তখন গড়িয়াতে
মেসে থাকি আমরা ১১ জন মিলে। ৫ জন ক্লাসমেট, তাই এক সাথেই যাতায়াত করতাম বা
যাবতীয় রুটিন প্রায় একই ছিল। একজন কাজের মাসি ছিল, কিন্তু তিনি শুধুই ঘর মোছা, থালা ধোয়া
আর কেটে-বেঁটে দিয়ে যেতেন। রান্না নিজেদেরই করতে হত পালা করে। এক সন্ধ্যাতে আমাদের
পাঁচজনের রান্নার পালা,
হঠাৎ করে সীতানাথ দা এসে খবর দিল যে; সে প্রেমে পরেছে। এই ধরনের খবর মেস
বাড়িতে নতুন কিছু নয়,
খাওয়া হাগার মতই রোজকার স্বাভাবিক বিষয় প্রেমে পরা ও ছাড়া। কিন্তু সীতানাথ দা
তো আর আমাদের মত কলেজ পড়ুয়া লম্পট ছিলনা, তিনি তখন সদ্য বছর খানেক দীনবন্ধু
এন্ড্রুজ কলেজে লেকচারার হিসাবে জয়েন করেছে।
ভীষণ একাগ্র
মেধাবী ছেলে ছিলেন সীতাদা,
আর তার প্রতি আমাদের সকলের একটা গভীর প্রেম বা অনুরাগ ছিল। কারনটা ততোধিক
নচ্ছার। মেসে ওনারই একমাত্র কম্পিউটার ছিল, আর ফি শনিবার তাতে প্রায় হোলনাইট
পানু প্রদর্শন হত। আশেপাশের মেস থেকেও সম্মানীয় অতিথিরা তাতে অংশ নিতেন চাট ও বোতল
সহ। মেসের মালিক যতীন বিশ্বাস পূর্ববঙ্গীয় মানুষ, মধ্য পঞ্চাশের অকৃতদার। উনিও
গলাখাকারি দিয়ে এসে রীতিমত সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করতেন। প্রথম প্রথম চক্ষুলজ্জার
খাতিরে ব্যাপারটা হজম না হলেও পরে সয়ে গেছিল। মানে ওই একটা দিন আমাদের সাপ্তাহিক
পিকনিক ছিল। আমরা জানতাম সীতাদা স্বমৈথুন করে, পানু দেখে, আর পড়াশোনাও
করে। তা বলে প্রেম! হরপ্পা সভ্যতা আমলে বহরমপুরের স্কুলে পড়াকালীন একটা প্রেমিকা
ছিল বটে, আজও
তার জন্য রোজ কাঁদে এটাই জানি। উল্টে আমরা যারা নিয়ম করে রোজ প্রেমে পরতাম তাদের
মধ্যমা প্রদর্শন করত। তাই ওনার প্রেমিকার খোঁজটা আমাদের কাছে বেশ কৌতুহলেরই ছিল।
তো সীতাদা
বলে বসল “বাচ্চেলোগ, বিড়ি লাও”। সীতাদা আর বিড়ি!
যাই হোক আমার ভাণ্ডারে ভগাদা বিড়ি কখনই অপ্রতুল রাখেনি। সেখান থেকে একটা বিড়ি
সীতাদাকে দিতে, তিনি
ধরিয়ে টান দিতেই চোখ নাক দিয়ে জল বের হতে শুরু হল। অনভ্যাসের গলা সইতে পারবে কেন!
