Sunday, 28 September 2014

***ছেলেবেলা***


*****ছেলেবেলা*****



সেটা নব্বই এর দশকের এক্কেবারে গোড়ার কথা।

বাড়ির অদুরেই ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। বাবার খুড়োতুতো এক বোন, মানে আমার এক পিসির বিবাহ উপলক্ষ্যে। সকলেই কমবেশি শশব্যাস্ত। বাড়িতে লোককুটুমে গমগম করছে। আমাদের সেই বৃটিশ কালের কড়িবরগার উঁচু উঁচু বাড়ি, বিয়ে উপলক্ষে কিছুদিন আগেই জানালা দরজায় আলকাতরার নতুন লেপ পড়েছে। জানালা ফাক গলে ফিনিকি দিয়ে ছিটকে পরা রোদ্দুর, নতুন এলামাটি করা দেওয়ালকে যেন আরো চকচকে করে তুলেছে।

তুতো ও সহোদরা ভাইবোনদের সাথে তখন নিয়মিত কানামাছি, বা কুমির ডাঙ্গা বা বিকালে গোল্লাছুট, হিঙ্গেডারি খেলা লেগেই থাকতো। তখন বাবা কাকারা সবে মাত্র আলাদা হয়েছে, হাঁড়িতে। কিন্তু কড়া-খুন্তির ওই সময় টুকু বাদ দিলে মেজকাকি মায়ের মাথায় প্যারাসুট নারকেল তেল লাগিয়ে দিতে দেখেছি, বা মা, কাকার ১ বছরের কন্যাটির জন্য রসুন পুড়িয়ে কাজললতায় নতুন কাজল পেরে দিতেন। শীতের সময় ঠাকুমা সহ মা কাকিমারা একসাথে আতপ চাল কুটতে যেতেন, একসাথেই পাড়ার ঢেঁকিতে। কাঁথা পাড়তেন, পরনিন্দা পরচর্চাও মন দিয়েই করতেন, একসাথে বসে। মাঝে মাঝেই ঝগড়াও হত, তবে সেটা ওই ২-৩ দিন স্থায়ী হতো, তারপর আবার... যে কে সেই। তাই আমাদের ভাইবোনেদের ভিতরে কখনোই নুন্যতম দুরত্ব ছিলো না।

সাতসকালে সক্কলের আগে ঠকুমাই নিদ্রাভঙ্গ করতেন, একে একে মা কামিমাদের পালা। তার পর বাবা কাকারা। এরপর আমরা ও সর্বশেষে দাদু। অনিদ্রা রোগের কারনে উনি ঘুমাতেনই ভোরের দিকটাতে।

ছোট বেলায় আমার অদ্ভুত অদ্ভুত শখ ছিল। যেমন কাঁচ ভাঙ্গা, ড্রেসিং টেবিল বা খরখরি যা ই বা হোক না কেন। নতুন পর্দা বা বিছানার চাদর কাটা। রাগ হলে, বাবার দাড়িকাটার রেজার দিয়ে পোষ্য মেনি বা ভুলোর লোম চেঁচে দেওয়ার মত বৈপ্লবিক কর্মকান্ডও ছিলো। নিজের হাত পায়েরও লোম চেঁচেছি বহুবার। সন্ধ্যাবেলা যতদিন না জলযোগ করেছি, তার থেকে বেশী প্রহারেনঃ ধনঞ্জয় হয়েছি। একবার তো আমাদের গাই টার লেজের লোমগুলোই কাঁচি দিয়ে জাষ্ট উড়িয়ে দিয়েছিলাম। বাবা খুব একটা মারধোর করতেন না, মা একাই যাথেষ্ট ছিলেন। সেই গাইয়ের বাছুর বাঁধার দড়ি দিয়ে বেধেই প্রহার হয়েছিল। তবে ত্রাতা হিসাবে ছিলেন আমার একমেদ্বিতীয় পিতামত- দাদু। ধুম্রপানের মত বহু স্পর্ষকাতর বিষয়েই যিনি আমার হাতে খড়ি দিয়েছিলেন সযত্নে।

