টেঁপি সমাচার
আমি আর
ইস্কুলে যাবনা মা...
এ কি
অলিক্ষুনে কথা, কেন
যাবনা তাই
যাবনা
ভয়ঙ্কর চাপে
কুলোদারানী দেবী। আর চাপে পরবেই না ই বা কেন! পারুলবাবার মতি সুবিধের ঠেকছে না।
রাত্রে কত্তা পুলিন বাবু ঘরে এলে তাকে কথাটা খুলে বতলেই তিনি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।
“আজ
পোরজোন্তো কোন সুবিদার কতা আমাকে বলেচো যে আজ সমোসসার কতা কইতে এসেচো? যাও তোমার
গুনোধর ভাইকেই ডেকেই বলো” - বলে ‘জড়োয়ার ঝুমকোতে’ মন দিলেন।
কেঁদো মিনসে,
মেয়ে যেন আমার একার
সেটা জানিনে,
তবে আমার ভূমিকা ছিল কিনা জানিনা...
স্বামী-স্ত্রীর
ঝামেলাতে আর ঢুকে লাভ নেই আমাদের।
পরেশ মাইতি
ইনস্যুরেন্সের দালাল, খাঁটি মেদনীপুরিয়ান হলে বর্তমানে একযুগ ফরাসডাঙাতেই ঘাঁটি
গেঁড়ে আছেন। সকালে বোন কুলোদারানীর ফোন পেয়েই সাইকেল হাঁকিয়ে অফিস ফেরতা পরেশ
সোজ্জা বোনের বাড়ি।
হ্যাঁ মা
পারুল, তা ইশকুলে কি কেউ কিচু বলেচে?
পারুলবালা
চুপ করে নখ খুঁটছে। আশেপাশে ভাইবোনেরা ছিটিয়ে ছরিয়ে খেলা
করছে।
কিচু তো বল
মা। মামাকে বলবিনা তো কাকে বলবি!
ব্যাকগ্রাউন্ডে
কুলোদারানীর ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্নার সাবটাইটেল।
পারুল...
আমি যাবনা
মানে যাবনা।
আহা , কেনো
সেটা তো বল
লতিকা, বাঁশরী,
শঙ্করী... – বলতে বলতেই পারুলবালা ফুপিয়ে কেঁদে উঠতেই কুলোদারানী বুকে টেনে আঁচলে
নাকের পোঁটা মুছিয়ে দিলেন। এবং দিতেই আবার শুরু করল পারুলবালা
আমার মান
সম্মান কি কিছু নেই মামা
আলবাত আছে, কোন
শুয়োরের বাচ্চা কি করেছে বল
এই কথাতেই
চিৎকার করে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল পঞ্চদশী পারুলবালা, সাথে মেয়ের কাঁদন দেখে
কুলোদারানী ও বাকি চুনো বাটখারা গুলোও “ ও বাবাগো আমার কি হবে গো” বলে গেয়ে উঠল।
আশেপাশের পড়শি বাড়ির জানালা ফাঁক হল বটে কিন্তু তারা মা-মেয়ের যুগলবন্দী চণ্ডীরূপ সম্বন্ধে
ভীষণ ভাবে ওয়াকিবহাল, তাই ওই ফাঁক টুকু দিয়েই মজা নেওয়া।
“আমি জানতাম
এমনটাই কিছু হবে, যেখানে মায়ের শাসন নেই সেখানে ভালটা হয় কি করে”- ক্লান্ত পুলিন
বিহারী অফিস থেকে ফিরে ফ্যানটা ফুল স্পিডে খুলে সিলিং এর দিকে তাকিয়েই বলে ফেল্লো
কথা কটা।
অন্য সময়
হলে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠত কুলোদারানী, এখন কান্না মোড থেকে চণ্ডী মুডে আসার ইচ্ছা
প্রকাশ করলেন না।
বল পারু, বিষয়টা
তোর মা-মামাকে বল। আমি বাতরুম থেকে শুনচি।
“সারাজীবনটা
খেয়ে, হেগে আর টিভি খবরের কাগচেই কাটিয়ে দিল মরণটা” – কেন কেন কেন! কেন বিয়ে
দিয়েছিলি দাদা এই অনামুকোর সাথে
পারুল বুঝলো
তার সাসপেন্সের চোটে সে আজও গুরুত্বহীন হয়ে যাবে, জেঁকে বসবে বাপ মায়ের রোজকার
কুকুর কেত্তন। রিস্ক না নিয়ে বলে ফেললো-
আমাকে মা
কালীর বাচ্চা বলেচে। ওদের সবার ছেলে বন্ধু আছে, আমারও মদনকে পচন্দ। কিন্তু সে
বল্লো আয়নাতে মুক দেকে আয় কামিনী ...
