ছবিঃ ইন্টারনেট
ষষ্টীবিলাস
জামাইষষ্টীর বাজার।
সকাল থেকেই বেশ সাজো সাজো রব। বাঙালীর আপামর
হাঘরে স্বামীর দল সকাল থেকেই আজ চরম মুডে। আমাদের লেবু দা ই বা আর বাদ যাই
কেন? দর্পনারায়ন মল্লিক, নামটা শুধু রেশন কার্ড আর ভোটের ফটোতেই আছে, বাকি সবাই
ই লেবু বলেই ডাকে, এমন কি ছেলে ‘মুঙলা' ও যে লেবু দা বলে, সে কথা আগেই বলেছি। বিল্বমঙ্গল এর মত একটা সুন্দর নামটাকে যে বেমালুম চেপে গিয়ে, পার্মানেন্ট মুঙলাতে এসেই দাড়িয়েছে সেটা কারো খেয়াল ই করা হয় নি।
এই
গরমে বিভিন্ন অপিসে গদিতে জীবনবিমাপত্র বেচার ঘানি কল থেকে একদিনের অতরিক্ত পাওয়া ছুটি টা যাও বা
পাওয়া যেত, রোববার পরে সেটাও মাটি। তাতে করেও, মেঝেতে খালি গায়ে শুয়ে শুয়ে বিড়ি
টেনে, মাথার গোড়ায় টেবিল ফ্যান চালিয়ে কাটিয়ে দেবে ভেবেছিলো। কিন্তু ভোর
রাত থাকতেই বিঘ্নেশ্বরী দেবীর রুদ্র মুর্তীর কাছে মুড টা নেতানো পাঁপর হয়ে
গেল। স্ত্রী মানে তো স্বামীর কাছে মোনোরঞ্জনা, যেখানে মন আর রঞ্জন বৌদিমনির দু- দশ মাইলের মধ্যে নেই।
শুধু বাপের বাড়ির পদবি সুত্র প্রাপ্ত সিংহ টার কেশর ই উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সারা বচ্ছর
বউয়ের মুখঝামটা আর নেতিয়ে পরা জীবনে যে কটা হাতেগোনা দিন আঁশটে পিরিত উথলে
পরে, ষষ্টীর দিন তার একটা। বউ আজ সক্কাল সক্কাল চান টান করে নিয়ে সেই বিয়ের সময়
কার সেরা শাড়ী টা পরে নিয়ে গলায় পাওডার, হাতে নখপালিস, ঠোঁটে লিপস্টিক গালে স্নো-ক্রিম, স্যাম্পু করা চুল খুলে এলোকেশী সেজে, দরদর করে ঘামতে ঘামতে হাঁক
পারছেন “বলি, ও মুকপোড়া মিনসে? পাছাকাত কতে তো অনেক ঘুমুলে, এবার তো উটে
পরো, লুচি পাতে পরার আগে পৌছাতে হবে না কি?” ইত্যাদি বলতে বলতে মুঙলা কে
হিরহির করে টানিতে টানতে নিয়ে গেল, জিন্সের প্যান্ট টা পরানোর জন্য, কশার ছোট মামা বমু, মানে ব্যোমকেশ, তার একটা বাতিল চসমা সে এক কোন কালে,
লেবুদাকে গিফট করে ছিলো, ওটাই আজ মুংলার সম্পত্তি, ডান্ডাতে শুধু ছোট্ট করে দড়ি
বাঁধা।
মেয়েদের সামনে পরিক্ষা, সুতরাং তারা এ যাত্রায় বাবার সঙ্গী হতে পারলনা। লেবু দা প্রস্তুত, একটা হ্যান্ডেল ওয়ালা ব্যাগ, একটা বিগ সপার, আর
একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে। শ্বশুরের দেওয়া এক মাত্র পছন্দের জিনিস , ১২ বছরের
পুরানো ফ্যাটফ্যাটে বিকট আওয়াজ ওয়ালা ইয়াম্মা মোটর সাইকেলের কেরিয়ারে বিগ সপারটাকে কষে বাঁধলেন । আর দুটো ব্যাগ দুপাসে ঝুলিয়ে, চেপে
