উন্মাদীয় রবিবাসর
আমি মফ:স্বলের পাড়াগেঁয়ে ভুত । থাকি রসিক বিলের
এক পাড়ের ছোট্ট কুঁড়েতে। একটু দূরে গাঁয়ের
ইস্কুলবাড়ি, লন্ঠনের
আলো জ্বলে তাদের ঘরে। ছত্রাবাসটিও লাগোয়া, একতলা। পাসেই দোতলা শিক্ষকাবাস, একলা দোকলা, কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে চার বা পাঁচকলা পরিবারও থাকে
ওখানে। তবে আসাযাওয়া লেগে থাকে ওখানে।
সেই ছোটবেলায় জন্ম হবার দরুন বুদ্ধিটা যেটুকুই
পেকেছে, এই বড়
বয়েসে এসে। তাই সেই কালে পড়াশোনা করিনি মোটেই। তার উপর আমার গায়িত্রী মন্ত্র ছিল-
পড়াশোনা করিবি, মরিবি দু:খে
মৎস ধরিবি খাইবি সুখে।
সুতরাং এই
ইষ্টমন্ত্রই জীবনে
জাঁকিয়া বসিল। রসিক বিলের মাছ পাহারার রক্ষী আমি। এখন পচা ভাদর। মাঠের পাট বিলের চারি পাড় বরাবর পাট পচাতে দিয়েছে, উপরে কলা গাছের লাশ, বিলের
কালো পাঁক, আর ছটের
দড়ির আষ্টেপৃষ্টে সোহাগের জড়াজড়িতে।
একঘেয়ে মাছের আঁশটে গন্ধ, দুরের
আমবাগানে চ্যাংড়া ছোঁরাদের গাঁজার উৎকট গন্ধ আর ইস্কুলের ছেলেদের হিসুর রাসায়নিক
গন্ধের ভীরে, পচা
পাটের গন্ধ, জীবনে
একটু ভিন্নতা আনে প্রতি
বছর।
আর পচা পাট মানেই চটুই পাখির সাইজের ডেঁয়ো মশা।
জানিনা এগুলো মদ্দা না মেদ্দি। তবে কামরানোর আগে একটা বিনাকা গীতমালা শুনিয়ে বেশ
শুরশুরি দিয়ে তবেই প্যাঁক করে হুল ফোটায়। তবে এই বেশ ভাল আছি। কারন অকৃতদার মানুষ
আমি। এই পাণ্ডববর্জিত স্থানে তার উপর রাত্রের দিঘীর পাড়ের আমবাগানে, এই মশারাই তো আমার একমাত্র সাথী। ওরা আমায় কেটে
সুখ পায়, আমি
ওদের তারিয়ে। এভাবেই দিন কাটে মশাদের
সঙ্গে সহাবস্থানে । কখনও ওরা আমাকে একা পেয়ে রক্ত খায় রীতিমত দলবেঁধে । ব্যাপারটা
বিরক্তের পর্যায়ে পৌছলে আমিও একাই ওদের পিটিয়ে মারি ।
ওই আমারই খাওয়া রক্তের দাগ গুলো ছাড়া, আমার সারা শরীর বা জীবনে কোথাও বিন্দুমাত্র রঙ
ছিলনা। প্রেম আসেনা। যৌনতা আমার মৌনতা। যেহেতু স্বমেহনই
বেশি তাই গৌনই থাক ও বিষয়সূচি। রাত্রে মাঝে মাঝে ছিপ নৌকা
নিয়ে বের হই। বার দুয়েক টহল দিই দিঘীর চারি বেড়া। মেছো ভুত, মামদো
ভুতের উপদ্রব খুব বেশি। বেম্মোদত্যি অবিশ্যি সাত্তিক ব্রাম্ভন, মাছ
ছুঁয়ে দেখেননা। শুধু গন্ধ নেন। আমি মনের সুখে পরিক্রমা করি। গুনগুন করে এক আধটা গানের কলিও ভাঁজি। দিনে
কাক চিল পানকৌড়ি মাছরাঙা ছাড়া কারো উপদ্রব নেই, তাই দিন পাহাড়া থেকে মালিক পক্ষের ছার আছে। যেহেতু আমি দিনে ঘুমাই, তাই সারারাত টো-টো করে ঘুরে বেড়াই হেঁটে বা ছিপ নিয়ে। আগে অবিশ্যি নানান শখ ছিল, এখন সব ছিলিমে বন্দি।
