Sunday, 18 March 2018

মধ্যপ্রাচ্য- যায়োনিষ্ট ও বিশ্বরাজনীতি- অষ্টম পর্ব



অষ্টম পর্ব- ইহুদি মন্দিরের ইতিকথা
****
কথিত আছে, প্রাচীন ইসরালাইট নেতা জশুয়া- যখন পবিত্র ভূমি প্যালেস্টাইনের দিকে অগ্রসর হল তার অনুগামী নিয়ে, যেই সময় ওই ‘আর্ক অফ দ্যা কভেনেন্ট” বা পবিত্র সিন্দুকটিকে সামনে বয়ে নিয়ে গেলে জর্ডন নদী নিজে থেকেই পথ তৈরি করে দেয়, অলৌকিক উপায়ে (বিজ্ঞান খুঁজলে ইলেকট্রিক বাল্বের দিকে চেয়ে থাকুন)। পরবর্তীতে তাদের রাজা তথা প্রফেট ডেভিড বা দাউদ(আঃ) ও তার পুত্র সলোমন বা সালমন(আঃ) একটি গৃহ বা মন্দির বা মসজিদ নির্মান করে এই সিন্দুকটিকে প্রতিষ্ঠা করেন; আর সেখানেই তারা তাদের ঈশ্বরের আরাধনা করত। প্রসঙ্গত ইহুদিদের উপাসনালয়কে ‘সিনাগগ’ বলা হয়।
মুশকিল হল, ইহুদিরা বলে ডেভিড একমাত্র তাদেরই প্রফেট, আর ডেভিড পুত্র সলোমনের তৈরি মন্দিরই হল তাদের প্রথম মন্দির; যাকে তারা টেম্পল মাউন্ট নামে ডাকে(১)। এদিকে মুসলমানেরা দাবি করে দাউদ (আঃ) আসলে মুসলমান ছিলেন, সুতরাং তার উপাসনালয় মসজিদই হবে তাতে আর আশ্চর্যের কি! এই নিয়ে বিতর্কের শেষ নয়; বর্তমানে ওই স্থানটিতে একটি সোনালি গম্বুজের মসজিদ নির্মান করা রয়েছে, যা ইসলাম ধর্মের প্রথম ক্বিবলা বা তীর্থস্থল। ইসলাম জামানার শুরুর দিকে এই জেরুজালেমের দিকে মুখ করে ‘আল আকসা’ মসজিদকে উদ্দেশ্য করেই তারা নামাজ পড়ত। সুতরাং ‘আল-আকসা’ মসজিদ কোন ধর্মের সম্পত্তি, এ নিয়েও চূড়ান্ত বিবাদ নিরন্তর চলছেই। লিঙ্ক- (২)। ইহুদিদের ধান্দা যেমন তেমন করে এই মসজিদকে ধ্বংস করে সেখানে কিং হেরডের মন্দির তথা ‘থার্ড টেম্পল’ নির্মান করা, আর মুসলমানদের লক্ষ্য যেভাবেই হোক এটাকে ইজরায়েলি অগ্রাসন থেকে টিকিয়ে রাখা।
চেনা গল্প মনে হচ্ছেনা? ঠিকিই, এ তো পুরো বাবরি মসজিদ আর রামমন্দির কেচ্ছার অতি পুরাতন কাসুন্দি। সর্বস্থানেই দখলকৃত সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, তাও আবার ঈশ্বরের নামে। যার ঐতিহাসিক কোনো দলিল না থাকলেও ধর্মীয় গোয়ার্তুমির অভাব নেই; আর এই কারনে ঠিক ওই স্থানটিই দুজনেরই চাই। তবে এই রামমন্দিরের গল্পটা বড়জোর ১০০-১৫০ বছরের গল্প, কিন্তু জেরুজালেমের ‘আল-আকসা’ মসজিদ বা ‘টেম্পল মাউন্টের’ গল্প ৩০০০ বছরের পুরাতন। বর্তমানে ইহুদিরা ওই মসজিদের স্থানে তাদের কিং সলোমনের তৃতীয় মন্দির তৈরি করতে চায় যে কোনো মুল্যে। আচ্ছা তৃতীয় মন্দির কেন? তাহলে প্রথম আর দ্বিতীয়টি কোথায় আছে?
