সকালবেলা আনন্দবাজার পড়ে রোববার দিন- বাবা যখন বাজার থেকে এক সের ভাগাড়ের মাংস কিনে আনতেন সেদিন আমাদের ঘরে একটা বড় উৎসব আমেজ ভাব চলে আসত।
মা শাড়ির আঁচলকে কোমড়ে গুজে জিরা মসলা বাটতে বসে যেতেন। আমি কাচা মাংসগুলোকে নেড়ে চেড়ে দেখতাম, এলাচের গন্ধে ঢাকা পরে যাবার আগে ফর্মালিনের সুগন্ধ নিতাম। মুখের কাছে নিয়ে গেলেই মা দিত বকুনী। বলত "কাঁচা গিলে খাসনে, পেট থেকে ভৌভৌ ডাক ছাড়বি"।
আমি চোখ ড্যাব ড্যাব করে মা কে বলতাম "ভৌ হলে বেশ হবে মা, অন্তত মিথ্যার বেসাতিতে শ্বাস নিতে হতনা"।
মা আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে সন্ত্রস্ত মুখ করে বলত "আমার পাগল ছানা একটা। নিশ্চই বড় হয়ে দেবের মত এমপি হবি"।
খানিকটা দূরে বসে মা বেটার খুনসুটি দেখে, ফেসবুকের বিপ্লব থেকে মুখ তুলে, বাবা ঠোটের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসতেন।
একসময় নুন, লঙ্কা, লেবুরস, টকদই মিশিয়ে মা ঝোল ঝোলকরা মাংস উনুন থেকে নামাতেন। ড্রয়িং খাতাতে লুপ্তপ্রায় শকুন হায়নার ছবি আঁকতে আঁকতে আমি দৌড়ে হামলে পড়তাম।
একটা চামচে এক টুকরো আমায় বাড়িয়ে দিয়ে মা বলতেন -"নে সুমন, নুন হয়েছে কিনা দেখ"। আমি প্রথম টুকরো খেয়ে দুষ্ট গাল করে বলতাম -"এক টুকরোয় কি বোঝা যায়? আরেক টুকরো দাও, খেয়ে ঝটপট বলে দিই।" মা আরেক টুকরো দিত, আমিও খেতাম। স্বাদ করে খেতাম, আর মায়ের নীলসাদা শাড়ির আঁচলে আয়েশ করে মুখ মুছতাম।
সেদিন বাবা দু পোয়া মাংস এনেছিল। এত কম এনেছে কেন জানতে চাইলে বাবা মুখ মলিন করে বলেছিল "আজকাল ভাগাড়ে সাংবাদিকেরা থাকে, আর মড়া গুলো সংবাদপত্রে ও নিউজ টিভি চ্যানেলের প্যানেলে। আদালতেও অবশ্য অনেক।মড়া থাকে। ছাগল গরু গুলো দেশের নেতা মন্ত্রী। মুরগি গুলোর অভিযোজন হচ্ছে দ্রুত। ওরাই মানুষের মত দেখতে হয়ে যাচ্ছে। কেবল খায় আর ডিমের বদলে ভোট দেয়। তাই বাজারে মাংসের আকাল বাবা। স্ল্যাটার হাউস গুলোতে এখন ভুয়ো সংবাদের কাটাছেঁড়া হয়"।
৩৪ বছরের সময়কালে শিক্ষিত তো, তাই গুণতে ও পড়তে শিখেছি বিবেক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে। মা যখন মসলা বাটায় ব্যস্ত তখন মাংস গুলো ধরতে ধরতে আনমনে গুণে দেখলাম মোট পনের টুকরো মাংস। মাংসে রক্তের বদলে চুঁইয়ে পরা আঠালো দ্বেষপ্রেম।
স্বভাবগত ভাবেই ৩ টুকরো আমার স্বাদ পরীক্ষাতে গেছে, কিজানি আজ কেমন যেন কমলালেবুর মত স্বাদ লাগল মাংসের টুকরো গুলো। নাগপুরের কমলা।
দুপুরে মা প্লেটে করে আরো ছয় টুকরো ভাত মাখিয়ে জলিস করে আমায় খাওয়ায়। আমি খেতে খেতে হিসেব রাখি আর মাত্র সাত টুকরো অবশিষ্ট আছে।
রাত্রেও আমার প্লেটে মাংস আসে, পরদিন দুপুরেও ২ পিস।
খেতে খেতে হঠাত হিসেবে গন্ডগোল বেধে যায়।হিসেব করে দেখলাম বারো টুকরো মাংস ই আমার পেটে।
বাবা খায়নি, মা ও খায়নি।
আসলে সকলের খাবার মত পরিমান মাংস কেনার দাম -রোজগার নেই আমার মধ্যবিত্ত বাবার। না সমর্থ আছে "বিশ্বাসযোগ্য" বড় রেস্তোরা বা হোটেলে আমাদের নিয়ে বা তার একার খেতে যাবার।
গরু মাতা, পোল্ট্রিতে বার্ড ফ্লু, ডিমে প্লাস্টিক, মৎস অবতার। ছাগল বা পাঁঠাতে যেহেতু দোষ ছিলনা- অতএব মাংসে পচা ভাগাড় আবিষ্কার। যে মাংস খেয়ে তামাম শহর কখনও অসুস্থ হয়নি। কারন ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস আনন্দবাজার পড়েনা এবিপি আনন্দ দেখেনা। তাই ওই মাংসে ওরা পৌছাতে পারেনি।
টাকা থাকলেই খাওয়া যায়না, কারন ABP - নাগপুরের যৌথ প্রয়াসে আম বাঙালীকে সস্তার প্রটিন থেকে বঞ্চিত করে ভাতে মারতে চাইছে।
অনেক বছর পর......
বাঙালী এখন শুধুই কোয়েল খায় বছরে একআধবার। আর গায়... ও জিও ড্যানড্যানাডণ...
হগ মার্কেট নয়, পাড়ার বাজারেই কুকুরের মাংস পাওয়া যায় সুলভেই।
আগে নাগারাই এই মাংস খেত শুধু। বিগত ২৫-৩০.বছর ধরে পিসির আর দেশপ্রেমিক ভায়েরা ক্রমাগত গণতন্ত্রকে ন্যাংটো করেছে। তাই আমরাও নাগা সন্ন্যাসীদের মতই ন্যাংটো। আজ আর কারো কুকুর খেতে লজ্জা নেই। অবশ্য যারা কৃমি তাদের লজ্জা থাকতে নেই।
লাউ বিরিয়ানি, সোয়াবিন বিরিয়ানি, সাথে ঢ্যাঁড়শের চাঁপ, বেগুনের টিকিয়া, করলার শিক কাবাব.... কাঁচকলার কোর্মা, ইঁচড়ের কালিয়া, সজনে ডাঁটার রেশমি কাবাব....
অফিসপাড়া, কিরণসঙ্কর রোড, ডেকার্স লেনে এখন হনুমান চালিসা বিক্রি হয়।
আর কি চাই??
ইলিশ, বাগদা চিংড়ি, ভেটকির মত কচি পাঁঠার মাংস আজ বাঙালী উইন্ডো শপিং করে। এবং অবশ্যই সাহিত্য লেখে-
" একদিন খেয়েছিনু কচি পাঁঠা আহা-....."
__________
(একটি নিরিহ বাংলাদেশী পেজের গল্পকে শ্লীলতাহানি ঘটিয়ে এই পরিস্থিতি করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী)
No comments:
Post a Comment