তার পর শুরু হল বিশাল ভণিতা পর্ব, কিন্তু কি হয়েছে আর বলেনা। পাবলিক উসখুক করছে, এই পর্ব শেষ
হয়ে কখন আসল শো শুরু হবে। ধৈর্য নিয়ে বসে আছে, কিন্তু সীতাদা ভাবছে তাঁরা বোধহয় তার
প্রেমের গল্পেই মশগুল। শেষে যখন আজ আর পানুশো হবেনা ভেবে, খাওয়া দাওয়া
সেরে যে যার মত শুয়ে যাবার উপক্রম করছে; সীতাদা বুঝল পাবলিক আকর্ষন হারিয়েছে।
তখন আবার তোড়জোড়ে দ্বিতীয় কনক্লুসন পার্টের ঝাঁপি খুলে বসল।
বিশদে সে
অনেক কথা, কিন্তু
চুম্বকে যেটা জানা গেল,
উনি যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছে সেটি পুলিসের মেয়ে, তারই কলেজের তথা ক্লাসের ছাত্রী। তাই
ভয়ে তাকে বলা তো দুরঅস্ত ভাবলেই যেন ক্লীব হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি দলেই একটা হোৎকা
টাইপের হুপোমার্কা বন্ধু থাকে, যারা সবেতেই হ্যাঁ বলে। যথারীতি বাবাই বলে বসল, চলো গুরু
তুলে আনব। কারন এর আগে এমনই এক-দুটো কেসে সাফল্য এসেছিল তাই ঝাঁপিয়ে পরতে
দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। শো শুরুর আগেই পলিটবুর্যোর মিটিং বসল, পরদিন
রবিবার। অতএব কালই হোক,
অভিযানের নেশাতে দুম করে বাবাই এর প্রস্তাব লুফে নিলাম। ৬ জন বাড়ি চলে যাবে
পরদিন, সীতাদা
বাদে বাকি থাকবে চার। আমি,
বাবাই, পার্থ, প্রদীপ। ঠিক
হল আমরাই প্রস্তাব নিয়ে মেয়ের বাড়ি যাব, চরৈবেতি।
পর দিন সকাল
থেকেই চরম বৃষ্টি, সে
কি ভীষণ জোশ সহ বেড়িয়ে ষ্টেশনে এলাম। মেয়ের বাড়ি বালিগঞ্জের এলিট পাড়ায়। সারারাত
বৃষ্টিতে বাস ট্যাক্সি প্রায় নেই, শেয়ালদা ষ্টেশনে জল জমে ট্রেন চলাচলও সেই সময় বন্ধ। তখন
আমরা ট্যোটাল বিপ্লবী মুডে,
এই সব অবরোধ থোড়াই কেয়ার। হেঁটেই পৌছালাম বালিগঞ্জ ষ্টেশনে রেললাইন ধরে ধরে।
এড্রেস চিনে চিনে ঠিক বাড়ির সামনে পৌঁছে কলিং বেল টিপতেই একজন পরিচারিকা এসে দরজা
খুলে দিল।
- কাকে চাই
- সাহা বাবু
বাড়িতে আছেন?
- আছেন, কি বলব?
- বলুন খুব
গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে কথা আছে।
খানিকক্ষণ
পর সেই পরিচারিকা আমাদের ভিতরের বসার ঘরে বসিয়ে রেখে আরো অন্তঃপুরে চলে গেলেন।
ফ্যান চলছিল, বাইরে
বৃষ্টিটা বেশ জোরের সাথেই আবার এলো তাই ঠান্ডা লাগতে শুরু করেদিল। আসলে আমরা প্রায়
চার জনেই কাকভেজা অবস্থাতে ছিলাম। দেখি মধ্য বয়স্ক এক ভদ্রলোক এলেন, দেখেই মনে
নয় যেন কোষ্ঠকাঠিন্যের পেসেন্ট। খেকুশে মার্কা চেহারা, মেজাজ
তিরিক্ষে হয়েই আছে। ৪০-৪৫ এর মধ্যের বয়স, দশাসই চেহারা। ইনিই যে সেই পুলিস
বুঝিনি, পরে
নিজেই নিজেকে এড্রেস করতে বুঝলাম। সটান আমি শুধালাম
- অনিন্দিতা
আপনার আত্মিয়া?
- হ্যাঁ, বলুন কি
বিষয়ে এসেছেন!
- আমরা একটা
গুরুত্বপূর্ন প্রস্তাব নিয়ে এসেছি
- কি বিষয়ে
সেটাই তো শুধাচ্ছি? কি
করো তোমরা?