ইহুদিদের এখন ড্রিম প্রোজেক্ট হচ্ছে ওই কিং হোরাডের স্বপ্নের মন্দির বানানো। যেখানে বসে রাজত্ব করবে ধর্মগ্রন্থে বর্নিত ঈশ্বরের দূত তথা মসিহা। আগের পর্বেই বলেছি, এটা তৃতীয় মন্দির। প্রথম মন্দিরটি সেই কিং সোলেমন নিজেই তৈরি করেছিলেন খ্রীষ্ট পুর্ব ৯৫৭ সালে, ((Deuteronomy 12:2-27) যা ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুচাডনেজার-II দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ৫৮৭ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে। পড়ুন লিঙ্ক- (১)
ব্যাবিলনীয় সভ্যতার অবসান ঘটলে পার্সিয়ান সাম্রাজ্য বিশ্বশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। যাদের মধ্যে অন্যতম সফল পার্সিয়ান সম্রাটকে খ্রীষ্টান ও ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে ‘সাইরাস দ্যা গ্রেট’ ও ইসলামে ‘জুল-কার-নাইন’ নামে চিনে এসেছি। এই সম্রাটই ‘গগ-ম্যাগগ’ ভাষান্তরে ‘ইয়াজুজ-মাজুজ’ ভাষান্তরে ‘অত্যাচারী আর্য’ জাতিকে দুই পাহাড়ের মাঝে প্রাচীর তুলে বন্দি করে রেখেছিলেন। এই কাহিনী পরে নিয়ে আসব, যা এই ঘটনা ও আমাদের ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপুর্ণ। ইহুদিদের দ্বিতীয় মন্দিরটি এই আমলেই তৈরি হয়, আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৫৫৯ সালে।
এর পর পৃথিবীতে মধ্যে এক ব্যাক্তির আগমন ঘটল, যার নাম যীশু বা ঈ’শা(আঃ)। যিনি নিজেকে ইহুদিদের বাইবেলে বর্নিত নবী রূপে নিজেকে দাবি করলেন। জেরুজালেমের নিকটে নাজারেথ বা নাসারা নামক স্থানে ‘যোয়াকিম ও এ্যানা’ দম্পতীর সন্তান কুমারি মেরির গর্ভে যীশু খ্রীষ্টের জন্ম হয়। ইসলামে লুকমান(আঃ) ও হানা দম্পতীর কন্যা কুমারী মরিয়মের গর্ভে ঈ’শা (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। এখান থেকেই খ্রীষ্ট ধর্মের বীজ বপন। ইসলাম ধর্মে খ্রিষ্টানদের নাসারা বলে অভিহিত করা হয়, মানে তারা “নাসারার যীশুর অনুগামী’ এই কথাটির সংক্ষেপিত। উইকিপিডিয়াতেও দেখুন ‘Jesus of Nazareth’ নামেই উল্লেখ আছে।
ইহুদিদের বিশ্বাস তারাই একমাত্র উচ্চজাতি এই পৃথিবীতে, যারা ঈশ্বরের জন্য বিশেষভাবে মনোনীত ও আশির্বাদধন্য। সেই হেতু কোনো কুমারী মহিলার গর্ভে সন্তান মানে অবশ্যই তা পরকীয়ার ফসল। সুতরাং পিতৃ পরিচয় বিহীন ও অসতীর পেটে কিভাবে তাদের ঈশ্বরের দূত জন্ম নিতে পারে? অতএব তারা যীশুকে প্রফেট রূপে স্বীকৃতি দিলনা, উপরন্তু ইহুদি ধর্মগুরুরাই ষড়যন্ত্র করে রোমান গভর্ণর পন্টিয়াস পিলেতের সৈনদের কাছে যীশুকে ধরিয়ে দেয়। লিঙ্ক-(২) অন্যান্য ঘটনাক্রম সম্বন্ধে মোটামুটি আপনারা সবটাই ওয়াকিবহাল।
এই যাবৎ খ্রীষ্টান নামের কোনো ধর্ম ছিলনা, স্বয়ং যীশু খ্রিষ্ট মৃত্যুর মুহুর্ত পর্যন্ত ইহুদিই ছিলেন। ‘দ্যা লাষ্ট সাপার’ খ্যাত- যীশুর ১২ জন অনুচরের (Apostles) মধ্যে ইহুদি জুডাস বিশ্বাসঘাতকা করে ও পরবর্তীতে যীশুর ক্রুশিফিকেশন। বাকি ১১ জনের মধ্য হতে কেউ খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করেনি। সেন্ট পল(৩) নামের এক ব্যাক্তি যীশুর বাণী নিয়ে খ্রীষ্ট ধর্ম নামের নতুন এক ধর্মের সূচনা, প্রচার ও প্রসার ঘটান। খ্রীষ্টান ধর্মের সাথে জীবিত যীশু খ্রিষ্টের কোনো যোগ নেই, এবং তার অনুপস্তিতিতে ‘পল’ নামের ব্যাক্তিটিই তাঁর মতবাদ বা তাঁর নামে সৃষ্ট ধর্মের ‘ধারক ও বাহক’ হবে এমন কোনো তথ্যও কোত্থাও লিপিবদ্ধ নেই। এই পল ছিলেন এশিয়া মাইনর অঞ্চলের লোক ও বেন-ইয়ামিন গোত্রের গোঁড়া ইহুদি। খ্রীষ্টীয় ধর্মগ্রন্থ যা কিনা ঈশ্বর স্বয়ং যিশুকে দান করেছিলেন সেই বাইবেলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়না। বরং বর্তমান যে বাইবেল খ্রীষ্ট ধর্মে প্রচলিত- তার অধিকাংশই হল এই সেন্ট পল ও তার মানসপুত্র লিউকের রচিত।
