সময়ের ভালোবাসা
***************
প্রতি রাতেই অত্যাচারের মাত্রাটা বাড়ছিল, একটু একটু করে। রাতে নেশা
করে এসে শিপ্রা কে ধরে অত্যাচার করাটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে হীরক। মাঝরাত না
হলে ঘরে ফেরার নাম নেই, ঘুম চোখে দরজা খুলতে সামান্য দেরি
হলেই আর রক্ষে নেই। ফেরার পরেও সেই ল্যাপটপ বা মোবাইলের পিছনে। বাড়িতে শিপ্রার
উপস্থিতিটাকে সে যেন মানতেই চাইনা। কোন রকম ছুতোনাতাতে একটা সামান্যতম খুঁত পেলেই,
চালু বাক্যবাণ এবং পরিশেষে শারীরিক অত্যাচার। তবুও শিপ্রা চুপ করে
শুধু সহ্য করে যায়। আজপর্যন্ত কাওকে স্বামীর বিরুদ্ধে নুন্যতম কোনো অভিযোগ টুকু
করেনি, বরং প্রতিবেশিরা হীরকের নামে কিছু বললে শিপ্রা তাদের
এড়িয়ে চলে, ঝগড়া করেনা, কারন ওটা ওর
চরিত্রে নেই।
অন্য যে কেউ হলে এই পরিস্থিতিতে স্বামীর ভাত
খাওয়াতো দূরঅস্ত, উপরন্তু
স্বামীকেই জেলের ভাত খাওয়াতো। কিন্তু ওর নাম যে শিপ্রা, হীরকের
সামান্যটুকু কষ্ট হবে ওর জন্য, এমন কাজ সে করতেই পারবেনা ,
কারণ সে হীরককে ভালবাসে নিজের থেকেও বেশি। চার বছরের প্রেমের পর এই
বিয়ে, তাদের দুজনের ভালবাসার পরিণতি। আর সেই ভালবাসার নিশানা
স্বরূপ ওরা পৃথীবিতে এনেছে জয়ন্তকে, ওদের একমাত্র সন্তান,
ক্লাস ফাইভে উঠেছে এবছর। রোজকার এই অশান্তি ছোট্ট জয়ন্তের মনে গভীর
ক্ষতের সৃষ্টি করলেও, সন্তানের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে
হীরকের শোধরানোর কোন লক্ষনই নেই।
গার্লস স্কুলের কৃতী ছাত্রী শিপ্রা আদক, চারদেওয়ালের কড়া শাষন আর
অভিভাবকদের ঘেরাটোপে থাকা হৃদয়ের আসনে কাওকেই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এযাবৎ। গুটি
পোকা পাখা মেললো কলেজে ভর্তি হয়ে, ক্লাসেরই সবচেয়ে বিচ্ছু
ছেলেটির প্রেমে পরে গেল সে। হীরক মিত্র, সে বিজ্ঞান বিভাগের
ছাত্র, শিপ্রা ইতিহাস অনার্স, কিন্তু
কম্পালসারি বাংলা আর ইংরাজি ক্লাস দুটো একসাথে হতো। প্রেম জমার জন্য অবশ্য সেটুকুই
যথেষ্ট ছিল, কিম্বা হয়তো নিয়তির বিধান। হীরক কলেজের অন্যতম
হ্যান্ডসাম ছেলে, মেয়েরা ওর সাথে ঢলাঢলি করত, মুখে না বললেও শিপ্রা অন্তরে এগুলো দেখে খুব কষ্ট পেত। সে জানতনা হীরক যাই
করুকনা, সেও এই শান্তশিষ্ট সুন্দরীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
এভাবেই একটি বছরের মধ্যে একে অন্যকে চোখে হারাতো। শিপ্রা আজ ভাবে, সেই দিনের হীরক আর আজকের হীরকের মধ্যে যেত কত লক্ষ আলোকবর্ষের ফারাক,
মেলাতেই পারেনা মানুষটাকে। তবুও শিপ্রা জানে আর মানে সে এই
মানুষটাকেই ভালবেসেছি, আজও বাসে, আগামিতেও
তাকেই ভালবেসে যাবে।
মারাকাটারি সুন্দরী বলে যে ব্যাপারটা আছে
সেটা শিপ্রার মাঝে কখনই ছিলনা। গমরঙা মেদহীন শরীরে একটা সপ্রতিভ মুখ, উজ্জ্বল দুটো চোখ, টিকালো না হলেও নাকটা খুব কিউট, পাতলা গোলাপি ঠোঁট,
হাসলে দাঁতের মাড়ি দেখা যায়, অপূর্ব সেই হাসি।
চোখের ভ্রু দুটো একে অন্যের সাথে মিশেছে কপালের মধ্যস্থলে, আর
মন্ডপের প্রতিমার মত একমাথা কালো কোঁচকানো চুল। যেকোন পোষাকেই শিপ্রাকে এতো মানায়
যে ছেলেরা ওর ওই ক্যারি করার ক্ষমতাতেই প্রেমে পরে যায়। খুব কম কথা বলাটা ওর
চারিত্রিক গুন। হীরকও সম্ভবত এই আকর্ষনেই শিপ্রার কাছাকাছি এসেছিল। সেই সময়ে হীরকই
ছিল একমাত্র বক্তা আর শিপ্রা শ্রোতা।
এই প্রেমের কথা বাড়িতে বলার হিম্মত শিপ্রার
কখনই ছিলনা। অথচ গ্রাজুয়েসনের ফাইনাল ইয়ার শেষ হওয়া ইস্তক যেই না ওর বিয়ের জন্য
বাড়ি থেকে সম্বন্ধ খুজতে শুরু করল,
এই মুখচোরা মেয়েটাই ভিতরে ভিতরে না বলতে পারার যন্ত্রনাতে পুড়তে
লাগলো। আর সেই আগুন থেকেই শক্তি অর্জন করে ফেললো। কিন্তু সবার আগে জানা দরকার হীরক
কতটা প্রস্তুত!
