদী পুকুরে স্নান করত, তাতে স্নানও হত আবার জলের অপচয় হতনা। আজকাল তো নদী পুকুর মানেই ড্রেনের সাগরসঙ্গম। স্নান করা তো দুরস্থান, পা চোবাতেই ঘেন্না লাগে।

গতকাল রাত্রের ওই অম্বলের রেশ, আজরাতেও বহাল রইল লেবুদার। আগের রাত্রে গন্ধবায়ু নিন্মমুখী হওয়াতে বারান্দায় শুয়ে পরিত্রান পেয়েছিলেন, আজ বায়ু উর্ধ্বমুখী। গলা শুকিয়ে কাঠ, শ্বাসপ্রশ্বাস প্রায় রুদ্ধ, কেও যেন গলা টিপে ধরেছে। কুলকুল করে ঘেমে চলেছেন।

তখন রাত সবে এগারোটা, খানিক আগেই নৈশ আহার সম্পন্ন হয়েছে মল্লিক বাড়িতে। আর তার মধ্যেই বাঘাবৌদির ভাষায় লেবুর “মিনিস্ট্রোক”। ছোট মেয়ে বিদ্যা, চটকরে পাড়ার ডাক্তার পরেশ রক্ষিতকে ফোন করতেই, পাঁচ মিনিটে ডাক্তারবাবু M-80 মোটর সাইকেলে চেপে হাজির। আপদকালীন কিছু ওষুধ, জরুরি ভিত্তিতে ইঞ্জেকসানের মাধম্যে দিলেন। নাড়ি টিপে জানালেন, উচ্চরক্তচাপ জনিত সমস্যা প্রবলসাথে হজমের গোলমাল। নানান রকম রক্তের পরিক্ষার নিদানও দিলেন। আর বললেন কম মশলাযুক্ত তরকারি খাওয়ার সাথে সাথে দিনে অন্তত বার দুয়েক স্নান করতে এই বাকি গরমের মরশুমটুকু।

লেবুদা ফিসফিসিয়ে ডাক্তারবাবুকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। বাঘাবৌদিই বলে উঠলেন, আসলে আজ তো কারেন্ট ছিলনা, তাই জলের মোটর না চলার কারনে আজ স্নানটা করা হয়নি কারোরই। এতক্ষনে লেবুদা একটু বল ফিরে পেয়ে, তার রিসার্চের পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে খুলে বললেন। যে তিনি আজ নিয়ে সাতদিন স্নান করেননি। ডাক্তারবাবু না থাকলে বাঘাবৌদি হয়ত লেবুদাকে তুলে আছারই মারতেনএ যাত্রায় অগ্নি চাউনি দিয়েই ক্ষান্ত হলেন, এবং বুঝিয়ে দিলেন যে কাল লেবু চটকানো হবে

ডাক্তারবাবু রাতে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল বোধহয়, তাই আজ ঘুম ভাঙতেই লেবুদা ঘড়িতে দেখল নটা দশ। “ও বড়খুকি, মাকে একবার ডেকে দে দেখি” বলে হালকা ডাকটা শেষ হবার আগেই বাঘা বৌদির ঘরে প্রবেশ।
-     আজ মিনশে, তোমার একদিন কি আমার একদিন। মুংলা নিয়ে আয় তো বাবা নারকেলের ছোবরা, অনামুখোটার স্নান না করার রোগ জম্মের ছারিয়ে দিই... ঠাকুর ... এই নমুনা ছিল আমার কপালে...ইত্যাদি”

সুতরাং চোখমুখ না ধুয়েই হিড়হিড় করে টেনে সোজা স্নানঘরে। লেবুদার সারাশরীরে বোধহয় কিছুটা ফিনাইল আর ব্লিচিংপাওডার দিয়ে ডলেডলে পাক্কা ১৫ মিনিট ধরে স্নান করালেন, বাঘাবৌদি। এর পরে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে লেবুদার এই মোক্ষোম উপলব্ধি।

“ সপ্তাহে রোজ স্নান নিষ্প্রয়োজন। ভবিষ্যতের পৃথীবির নিরিখে “রোজ স্নান” এক ধরনের অক্ষমাশীল অপরাধ। শরীরের স্বার্থে গরম কালে দুদিন, খুব গরমকালে তিনদিন, আর শীত কালে একদিন স্নান করলেই যথেষ্ট এই বিরামযুক্ত স্নানতৃষ্ণার মধ্যে যে কি অনবিল সুখ, তা কেবল তারাই জানেন, যারা রোজ স্নান করেননা। রোজ স্নান করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, আর অভ্যাস চিরদিনিই একঘেয়ে। তাই জীবনে নতুনত্ব আনতে প্রত্যেক দিন স্নান করাটা আইন করে বন্ধ হোক। তাতে করে প্রতিদিন কোটিকোটি বালতি জলও বাঁচল, আবার জীবনে নতুনত্বও এলো”।

আর ঘামের গন্ধ আটকাতে ভেজা গামছা আর বৌদির চাঁপার তেল তো রইলই।  লোডসেডিং কি রোজ রোজ হবে!           

""""""""""""""
@উন্মাদ হার্মাদ        


     


No comments:

Post a Comment