বসলেন, মাঝখানে মুঙলা, আর তার পিছনে সুধা বৌদি, সোয়ামি সন্তান কে সাথে করে
নিয়ে, তিন থাক চর্বিওয়ালা পেটটার প্রদর্শনী করতে করতে হুগলি জেলার গুড়াপের উদ্দেশ্যে রওনা
দিলেন।
মাঝ পথে মোটর একবারই শুধু দাঁড়ালো মিষ্টি নেবার জন্যে। লেবুদার
ইচ্ছা ছিলো বোঁদে নেবার, কিন্তু সুধা বৌদির ভয়ে রসোগোল্লাই নিলো, তবে চড়ুই
পাখীর মাথার সাইজের থেকে সামান্য বড় সেই রসগোল্লার কলেবর। তাছারা খুড়তুতো শ্যালিকা লতিকার রজনীগন্ধা সেন্ট শোঁকার জন্যও প্রতিদান
কিছু দিয়ে হয়, বেচারি জামাইবাবুর জন্য সেজেগুজে বসে থাকবে যে।
সাড়ে দশটার মধ্যেই পৌছে গেল। বাড়িতে ঢুকতেই একটা গামছা দিয়ে, টাকের ঘাম
মুছতে মুছতে... বিনোদবাবু কান পর্যন্ত এঁটো করে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসতেই,
লেবুদা শ্বশুর বাবাকে টুক করে পেন্নামটা সেরে নিলেন। ততক্ষনে পাকা ফলারের
গন্ধ নাকে চলে এসেছে। মুঙলা তো গাড়ি থেকে নেমেই বাগান পানে দে দৌড়। সুধা বৌদিও
সোজা হেঁসেল ঘরে, ওখানে বসেই একটা লুচির টেষ্ট করতে করতে মায়ের সাথে সুখ
দুঃখের গল্প শুরু করে দিলো। বীরু, গাড়ি থেকে ব্যাগ গুলো নামিয়েই সাইকেল
নিয়ে পাড়ার তেঁতুল তলায় ডিউটি দিতে গেল। শ্যালিকা লতিকাই লেবুদাকে সাথে করে নিয়ে
বসার ঘর পানে, তারপর গিয়ে সিলিং ফ্যান টা ছেরে দিলো।
আর এটাই
লেবুদার সমস্যা, এই গরমে ফুলপ্যান্ট আর জামা পড়ে থাকা যে কি কষ্টের... যাই
হোক, খানিক পরেই ‘ভালো আচো বাবা, শরীর সাসতো সব ভালো তো! সুধার শরীর টা
দিনদিন কেমন যেন খারাপ হয়ে যাচ্চে বাবা...... ইত্যাদি ইত্যাদি , বলতে বলতেই
শ্বাশুরি মায়ের প্রবেশ, বড় খঞ্চা তে খইদইয়ের প্রসাদী মন্ড, গরম লুচি,
ঘুগনি, মিষ্টান্ন... আরো কত কি। খেতে খেতে শ্বাশুরি মা অনেক কথাই বলছিলো,
খাবারের প্রতি লেবুদার এতো টাই মনঃসংযোগ ছিলো যে, ও সব আর কানেই যাইনি।
সে যাই হোক, বেশ রসিয়ে রসিয়ে টিপে টিপে প্রায় পুরো খঞ্চা টা সাবার করতে
করতে, লতিকার কথায় ঘোর কাটলো, “ও জামাই বাবু, কি আর এমন খেলেন? আর দুটো
লুচি ত নেন, কমপক্ষে ২ টো মালপো। ততক্ষনে লেবুদার কুঁচকি কন্ঠ সেম পজিসনে
এসে গিয়েছে। যাই হোক ডাবের জল টা খেতে খেতে কোন রকমে আঁচিয়ে এসেই আমতলার
টালির ঘড় টাতে এসে ফ্যান টা চালিয়ে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লো। এক তলার
সিমেন্টের পাকা ছাদ যা গরম, কাঁচা ডিম রাখলে, কিচ্ছুক্ষনের মধ্যেই হাফবয়েল
হয়ে যাচ্ছে।