আরো অনেক
কথাবার্তা বেশ কয়েকদিন ধরে হয়েছিল। যার মধ্যের মোদ্দা কথাটা হল, পারুলবালাকে কোনো
ছেলে ঘাস দেওয়া তো দুরস্থান ফিরেও তাকায় না। পারুল চায় তাকে দেখেও ছেলে পিলের দল
সিটি মারুক, চোখ মারুক, আড়াল আবডাল খুঁজে কারনে অকারণে একটু ছুঁয়ে দিক যেখানে
যেখানে ছোঁয়া মানা। এ সকল কিছু হয়না বলেই তার যার পর নাই
কষ্ট। অথচ লতিকার ভরন্ত শরীর দেখে ছেলের দল গোয়ালার গাই বলে ডাকে, শাড়ি পরে স্কুলে
যাবার সময় আদুরীর খোলা পেট দেখে ‘চিতলের পেটি’ বলে ছেলেরা।
তারাই বাঁশরীর স্নিগ্ধ রূপের জন্য মা দুর্গার সাথে তুলনা করে। আর সেখানে
পারুলবালাকে ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে সবাই টেঁপি বলে ডাকে, এমনকি মেয়েরাও; তাও
প্রকাশ্যে। এই দুঃখ সে রাখে কোথায়! সে ও ‘টিজ” হতে চাই।
লাগাতার
ডিপ্রেশনের ধাক্কায় বারোক্লাস টপকে আর কলেজে যাওয়া হলনা চার বারের চেষ্টার পরেও।
ঘরে তার পরে আরো ২টে বোন ২ টো ভাই আছে। এবার বড় মেয়ের বিয়ের তোরজোর শুরু করলেন
পুলিন-পরেশ জুটি। মাস ছয়েকের মধ্যে নিরাশ হয়ে গেলেন, এবং বছর তিনেকের মধ্যে
ক্লান্ত। অষ্টম বছরের মধ্যে বাকি বোনেদের হাত হলুদ হল। পুলিন বাবু উদাসীন হলেও, বোনের
চাপে তখনও শেষ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন পরেশ।
জিতেন
রাজবংশী কোচবিহারের মানুষ, বদলির চাকরিতে হুগলীর এই প্রান্তে এসেছেন। ভুমি ও
রাজস্ব দপ্তর। পরেশ বাবু বিমা বেচতে গিয়ে ক্রমে আবিষ্কার করলেন জিতেন অবিবাহিত।
ব্যাস, লাগ ভেল্কি লাগ। মাঝে অনেক ঘটনা ঘটেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি ও ইত্যাদি। ৭ মাসের
মধ্যেই মিস টেঁপি, মিসেস রাজবংশী হয়ে গেলেন। দুপক্ষই অনেক কিছু লুকিয়েছিল। বাড়ির
ইলেকট্রিক ফল্ট বলে প্রায় অন্ধকারে পারুলকে দেখিয়েছিল পাকা দেখাতে। জিতেন
পারুলের মায়ের থেকে বছর খানেকের বড় হলেও নিজেরাই শুনতে চাইনি কন্যাপক্ষ, শোনার
আংটি আবার বাঁকা।
অভাগা
যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়। শত ভায়াগ্রাতেও এক বুন্দ জিন্দেগিকি ঝড়লনা, নায়াগ্রা
শুকানো। বিয়ের পরে না জুটোলো স্বামীসুখ না দেওর। শুধু
টাকা এলো হাতে পদবীর সাথে সাথে।
রয়ে গেল
অক্ষত কুমারিত্ব।
১৫ বছর
অতিক্রান্ত, মোনোপজ পারুলবালা ফেসবুকে এসেছেন বেশ কিছু দিন হল। নাম “আমিই সেই পারু”,
ডিপিতে শরৎচন্দ্র। প্রথমে কমেন্ট করতেন এখন টুকটাক লেখেনও বটে, যেমনটি দেখেন। হাত
আর কল্পনা নেহাত মন্দ না। কিন্তু এর পর তিনি পেয়ে গেলেন সেলফি ক্যাম –B16। প্রথমটা
নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলনা, এটা কে? এতো সুন্দরী সে? ফর্সা, কোঁকড়ানো চুল, গোলাপি
ঠোঁট, দীঘল কালো চোখ, গালে রুজ এফেক্ট, সাথে টোনড ফেস। আর কি চাই! আয়না দেখা সেই কবে ছেরে দিয়েছছিল। একটা
লেখার সাথে সেই ছবিটা ছেরে দিতেই, লেখা বিষয়বস্তু ভুলে ফেবু ভাষায় প্রশংসার ঝড়।
অসাধারন , অনবদ্য, অপূর্ব, সৌন্দ্ররযের সংজ্ঞা, মোহময়ী ব্লা ব্লা ব্লা। এভাবেই দিন
কাটছিল, তাল কাটল ফেবুদলের সাথে এপো টেপোতেও মাঝে মধ্যে যাওয়া শুরু করাতে। সামনা
সামনি দেখে গ্রুপের সুজন একবার বলেই বসল –“মাসি, ওটা কি আপনার যুবক বয়সের ছবি?” । দাঁতে
দাঁত চেপে পারুলবালা বলল- “ছোট বেলায় এক ভয়ঙ্কর এক্সিডেন্টে আমায় মুখে পাছার চামড়া
লাগানো হয়েছিল, তাতেই মুখটা এমন বেহদ্দ হয়ে গেছে। নচেৎ
আমি হেব্বি সুন্দরী”। এই পর্যন্ত ঠিকিই ছিল, মাসিটাও সহ্য
করে নিয়েছিল। কিন তু রাত্রে একটা পোষ্টে খোকন লিখল টেঁপিদি কেমন আছো ব্যাস... বাকিটা
ইতিহাস।
__________________
নির্যাসঃ
অতৃপ্ত নারী আত্মা, যাদেরকে পাড়ার নেড়িটা পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেনি কোনো দিন। মাতালের
দল মাল খেয়ে বাওয়াল বাজি করতে গিয়ে শেষে মালের নেশাই কেটে গেছে যাদের রূপেরচ্ছটায়,
সেই সকল অতৃপ্ত চিরকুমারীরা পূর্বে বৃন্দাবনে যেতেন বালকৃষ্ণের খোঁজে। একটিবার তো
কেউ তাদের কুমারিত্ব হরন করুক, এখন ফেসবুকে মীরাবাই সেজে রমন খোঁজেন।
...ক্রমশ
No comments:
Post a Comment