চৈত্র বৈশাখ মাসে আকাশে কালো মেঘের দেখা দিলে, হাওয়া মোরগের মত আমাদের ও আবহাওয়া সেন্স বেশ বলে দিতো, ঝড় উঠবে কি না। সেই তখন মা এর মানা করার আগেই ভোঁ ভা দৌড়, আম বাগানের দিকে। কশি- আধপাকা-হড়হড়ে কাঁচা আর কোকিলে পাদা আমের দারুন ভোজ চলতো। বাড়িতে কিছু নিয়ে আসতাম, তবে তাতে পিটুনিটাই পিঠে পড়তো, বেয়াড়া পনার জন্য। কোকিলে পাদা আম গুলোর বিশেষত্ব ছিলো যে, ওগুলো বাকি সব আমের থেকে আগে পাকতো, এবং একটা অংশ কোন কারনে থেঁতলে কালো হয়ে যেত। বড় হবার পর সেই সব আম গুলোই মুখে নিয়ে দেখেছি, এত্তো টক... যে বাঁদরেও ছোবে না। অবশ্য সে সময় আমরা বাঁদরের বাড়াই তো ছিলাম। তাতে আর সন্দেহ কি!

স্কুলে অবশ্য একা একাই যেতাম, ভাই অন্যস্কুলে বোনেরা গার্লস স্কুলে পড়তো। সব্বাই বাসে বা সাইকেলে চড়ে যেত। স্কুল ২-৩ কিলোমিটারের মধ্যেই ছিল। আমি হেঁটেই যেতাম, কারন ক্লাস ৫ পর্যন্তই চারটে সাইকেলের বলি চড়িয়েছিলাম সুতরাং বাড়ির কথা মত “বুদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত আর নয়”। শুধু সাইকেলই বা কেন? জুতোজোড়াও আমার সাথে সমানে বিট্রে করে গেছে মাধ্যমিক পর্যন্ত। ক্লাস ৪ থেকে ক্লাস ৯ পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় কমবেশি ৬ মাস খালি পায়েই স্কুল গেছি। বই খাতা পেন্সিল যে হারাই নি তা নয়, কিন্তু তাতে তো আমি চিরদিন খুশিই হয়ে এসেছিলাম।

স্কুল বাক্সে টিফিন থাকতো না। সাথে থাকতো একটা বাঁকা গাছের ডাল, চাঁচাছোলা ও সামনের মাথাটা সাপের ফনার মত একটু চওড়া ও বাঁকানো। ওটাই তো আমার বা আমাদের খেলার সরঞ্জাম ও অস্ত্র। তখন প্লাস্টিকের বলে ক্রিকেট খেলার খুব রেওয়াজ ছিল। যে বল গুলো আবার ওজনের হিসাবে বাজারে পাওয়া যেত। ১০০ গ্রাম, ৬০ গ্রাম, ৪০ গ্রাম ইত্যাদি নানা মাপের। ওই বলের আঘাতের দাগ এখনো শরীরের বহু স্থানে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। টিফিনের সময়টা আসতে যা দেরি ছিল, ব্যাস আমাদের সময় শুরু হয়ে যেত। কোন রকমে পঞ্চম পিরিয়ড টা শেষ করেই আবার শুরুহয়ে যেত। সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত স্কুল মাঠেই চলতো খেলা, এ্যালুমিনিয়ামের স্কুল বাক্স দিয়েই তো উইকেট হতো বেশিরভাগ দিন। এছারাও সবাই থাকলে কুমিরডাঙা, চোর-পুলিশ-ধাপ্পা, কানামাছি, ডাংগুলি, সামনে একজন নিল্ডাউন হয়ে তার পিঠের উপর দিয়ে জাম্প আর কত কি... আর একা একা থাকলে! সাইকেলের টায়ার চালানো, ঘুড়ি উড়ানো, অনির্দিষ্টকাল সাঁতার কাটা, ছিপ ফেলা, লাট্টু আর তার লেত্তিনিয়ে কেরামতি... সে এক এলাহি খেলার আয়োজন।

সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসতাম সাধারনত পিসিদের ঘড়ে, আমরা সব তুতো ভাইবোন মিলে। পিসিদের ঘরটা আমাদের আর কাকাদের ঘরগুলোর মাঝে ছিল, ফুল পিসি আর ছোটোপিসির তখনো বিয়ে হয় নি। ওনাদের কাছেই ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি। হ্যারিকেনের নরম আলো যেন চোখে সুড়সুড়ি দিতো, আধাঘন্টার মধ্যেই যাবতীয় শক্তি দিয়ে ঘুম, চোখের সাটার টেনে বন্ধ করে দিতে চাইতো, মায়ের পিটানির ভয়ে আমিও আলাদিনের জ্বিনের মত চোখ টেনে টেনে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। ওই জেগে থাকাই হতো, পড়াশোনা অশ্বডিম্ব। ভ্রাতা ভগিনীগণের ক্রম-নালিশ থেকে পরিত্রান পেতে, বুকে ভর দিয়ে, উবু হয়ে পড়তাম, মাথা নিচু করে। তাতে করে চোখটা আর দেখা যেত না। আবার কখনো কখোনো হ্যারিকেনের বাতিটা লম্বা করে দিতাম, স্বাভাবিক ভাবেই কালো ধোঁয়া কাঁচে কালির পোঁচ লেপে দিতো। তাতে আলোর উজ্জ্বলতাও কমত আর আমার চোখের দিয়ে নজর করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হত। এর পর একটু পাতলা পাতলা ঠ্যাঙানির সাথে সাইড ডিস হিসাবে মায়ের হাতে, অল্প ভাত খেয়েই দে ঘুম। একটু খানি প্যান্ট না ভেজা পর্যন্ত, হিসিও করতে যেতাম না।

ম্যারাপের ব্যাপার টা যখন ঘটেছিল, তখন ক্লাস ফাইভের হাফ ইয়ার্লি এক্সাম শেষ হয়েছে সবে। এই অনুষ্ঠানের দিন গুলোতে অবভাবকদের শাসনের নিয়মজাল প্রায় থাকতো না বললেই চলে। ওই সময় জেনারেটর আনা হত বড় অনুষ্ঠান হলে, আর ছোট হলে হ্যাজাক। গোয়ালের পাশে কলপাড়ের গা ঘেঁসে বিকট শব্দে সন্ধ্যা নামতেই জেনারেটর চালু। আমাদের পাকা রাস্তার ধারের বাড়ির একতলার ছাতেও ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে, বিবাহ অনুষ্ঠানে আগত আত্মীয় কুটুম্ব ও পারিবারিক পুরুষ সদস্যদের রাত্রি বাসের স্থান।আমিও পাড়াতুতো কয়েকজন সমবয়সীদের সাথী করে ওই খানেই রাত্রি বাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারন খুব পরিষ্কার। রাত্রে ভিডিও দেখানো হবে। কাকার দলই সেই বন্দব্যাবস্থা করেছিল। মায়ের তীব্র আপত্তি অবশ্য কাকাদের কাছে টেকেনি, তবে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল যে আমি ঘুমিয়ে গেলে ঘরে পৌছে দিতে হবে।