এই স্থান থেকেই সংগ্রামের সুত্রপাত মধ্যপ্রাচ্যে। খ্রিষ্টীয় ধর্মের অনুসারীরা তাদের মসিহাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ইহুদি জাতিকে সর্বদা ঘৃণার নজরে দেখত। একটা সময় রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে ককেশীয়দের মধ্যে খ্রিষ্টীয় ধর্ম অতি দ্রুত ছড়িয়ে পরে। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী- খ্রীষ্টানদের ইহুদি ঘৃণার রেশ বিগত শতাব্দীর একনায়ক হিটলারের ‘হলোকাষ্ট’ পর্বই বলে দেয়- এই শত্রুতা আসলে ঠিক কোন পর্যায়ে পৌছেছিল। যদিও হলোকাষ্ট নিয়ে আমার নিজের বিচারধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে। নিশ্চই এটা পরে ব্যাখ্যা করব।
যে ঘৃণা মাত্র ৭০-৮০ বছর আছেই এমন ভয়াবহ ছিল, তা রাতারাতি উধাও হয়ে গেল কোন মন্ত্রবলে? ২০০০ সালের ঘৃণার পরম্পরার কাছে ৭০-৮০ বছর তো নস্যি। আজকে কিসুন্দর ভাবে রোমান ক্যাথলিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা ট্রাম্প, ইহুদি জেরার্ড কুশনারকে বিবাহ করতে পারে। আসলে এটার উত্তর রয়েছে “RACE বা জাতিগত ভাবে কারা ইহুদি”? এই প্রশ্নের মধ্যে। পরে এ নিয়েও বিশদে ব্যাখ্যা করব।
খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বাস হচ্ছে, যীশুকে ঈশ্বর প্রেরিত দূত হিসাবে না মানার জন্য ইহুদিদের উপরে ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে আসে। যীশুর মৃত্যুর পর তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বারা ৭০ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেম আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এবং প্রানে বাঁচতে ইহুদিরা উদ্বাস্তু হয়ে গোটা ইউরোপে ও পারস্যে ছরিয়ে পরে নিজেদের পিতৃভূমি প্যালেষ্টাইন বা আজকের ইজরাইল ছেড়ে। যীশুখ্রীষ্টকেই খ্রীষ্টান ও মুসলমানেরা ‘মসিহা’ বলে মান্যতা পোষণ করে, কিন্তু ইহুদিদের বদ্ধমূল ধারণা তাদের ‘মসিহা’ এখনও আসেননি, শীঘ্রই আসবেন। লিঙ্ক- (৭)
এখন এই যে মসিহা বা ঈশ্বর প্রেরিত দূত আসবেন পৃথিবী শাষন করতে ও ইহুদিদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি রূপে প্রতিষ্ঠা করতে, তার জন্য তো ঘর প্রয়োজন। তিনি কি আর আমার আপনার মত সাধারণ মানুষ? তার জন্য চাই মন্দির, আর এই মন্দিরই হল ‘Third Temple”। যার জন্যই এই ইজরায়েল নামক রাষ্ট্রের অবতারণা। কারন ইহুদি বাইবেলে লেখা আছে তাদের মসিহা জেরুজালেমে বসে বিশ্ব শাষন করবে, এবং সমগ্র পৃথিবীর মানুষ ইহুদি হয়ে যাবে। (Isaiah 2:11–17)। বুঝতে পারলেন না তো? “one world order” এর আঁতুড়ঘর।
মধ্যপ্রাচ্য কেন অশান্ত, কেন সকল দেশগুলোতে সমস্যা সমাধানের জন্য আমেরিকা ইজরায়েল দালালি করছে! ওদের সকল গনতন্ত্রই ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ দেয়, কিন্তু নিজেরা প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলছে তাদের গোঁড়া ধর্মীয় পুস্তকের অন্ধ অনুকরণ অনুসরণ করে। এবারে বিষয়টা নিশ্চই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
এর পরেও মনে সন্দেহ আছে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট সাম্প্রদায়িক জাতি কারা? আপনি আমি কাল কি খাবো সেই চিন্তায় মাথার চুল ছিড়ছি, আর ইহুদিরা ৩০০০ বছরের পুরাতন কেচ্ছা বা গাল-গল্পকে বা ধর্ম বিশ্বাসকে রূপ দিতে অত্যন্ত পরিকল্পনা করে গনহত্যা, অনৈতিক গাজোয়ারি দখলদারি, সন্ত্রাসের আবহ, ও গনহারে পাবলিককে টুপি পরিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু কিভাবে এই পথে ইহুদিরা অগ্রসর হয়ে আজকের ইজরায়েল বানালো? কারা তাদের সহযোগী? আমেরিকার মাথাব্যাথা কেন ইজরায়েলকে প্রতিষ্ঠা দিতে? বাকি দুই আব্রাহামীয় ধর্ম কি বলছে এই মসিহা সম্বন্ধে? এর ভবিষ্যতই বা কি? আমরা ভারতীয়রা এই দিড়িটানাটানির মাঝে কোথায় দাঁড়িয়ে? পরের পর্বে চোখ রাখুন।
...ক্রমশ
(উন্মাদীয় বানানবিধি)
@উন্মাদ হার্মাদ

No comments:

Post a Comment