এতোক্ষন টানা বাইক চালানো, তার উপরে সুধাবৌদিকে নিয়ে
টেনসান, আর এই গলা পর্যন্ত ঠেসে খাওয়ার ফলে, চোখ বুজতেই ঘুমে শুরশুরি
দিতে লাগলো। ঘুম টা একটু গাঢ হতেই, লুচি গুলো কোথা থেকে সব জীবন্ত হয়ে গেল,
আর বিভিন্ন রকমের কৈফিয়ত দাবি করতে লাগলো।
ওই ফুলো লুচি গুলো বোধহয়
মহিলাই হবে, ইনিয়ে বিনিয়ে নানা ধরনের ঝগড়া দেখে অন্তত লেবুদার তা ই মনে
হলো। লুচির আরো কাহিনি ছিলো, সে ঘটনা আরেকদিন বলবো না হয়।
প্রচন্ড একটা
ধাক্কা খেয়ে লেবুদা ধরফরিয়ে উঠে বসলো, “ মরণ, ঘাটের মড়া... যক্কোনি দেকচি,
তক্কোনি শুদু ঘুম, ঠাকুর... সেই তালে মুংলার জন্ম না হলে , আমি বোধহয়
নিঃসন্তানই থেকে যেতাম” এই কথাটা ঝড়ের বেগে পুকুর ঘাটের দিকে মিলিয়ে গেলো।
বলার বাহুল্য রাখে না যে... কথা গুলো সুধা বৌদির। আর মেয়েদের অনুপস্থিতিতে তাদের কথা বেমালুম ভুলে মেরেছে।
লেবুদা কুয়ো তলাতে গিয়ে স্নান সেরে ফিরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সোয়া তিনটে।
দুপুরের খাবারে শ্বাশুরিকুল বাদে, শ্বশুরেরা দুই ভাই, শ্যালক শ্যালিকা সহ সকলেই দাওয়ার বারান্দায় চাটাই পেতে এক সাথে
খেতে বসলো। সে নানা রকমের আয়োজন। এমনিতেই ফলাহার টা বাদ গেছে বলে শ্বাশুরি
মায়ের কষ্টের শেষ নেই। লেবুদা চিরকাল আমাশা আর গ্যাসের রোগে ভোগা
ব্যাক্তি। তবে তেলেভাজার প্রতি শুধু দুর্বলতা টা রয়ে গেছে।
নানা ধরনের
রেগুলার খাবারের সাথে, কচি পাঁঠার মাংসের কোর্মা, চিতল পেটির কালিয়া, চিংড়ীর
মালাইকারী , ইলিশের পাতুরি ছিলো অন্যতম। আর শেষ পাতে ছিলো গোটা মিষ্টান্ন
ভান্ডার। লেবুদার পেটে লুচিরা যেভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে ছিলো, এই পদ
গুলো র উপর তেমন সুবিচার করতে পারলো না। সব শেষে কোল্ডড্রিংস, যদিও গরমের
চোটে সেটা আর যাই হোক কোল্ড ছিলো না।
লেবুদার যদিও আবার শোবার
ইচ্ছাই ছিলো, কিন্তু লতিকার অনুরোধ আর সুধাবৌদির স্বলজ্জ চোখরাঙানী উপেক্ষা
করতে পারলো না। বিকালে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যেতেই হলো। লেবুদা শুধু মাত্র
একটা পান খেলো।
সন্ধ্যে বেলায় একটু দূর্গামন্ডপের আটচালায় ছোঁয়া
দিয়েই সাততাড়াতাড়ি শ্বশুরের ঘরে ফিরে এলো। মনে একটু রসের সঞ্চার হয়েছিলো।
মুংলা নিশ্চই তার দিদার কাছের শোবে। আর বিঘ্নেশ্বরীও নিশ্চই তাকে আজ অন্তত মানা করবে না।
সুতরাং আজ
মনে হয় চান্স আছে।