তখন আনন্দ আর দেখে কে!! সম্পূর্ন সঙ্গত কারনে। অন্যান্য বাড়িতে ব্যাটারি চালিত টিভি থাকলেও, ওই ব্যাপারটা আমাদের বাড়িতে? জাষ্ট অকল্পনীয়। ঘরে টিভি আছে, এ কল্পনা করার থেকে, শক্তিমান আর ডাঃ জয়কাল একসাথে বসে তাস খেলছে, সেটা কল্পনা করা বেশী সহজ ছিলো। বছরে ২-৫ বার মামা-মাসি বা পিসির বাড়ি গেলে ওই কদিন সারাদিন খেলা করার পাশাপাশি দুমারে চলতো টিভি ভক্ষন। ক্রিকেটে দেখার ভুত তখনো মাথায় চড়ে বসেনি। ঠাকুমা কাকিমা রা অবশ্য তখন চিত্রহার- শ্রীরামকৃষ্ণ, শুধু প্রিয়তমা আর শুধু তোমার জন্য বা জননী বা জন্মভূমির প্রেমে পাগল। হিন্দি সিরিয়াল বলতে মহাভারত ও অবশ্যই শক্তিমান। আর মুঙ্গলিকে অস্বিকার করি কি ভাবে? বা আলিফ লাইয়া। মাঝে মাঝে বাংলাদেশী চ্যানেল ধরলে “মিঠু-মীনা” কার্টুনও দেখার সুযোগ মিলতো। কিন্তু সিনেমা? নৈব নৈব চ। ছুটির দিনের দুপুর গুলোতে কাকার টিভির ঘর থেকে ভেসে আসা সেই আওয়াজ “ চুপি চুপি পাগল হাওয়া এসে বলে গেলো, প্রিয়তমা ফিরে আসবে আবার, বলবে কিছু কথা ভালোবসার”

তবে রেডিও টা চলত। কোলকাতা ক থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিও বা বিবিধ ভারতী। সেটা সকাল সন্ধ্যে দাদুর ঘরের খোলা জানালা দিয়ে ভেষে আসতো, আর খুব গরম করলে আমাদের ওই একতলার ছাতে ক্যাম্প খাট বিছিয়ে দাদুর রেডিও চালু হয়ে যেত। আর তার সাথে সুর তাল হীন দাদুর স্বরচিত মাথামুন্ডুহীন গান।। “একটি তারা দুটি তারা, তারার ভাই বাঘমারা” এই গোছের। এটাই বিভিন্ন সুরে রোজ গাইতেন উনি। ওখানেই নানা ধরনের গান শুনতাম। এই গানটাও ওখানেই শোনা। “বাহো মে বোতল, বোতল মে...” হিন্দি মানে রাষ্ট্রভাষা জানতাম না, জানার প্রশ্নও ছিল না। তাই গানটার মানেও জানতাম না, চেষ্টাও করিনি, কোন সিনেমার গান সেটাও জানতাম না। কিন্তু বড্ড ভালো লাগতো ওই গান টা শুনতে। কেমন যেন নাচ পেয়ে যেত, শুনলেই। আরো বেশ কয়েকটা গান ছিলো, ওই ভালো লাগার লিষ্টে। পিসিদের মুখে কিছু গান অবশ্য ছিলো। আশিকী সিনেমার। সেই ধরনের ড্রেসও নাকি পড়তেন। আমার অবিশ্যি ওই গান ভালো লাগতো না। আজ বুঝি সেই বয়সে ওই ভালো লাগাটাই আশ্চর্যের ছিলো।

সেই রাত্রে ছাতের ম্যারাপের ভিতর রাত নটা নাগাদ ভিডিও চালু হলো। গায়ে হলুদের রাত, কাল বিয়ে। ওমা... শুরুতেই গোলমাল। অনেক প্রচেষ্টার পর সাথের ছেলেটি খান দুয়েক ভিসিআর মেসিন পালটে আধা ঘন্টা পর ফের চালু হলো। সবার সেকি উৎকণ্ঠা। একদম নতুন একটা সিনেমা এসেছে, মাত্র বছর তিনেকের পুরোনো। আমাদের মফঃস্বলে ওটাই যদিও শুভমুক্তি। ওই শুরু রাতে প্রথমে ভিসিআর মেসিনে চালু হলো “ছোটো বউ”। সে কি ভিড় মানে মা কাকিমা থেকে শুরু করে পাড়াতুতো বিভিন্ন বয়সী স্ত্রীলোকের। সে রাত্রে আমার ঘুমেরা যেন নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিলো। কান্নাকাটির সে এক মহাকুম্ভ। সকলের সাথে মিলে আমিও খানিক কাঁদলাম। যাক শেষ পর্যন্ত ওই সিনেমা শেষ হলো। এর পর হিন্দি সিনেমা চালানো হবে। মা কাকিরা সহ বেশিরভাগ স্ত্রীলোক শুতে গেলেন। আমি কিন্তু ঠায় বসে।