- সেটা না
জালনলেও চলবে- প্রদীপ দীপ্ত ভঙ্গীতে জবাব দিল।
- বুঝলাম, কি বিষয়ে
বলুন, আমিই
ওর লিগাল গার্জেন
- আগে ওকে
ডাকুন, সামনাসামনি
ছাড়া কথা বলা যাবেনা- বাবাই বেশ জোরের সাথে কথাকটা বলল
-
অনি.........
একটা ভীষণ
গোলগাল মোটাসোটা ও স্কার্ট পরিহিতা মেয়ে প্রায় গড়াতে গড়াতে সসামনে এলো। চোখের ফিতে
দিয়ে ৫-৬ বার মাপলাম পা থেকে মাথা পর্যন্ত, নাহ প্রতিবারই পাঁচফুটের নিচেই
পরিমাপ দাঁড়ালো। ফোলাফোলা গালের আড়ালে থাকা চাইনিস চোখগুলো দিয়ে কুতুকুতু করে
আমাদের দেখতে লাগল। তবে যতই অখাদ্য মত গড়ন হোক, সীতানাথের পছন্দ আমাদের তাতে কি! তার
বর্ণনার সাথে হবহু মিল দেখে বুঝলাম এনিই তিনি।
- সীতানাথকে
চেনো?- আমি
শুধালাম
- কোন সীতা?
- এন্ডুজ
কলেজের প্রফেসর সীতানাথ পাল
- হ্যাঁ
চিনবনা কেন, আমাদের
স্যার তো
- আর বাকিটা? - প্রদীপ
শুধালো
- কি বাকিটা?
- এই ছোকরা
যা বলবে সোজাভাবে বলো- সেই বয়স্ক ভদ্রলোক রাগত স্বরেই বললেন
- শুনুন, আমরা
অনিন্দিতাকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছি, তার প্রেমিকের আদেশে। এই জালিম
দুনিয়া...
মানে এর পর
হিন্দি, বাংলা, ইংলিশ, ও পানু
সিনেমার বিভিন্ন ডায়লোগকে একত্রে পাঞ্চ করে একটা নতিদীর্ঘ ভাষণ দিতে শুরু করল।
আমরা তাতে মগ্ন হয়ে ছুলাম,
শেষ হতেই বুঝলাম সেই ভদ্রলোক আমাদের সামনে নেই। এদিকে অনিন্দিতা রেগে কাইমাই
করছে বিচিত্র ভাষাতে। বাইরের দিক থেকে আওয়াজ এলো, “কলেজের নামে তুই এইসব করছিস?”
কানে অনুভব
করলাম পালাবার গেটে তালা পরে গেল। যথারীতি ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে পুলিসের জিপ এসে
আমাদের তুলে নিয়ে গেল। তারপর? জীবনে প্রথববার লালবাজারের লকাপ দর্শন। আর ক্যালানি!! শুধু
পাছাতে, আজও
আয়নাতে পাছা দেখলে শিউরে উঠি। পরদিন আমাদের মেসের মালিক ব্যাক্তিগত বন্ড দিয়ে
ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন আমাদের।
আমাদের
মামাবাড়ি যাবার খবর মেস পর্যন্ত পৌছাতেই সীতা বনবাস নিয়ে গায়েব হয়ে গেছিল।
পরে তাকে
কলেজে গিয়ে একবার শুধিয়েছিলাম- “সীতা দা তুমি কি জানতেনা যে অনিন্দিতা পুলিসের মেয়ে নয়, বয়স্ক
পুলিসের তরুনী স্ত্রী। আমরা না হয় জোশের বসে প্রায় না থাকা সিঁদুর খেয়াল করিনি ওই
অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে,
কিন্তু তুমি?”!
সীতাদার
একটাই জবাব ছিল- “কম্পিউটারটা
আমি আর নিয়ে আসছিনা বুঝলি,
তোরা ব্যবহার করতে পারিস”
~সমাপ্ত
উন্মাদ
হার্মাদ