- হীরক , আমার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্যে সম্বন্ধ দেখছে। এক জায়গায় প্রায় ঠিক হব হব,
পাত্র কোনো একটা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। কি করি বলোতো? তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কারোর হবনা, এটা আমার পন,
এখন আমি কি করব হীরক!! আমাকে উপাই বলো, তোমাকে
বাদ দিয়ে আমি থাকতে পারব না...
- অনেক বড় সিদ্ধান্ত নেবার সময়
এটা শিপ্রা। তুমি আমাকে কতটুকু ভালবাসো? কতটা কি করতে পারবে
তোমার হীরকের জন্য!!
- কেন! কোন অবিশ্বাস আছে কি?
তাকাও আমার চোখের দিকে, মুখে কি না বললেই নয়?
তুমি কি জানো না যে, তোমার শিপ্রা তোমাকে তার
নিজের জীবনের থেকে বেশ চায়। তুমি একবার বলো, আমি সব ... সব
কিছু করতে পারি তোমার জন্য, শুধু বলো কি করতে হবে। তোমাকে
আপন করে রাখার জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি, সব কিছু।
- তাহলে আমার সাথে এই
মুহুর্তেই চলে চলো, পালিয়ে যায়। নাহলে বেকার একটা কলেজ
ছাত্রের সাথে তোমার পরিবার বিয়ে দেবে কেন বলো!
- পালিয়ে বিয়ে?
- সেটা ছাড়া কোনো উপায় আছে
কি? থাকলে সেটা বলো, আমিও তোমার জন্য
সেটা করতে প্রস্তুত...
তারপর আর ভাবাভাবির অবকাশ ছিলনা, সেই রাত্রেই সংসারের সকল
সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করে, শিপ্রা হীরকের হাতে ভরষার হাত রেখে
নতুন জীবনে খোঁজে পাড়ি লাগায়।
কয়েক বছর চরম আর্থিক টানাটানির পর হীরক একটা
সরকারি চাকরিও জুটিয়েছে, শিপ্রাও
একটি নামি ইংরাজি স্কুলের দিদিমনি, আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট
মজবুতই। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চলছিল, দুশ্চিন্তার কোন
বলিরেখাটুকুও ছিলনা। ঠিক তিন বছরের মাথায় মা হবার খবরটি, শিপ্রা
হীরককে দিতেই সে আন্দন্দে পাগল হয়ে গেল। কত স্বপ্ন দেখা ওই ভবিষ্যতের অতিথিকে
ঘিরে। এরপর একদিন শিপ্রার এই খবর তার মায়ের কাছে পৌছালে মান অভিমান রাগ প্রদর্শনের
পর্ব মিটিয়ে, সেই ক্রিটিক্যাল মুহুর্তে তাঁরা শিপ্রাকে বাড়ি
নিয়ে গেল। যদিও হিরকের পরিবার বিয়েটা মেনে নেয়নি। তারপর থেকে হীরক যেন কেমন একটু
একটু করে বদলে যেতে লাগলো, শিপ্রার অজান্তেই।
সন্তান জন্মের সেই সুখমুহুর্তেও হীরক যেন
কেমন উদাসীন। সারাক্ষণ যেন কিছু একটা ভেবেই চলেছে, সদাহাস্য হীরক যেন রাগের সমার্থক হয়ে যাচ্ছে, এটা শিপ্রার চোখে এড়ায় না। জগতের নিয়মেই শিপ্রা ছোট বাচ্চার যত্ন নেওয়াতে
ব্যাস্ত থাকতো, হীরক কখনও সেই সুখানুভূতির অংশীদারি হতে
পারেনি। শিপ্রা বুঝে উঠেনা, তার ভুলটা ঠিক কোথায়! সে সংসার
স্বামী পুত্রকে আরো বেশি সময় দেওয়ার জন্য ওই সুন্দর চাকুরিটাও স্বেচ্ছায় জলাঞ্জলি
দিয়ে দিল।
শিপ্রা স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে
অনেক বার বিফল আত্নহত্যার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু নিঃপাপ শিশুটির মুখের দিকে
তাকিয়ে আর এগোতে পারেনি সে। ছেলে নিয়ে যে নিজের বাবার বাড়িতে যাবে সেই উপায়ও
নেই, কারন সে সকলের মতকে অগ্রাহ্য
করেই হীরককে বেছেছিল। আজ সেই সুখের কুঠিতে শনির দৃষ্টি পরেছে। তাছারা হীরককে সে
কার কাছে রেখে যাবে!