পরবর্তী সিনেমার নাম জানি না, যদিও সেটার দরকারও ছিলো না। যা ই হতো না কেন সেটাই তো দেখতাম। সিনেমা চালাতেই দেখলাম যুবক ছেলে ছোকরার দলের সে কি উল্লাস। সিটি ফিটি মেরে সে এক পরিস্থিতি। তার উপরে ওদিকে রাত প্রায় বারোটা। ছেলেদের ভীড়টা একটু বেড়ে গেলো। কয়েকজন তো গুরু গুরু বলে মাঝ রাত্রে এমন চেল্লানি জুড়ে বসলো যে , নিচেথেকে জ্যাঠার বাঁজখাই গলার আওয়াজকে প্রকট করে দিলো।

বেশ খানিক গনেশ বন্দনার পর সিনেমা শুরু হলো। প্রথমেই নাম দেখাবে। তাই হিসি করতে গেলাম। এসে বসতেই দেখি পর্দার আড়াল থেকে একটা মুখ বেড়িয়ে এলো। কপালে লাল টিপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, আর একটা অপার্থিব হাসি। চোখে ধাঁধাঁ লেগে গেলো। সেই প্রথম কাওকে দেখে বুকটা ধড়াস ধড়াস করে উঠলো। নাম জানিনা ওই মেয়েটির। মধুকাকাকে শুধাতে বললো ওটা নায়িকা, নাম মাধুরী। বেশ অনাগ্রহের সাথেই বললো। বললো একটু ওয়েট করতে, খানিক পরেই নাকি গুরু আসবে। আমার চোখ থেকে মন সবকিছুই অবশ্য ওই মাধুরিতেই আটকে ছিল। পরে অনেক নায়িকা দেখেছি ও দেখছি এবং দেখবোও। ওই প্রেম আর কারো সাথে হয়নি। লাভ এট ফার্ষ্ট সাইট, হে হে হে। হলুদ শিফন শাড়ি পরে, চুলের বিনুনি বুকের কাছে নিয়ে, আনমনে ওইভাবে খেলা করা, বা এ দাদ্দু বলে ডাক... বাস্তবেও কারো প্রতি ওটাই আমার প্রথম প্রেম। কতবার যে মাধুরির পোষ্টার দেখে, লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েছি, তার ইয়াত্তা নেই।

সে যাই হোক গুরুকে দেখবো বলে অপেক্ষায় আছি, দেখি একটা বয়স্ক লোক এলেন আমার নায়িকার কাছে। কাকাকে শুধালাম – ইনিই গুরু? আবার গাঁট্টা খেলাম। হালকা করেই। চুপ মেরে গেলাম। এরপর দেখি একটা সব্জি বাজারের দৃশ্য, ছোটকা কাকা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমাটা দেখেছে, ও ই চেচিয়ে সব্বাই কে চুপ করে যেতে বললো। আমি তো আগে থেকেই চুপ ছিলাম। দেখি একটা মোটা কালো করে লোক সকলের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে, খানিক পর একজন একজন দিতে অস্বিকার করলো, ওই মোটাটাকে টাকা দিতে, এবং ঘাড় ধাক্কাও দিয়ে দিলো। এর পর সব্বাই চুপচাপ, সবারির নজর সামনের দিকে, টিভিতেও ম্যারাপেও।

টিগ ডিগ ঢুশ... ট্যারারারারারা......
টিগ ডিগ ঢুশ... ট্যারারারারারা......
টিগ ডিগ ঢুশ... ট্যারারারারারা......