এরমধ্যে আমার জীবনে রক্তের লাল ছোপ থেকে নীল-সাদা
রঙ লাগলো । হঠাৎই সামনের
শিক্ষকাবাসে নতুন কেও এলেন । একজন একলা মানুষ । আগেই বলেছি পচা ভাদর, ঘরের
জানালা খোলা থাকে তার, বোধহয়
শহর থেকে আগত। বিদ্যুতশক্তি নেই আমাদের এই গায়ে, কালিঝুলি
মাখা টিমিটিমে লণ্ঠনের মায়াবি আলোতে দেখি, তার
কাঁধের নিচ পর্যন্ত ঝুলে থাকা খোলা চুল। কখনো কখনো সরু সরু বিনুনিও বাঁধা থাকে।
বোধহয় অবিবাহিত, হাতে
একটাই চুড়ি, বেশ
মোটা।
হুম, আমিও রোজ সন্ধ্যায় ওই অপরিচিতার ছায়ার মায়ায় পড়ে
গেলাম। আমার ঘরে একটা কেরোসিনের কুপি ছিল বটে, কিন্তু
কখনই জ্বালানো হতনা, কারন তার দরকার ছিলনা। ব্যাটারি টর্চেই কাজ মিটত। থাকার
মধ্যে মুখের বিড়ি, সুতরাং
তাহাতে ওই উনার, দৃষ্টি
আকর্ষনের কোন সুযোগ ছিলনা।
ক্রমে ভাললাগা অত:পর ভালবাসা। হুম গো একতরফাই।
ফি সন্ধ্যায় নিপুনতার সাথে পরিপাটী করে চুলের
পরিচর্যা করেন তিনি, পোষাকও পরিবর্তন করেন বোধহয়। উন্নত বক্ষদেশ, সুতনুকা কটিদেশ, লন্ঠনের মায়াবী আলোতে নেশা
ধরিয়ে দিল। এর পরেরটা আমার জন্য বড় বেদনাদায়ক। উপুড় হয়ে শুয়ে হাতের ভরে
শরীরটাকে কেমন উপর নিচে করতে থাকেন আধা ঘন্টা প্রায়। ব্যাপারটাতে প্রেম না থাকলে
কৌতুহল মেটাতে জানালার ফাঁকে উঁকি দিতাম নিশ্চই, কিন্তু ভালবাসাকে ফাঁকি দিতে নারাজ আমি ঝুঁকি নিতে পারলাম না।
বরং সেই কষ্টে ঠোঁটে উঠল মোহন বাঁশি। খুঁজেখাঁজে ছিপের ধরাটির তল থেকে বেড় করেছি।
রোজ বাজাই, কোন সুর
জানিনা, তবে মনে
বিষাদ থাকে, তাই ওটা
বিষাদসিন্ধুই হবে।
এর পর
তিনি গৃহকর্ম সারেন একেএকে ,
আমি বাঁশি বাজাতেই থাকি। ঘরের আলো নিবুনিবু হয়ে আসে, এরপর কেন জানিনা চঞ্চল পায়ে পদসঞ্চালনা করেন রোজ। কল্পনার কোন সীমা থাকেনা শুনেছি। আমার কল্পনাও তেমনি ডানা
মেলে উড়ে চলল উর্ধ্বপানে। জ্যোৎস্না রাতের মায়াবী চাঁদও কম্পিত হয় লাজে আজকাল,
মোহন বাঁশীর উদাসী সুরে, সেও লাজে মেঘের ঘোমটা টেনে নেয়। শুকতারা মিটিমিটি চায়
আমার ঘুমঘুম চোখের দিকে, চমকিয়া উঠি, হৃদয়ে তোলপাড়, শিহরিত হই মুহুর্মুহ। নবীন
যৌবনের উন্মত্ত ঝঙ্কার বাঁশির সুরে ধৈর্যের প্রতিক হয়ে লুটোপুটি খায় বিলের জলে।
অনবিল আনন্দের দিনগুলি শৃষ্টি সুখের উল্লাসে বাজিয়ে চলে সুরের মুর্চ্ছনা, অনন্ত
ধৈর্যের প্রতিক হিসাবে।
কোন এক বিখ্যাত জনের বানী শুনেছিলাম, কোন জ্ঞানগম্যিওয়ালা
মানুষের কাছে, সেটা এ রকমঃ-