শিপ্রা ভাবে, প্রেমেরও কি কোন এক্সপেয়ারি ডেট হয়? শিপ্রার
বাবা-মা এর সাথে নতুন করে আসাযাওয়াই কি হিরকের এই রাগের কারন! সে কি শিপ্রার সাথে
এই পারিবারিক মিলনকে মেনে নিতে পারছেনা! হীরক কি কোন অন্য মেয়ের প্রেমে পরেছে!
শিপ্রা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যদি হীরকের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটে থাকে
সেটা মেনে নেওয়ার জন্য সে সম্পূর্ন তৈরি। সেভাবেই নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে। কারন সে
হীরকের স্বত্তার সাথে প্রেম করে, হীরকের ভালটাকে সে এতোদিন
মেনে নিতে পারলে আজ যখন কিছুট খারাপ হচ্ছে সেটা কেন সে মেনে নেবেনা? সে তো হীরকের সুখ চায়, হীরকের শান্তি চায়। এই উন্মাদ
হীরককে কি সে চেয়েছিল? কোন পিতা কি সন্তান কে নিজের
প্রতিদ্বন্দী ভাবতে পারে? যে তার জন্যই আজ শিপ্রা হীরকের
জীবন থেকে দূরে সরে গেছে। না না শিপ্রা এ কথা আর বেশি দূর ভাবতে পারেনা, এক তীব্র পাপবোধ তাকে পিষে দেয়, সন্তানটা ওদের
দুজনের। সে মা হলে হীরক পিতা, নিশ্চই সেও ততটাই মমত্ব দিয়ে
অপত্যকে স্নেহ করে ভালবাসে যতটা শিপ্রা।
সে এই হীরকের জন্যই পৃথিবীর সকলকে অস্বিকার
করেছিল, হীরকও তাই। কিন্তু আজ শিপ্রা
অসহায়, সব মেনে নিতে রাজি, পুনরায় মা
বাবার সাথে সম্পর্ক চ্ছেদ করতে রাজি, এমনকি হীরকের জীবনে চলে
আসা দ্বিতীয়- তৃতীয় চতুর্থ সব নারীকেও নির্ধ্বিধায় মেনে নিতে রাজি, শুধু সে নিরুপায় জয়ন্তের ক্ষেত্রে। তাকে সে ছারতে পারবে না। কোন শর্তেই সে
জয়ন্তকে কাছছারা করতে পারবেনা। এর পরেই মনে আসে ওর নিজের বাবা মায়ের কথা, সেও তো তাদের সন্তান, তাহলে তাদের অগ্রাহ্য করে
এতদিন থাকাটা তাদেরকেও ঠিক ততটাই কষ্ট দিয়েছে, যতটা সে
জয়ন্তকে ছারতে হবে ভাবতেই যন্ত্রনা পায়। কিন্তু সে হীরককেও ছারতে পারবেন।
এ এক অদ্ভুত টানাপোরেন, শিপ্রা কোনো মুক্তির সন্ধান
খুঁজে পায়না সামনে। তার প্রেম মোটেই কমেনি, বরং বেড়েছে। আগে
সে শুধুই হীরককে চাইত, আজ হীরকের সন্তানকে ভালবাসে, হীরকের যদি অন্যকোন প্রেম থাকে , মনেমনে তাকেও নিজের
মনে করতে শুরু করেছে, এমনকি হীরকের এই অত্যাচারকেও বড়
ভালবেসে ভেলেছে।
এটা আমাদের সমাজের অনেক মেয়ের জীবনের ঘটনা, যাদের নাম শিপ্রা না হয়ে হয়ত
মালা, লীলা, রেখা বা শ্রেয়সী। হীরকের
দল বোঝেনা, হিরকদের শিপ্রারা বড্ড ভালবাসে, যেটা তাদের ধারনারও বাইরে নিজের থেকেও বেশি।
শিপ্রাদের জন্য থাকে অনন্ত অপেক্ষা, আর চোখের জল, একরাশ হারিয়ে ফেলার ভয়ের আতঙ্কে ভালথাকার অভিনয়, সম্বল
বলতে একটা দুমরে মুচরে যাওয়া প্রেমে পরিপূর্ন একটা হৃদয়। অমুল্য হৃদয়।
উন্মাদ হার্মাদ