বেশ কয়েকবার ওই আওয়াজের পর দেখলাম মুখের এক কোনে জলন্ত বিড়ি, মুখে চোখে কাঠিন্য, গোল সাদা গলা বেগুনি গেঞ্জি, উপরে বোতাম খোলা হালকা হলুদ রঙের জামা পরিহিত কাধ পর্যন্ত চুলের এক মানুষের আবির্ভাব। সাথে সাথেই জ্যাঠার শাসানী উপেক্ষা করে রাত্রির নিঃস্বব্ধতাকে বিদীর্ন করে গগনভেদি সমস্বরে উচ্ছাস...

গু..............................রু...........................

আমি খানিকটা ভিরমি খেয়ে আরো চুপ মেরে গেলাম। বুঝলাম ইনিই গুরু। এর পর মারামারি... রক্ত গরম করা সংলাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মাঝে একটা গানও হয়ে গেলো, তবে আমার নায়িকাকে ওই রান্না বিক্রি করতে দেখে খুব কষ্টই হয়েছিল। দাদুটাকে মদ খেতে দেখে বেশ ঘেন্নাই লাগছিলো। কারন মা ওটাই শিখিয়েছিলেন, মদ খুব খারাপ বস্তু। মদের দোকানের সিড়ি দিয়ে যখন, নাভিকুন্তলের সামান্য উপরে কাঁচুলি পরিহিতা, প্রশস্ত বিভাজিকা উন্মুক্ত করে মাথায় এক বেনী খোপা করে রসিলি বাই যখন নেমে এলেন, কাকাদের মাঝে আমার সে কি লজ্জা। কপট ঘুমের ভান করে শুয়েই পড়লাম। মাঝে মাঝে আড় চোখে দেখছি। গুরু আবার সেই মিউজিকের সাথে এন্ট্রি নিলেন, ভিতরে লাল গেঞ্জি, সাদা প্যান্টের সাথে, স্বচ্ছ সাদা জামা, বোতাম খোলা। বুঝলুম ওটাই গুরুর সিগনেচার স্টাইল। হয়ত ঘুমিয়েই যেতাম, ঠিক তক্ষনি...

“বাহো মে বোতল...”। সব ঘুমের নেশা দৌড় লাগালো। ফের ঠারো হয়ে বসলাম। দেখি ওই রসিলি বাই এর হেলে সাপের মত শরীর এঁকে বেকে , সে কি নাচ। বুকের ভুতর টা যেন খামচে দিচ্ছিল। কমন গান। আগে বহুবার শোনা। নাচতে ইচ্ছা যাচ্ছিলো। বহু কষ্টে সেই ইচ্ছা অবদমিত হলো, দেখলাম গুরুর বিনা বেল্ট পরার ফ্যসন। সাথে ব্রেক ডান্স। খানিক পরে সবাই নাচতে শুরু করলো, আমিই বা বাদ যাই কেন!

খানিক পরেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম, তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই। বিয়ে মিটলো। আবাঁর আমার থোর বরি খাড়া জীবন শুরু হলো। তবে তখন থেকে গান শুনলেই সিনেমার নাম আর নায়ক নায়িকার নাম, সুযোগ সুবিধা মতন কাওকে ঠিক শুধিয়ে নিতাম। আর তক্কে তক্কে থাকতাম, পছন্দের গানের সেই সিনেমা কবে দেখা যাবে, তার জন্য।

আজও গানটা অনেক স্থানে পথ চলতি শুনতে পাই। শরীর নাচাতে না পারলেও , মনটা ঠিকিই নেচে উঠে। এটা তো এখন মাতালদের জাতীয় সংগীত সম, আর যে কোন আরঙে এই গান ছারা জৌলুশ অধরা সেটা বলাই বাহুল্য।

এখনো গুরু বললে মিঠুন কেই বুঝি, আর প্র্থম প্রেম??

হা হা হা..................

(উন্মাদীয় বানানবিধী অনুদৃত)
উন্মাদ হার্মাদ

No comments:

Post a Comment