“ক্ষুধা ও সৌন্দর্যবোধের
মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে-সব দেশে অধিকাংশ মানুষ অনাহারী, সেখানে মাংসল হওয়া রূপসীর
লক্ষণ; যে-সব দেশে প্রচুর খাদ্য আছে, সেখানে মেদহীন হওয়া রূপসীর লক্ষণ”।
তাই ওই অপরিচিত
সান্ধ্যকালীন আবছায়াটা ঈষৎ চর্বিযুক্ত হলেও, আমার পিরিতসুখ অনাহারী দৈন্য
দশাবস্থাতে, শুধু মাত্র মশার সাথে সহবাস করে করে, এই মাংসল ছায়াচিত্রও যথেষ্ট আমার
মনজগৎ কে যথেষ্ট প্রেমাশিক্ত করত। এমনিই চলছিল বিগত সপ্তাহ দুয়েক।
আজ রোববার, ছুটির দিন।
বাবুরা বাজার করতে নিজেরা বাজারে আসেন। সকালে বিলে জাল ফেলেছিল আমার মালিকের জেলের
দল। সেই মাছ বাজারে নিয়ে যাওয়া হল, কাজকর্ম নেই তাই আমিও গেলাম সাথে। শিক্ষকাবাসের
অবিবাহিত শিক্ষক শিক্ষিকার দল সাধারনত বাড়ি ফিরে যায় ছুটির দিনে। আজ দেখলাম একজন
জাননি বোধহয়। তিনি এসেছেন বিলের তাজা সরপুঁটি কিনতে। নতুন মানুষ , আগে দেখিনি।
আমার মালিক বরেন বাবু, ইস্কুলের সেক্রেটারিও বটে। নানান কথাবার্তার ফাঁকে আমার
উদ্দেশ্যে তিনিই বললেন, হ্যাঁরে হারু, ইনাকে চিনিস!
-
আমি মাথা নাড়লাম। না
চিনিনা।
-
আরে ইনি আমাদের ইস্কুলের
নতুন শরীরশিক্ষার মাষ্টার মশাই। এই তো সপ্তাহ দুয়েকই এসেছেন। কোলকেতা থেকে, খুব
ভাল মানুষ।
আমি খেয়াল করলাম, কি
শক্তপোক্ত চেহারা, বুকের দিকটা চওড়া, কোমর সরু, পাক্কা পালোয়ান মার্কা। গালে হালকা
দু-তিন দিনের না কাটা দাড়ি, পুরু ঝাঁটার মত গোঁফ। আর দেখলাম প্রসারিত রোমশ হাতে একটা
পাঞ্জাবী স্টাইলের স্টিলের বালা, আর দুই বাহুজুড়ে কত কি সব ভয়ঙ্কর উল্কি আঁকা।
দেখাই কেমন সম্ভ্রম জাগে মনে।
-
তুমিই সন্ধ্যাবেলা বাঁশি
বাজাও না?
-
আজ্ঞে হ্যাঁ, বাজাই তো।
-
কি নাম আপনার?
-
আজ্ঞে মশা, ইয়ে মানে হারাধন
সাপুই।
-
আমি আপনার ওই মাচা ঘরের
সামনা সামনিই থাকি, বেড়ে বাজান কিন্তু। খুব ভাল লাগে, আমি ডন বৈঠক দেওয়া থেকে,
খেয়ে দেয়ে পায়চারি করার সময় অবধি সময় রোজ শুনি। খুব খুব সুন্দর।
বলতে বলতে, একটা সৌজন্য হেঁসে উনি আমার মালিকের সাথেই বাজার থেকে চলে গেলেন।
আর আমি খেয়াল করলাম, ওই
পালোয়ানের মাথায় বেশ লম্বা চুল, ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত ঝুলেছে। তাতে আবার ছোট ছোট
বিনুনি বাঁধা।
বাকিটা আর নিজেকেও কখনো
শুধাইনি। কারন আমার ভালবাসাতে কোন খাদ ছিলনা।
বিঃ দ্রঃ- উন্মাদীয়
বানানবিধি অনুসৃত
উন্মাদ হার্মাদ
১০/০৫/২০১৫
No comments:
Post a Comment