দুঃখের ঘটনা টা হলো যে, সুধা বৌদি তার ওজন নব্বই ছোঁয়ার পর থেকেই বড্ড ফিগার সচেতন হয়ে গেছেন। তাতে লাভের কি হয়েছে তার হিসাব
অবশ্য কেও রাখেনি, কিন্তু লেবুদার কপাল যে ফুটো হয়েছে, সেটা বলাই বাহুল্য।
সন্ধ্যে বেলা বসার ঘরে ঢুকে, IPL এর ফাইনাল দেখবে বলে টিভিটা অন
করতেই, জানালার পাশ থেকে অন্ধকার ফিসফিসিয়ে উঠল। লেবুদা বুঝল এ আওয়ার শ্বশুরের সেই জোড়া পাঁঠা, বীরু- বমুর। জামাইবাবু আমরা একটু পর আসছি,
তুমি ছাতের ঘরে গিয়ে বসো, ওখানেই ঠেক বসাবো। বলেই আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।
“তোমরা যুবক ছেলে, সারাদিন কত পরিশ্রম করো, চলো আজ একটু বসা যাক, লজ্জা
কোরো না লেবু, এই বয়সে তো আমরা বন্ধুই হলাম নাকি হে...” বললে বলতে
মূর্তীমান শ্বশুর বাবা হাজির। বিনোদবিহারি সিংহ। বললেন, ছাতের ঘর পান একটু এসো হে। ও পাড়ার পল্টু
মাস্টার আর কবি তীর্থঙ্কর বাড়ুই মহাশয় ও আসবে। ওনারাই সব সব সরঞ্জাম নিয়ে আসবেন ।
আজ লেবু দা কে সামনে রেখে
বাপ-বেটা তিনজনেই সুরাশিক্ত হবার প্ল্যান করেছে। আলাদা আলাদা করে। ওদিকে সুধা বৌদির মনেও আজ লাড্ডু ফুটেছে। বার তিন চার গভীর ভাবে নিজেকে আয়নাতে প্রদক্ষিন করে, তিনিও মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়েই ফেলেছেন,
আজ বেচারাকে একটা চান্স দেওয়াই যায়।
খানিক পরেই দুই শালা, তাদের দুই
স্যাঙাৎ সমেত সমস্ত উপাচার নিয়ে হাজির। লেবুদা ও দু-ঢোক কারণ সুধা কন্ঠস্থ
করে ধাতস্ত হতে না হতেই, সিড়িতে পায়ের শব্দ। সিংহ বাবার গায়ের গন্ধ পেয়েই বীরু, পুরো পল্টন সমেত পগার পার।
“ আরে তুমি তো জামাই, জলসা বসিয়েই ফেলেছো
দেকছি... এ হে হে হে... গেলাস টেলাস সব রেডি..., ও পল্টু আমি বলেছিলাম না,
আমার জামাই খুব করিৎকর্মা, এখোন দেকচো তো...” এর পর নানা ধরনের সাংসারিক
আলাপ-বিলাপের মাঝে, দুটো সড়ে সাতশোর বোতল উদরস্থ করে, চার জনই যথারীতি হুশ খুইয়ে তক্তা তে দেহ রেখেছেন।
রাত্রি একটু গভীর, ঘড়ির কাঁটা ১২ ছুঁই ছুঁই, মনা বৌদি প্রতীক্ষায়, এই বোধহয় লেবু এলো। হাজার হোক বাবার কাছে বসে আছে, লজ্জার মাথা খেয়ে ডাকতেও পারছেনা ...
লেবু দা ও... স্বপ্ন লোকে... আজ বোধহয় চান্স ছিলো...
সক্কাল সক্কাল উঠে ছাদ থেকে নেমেই কোনক্রমে স্নানটা সেরেই লেবুদা ইয়াম্মা নিয়ে একাই ভোকাট্টা।
আসছে বছর আবার হবে।
(আজ একটু হালকা মুডের, উচ্ছাসের দরুন সৃষ্ট ভাষা গুলো কে নিজ গুনে মার্জনা করিবেন, এক্ষেত্রেও উন্মাদীয় বানানবিধি প্রযোজ্য)
উন্মাদ হার্মাদ
২৪-০৫-২০১৬