চলতে চলতে
পঞ্চম পর্ব-১
..................
"স্যারজি, ই তো হামারা হোটেল নাই হেই, ঘর আছে। থোরা এডজাষ্ট কিজিয়ে, আপ মেহমান হ্যায়
হামারা, কাষ্টমার নেহি"
খানিকক্ষন
আগে মনোসভাই যখন ডিনার সার্ভ করতে করতে কথাগুলো বলছিল, তখন
একবারের জন্যও মনে হয়নি এই মানুশটি আমার আত্মীয় নন। অদুরেই রান্নাঘরে ওনার স্ত্রী
দাঁড়িয়ে, স্টাটারের সাবুর বড় পাঁপড়ে কামর দিয়ে চোখাচোখি হতেই
দেখি, তাঁরও নির্বাক চোখে সেই একই কথার জোরালো প্রতিধ্বনি।
এই
প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড় সুলভ কঠিন পেটানো চেহারা ও মুখমন্ডলে যতটা সম্ভব
হাসি আর উজ্জ্বল্য আনা যায়, তার চেয়েও একটু বেশি এনে, সত্যিই
এনারা যেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কুটুম্ব সদৃশ্য খাতিরতোয়াজ করছেন। বসুধৈব কুটুম্বকমের
সাক্ষাৎ বিজ্ঞাপন, এটাই ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া, আমার স্বদেশ আমার বাংলা।
গতকাল
যখন শিয়ালদা থেকে ট্রেনটা দুপুরে ছাড়ল, গনগনে জৈষ্ঠ্যের বেলা তখন
গামছা নিচরানোর মত গতর থেকে ঘাম বের করে চলেছে। চালু টিকিটে ট্রেনে উঠে ভ্রমণ এ
আমাদের ভবঘুরে বন্ধু কজনের অনেক দিনের রোগ। যথারীতি টিটিকে ম্যানেজ করা গেল।
খাগড়াতে এসে স্থায়ী একটা সিট পাওয়ার আগে পর্যন্ত বেদের দলের মত কাঁধে রুকস্যাক আর
হাতের ঝোলা ব্যাগ নিয়ে আর্ধেক ট্রেন চষে ফেললাম। পিঠের ব্যাগে সেই চিরাচরিতভাবে
নির্দিষ্ট কিছু জরুরী জিনিস। আর হাতের ঝোলাতে মায়ের গুছিয়ে দেওয়া ভাতের টিফিন,
তরকারির কৌটো আর জলের জার। কে ওনাকে বোঝাবে যে আজকাল অনলাইনে রাস্তা
জুড়েই খাবার পাওয়া যায়, আর জল? অন্তত
শখানেক হকার বোধহয় 'ঠাণ্ডাপানি" বিক্রি করে চলেছে।
সিটটা
জুটলো ৭১ নং এ বাথরুমের এক্কেবারে কাছেই। বসেই যেতে হবে গোটা রাস্তাটা, আরেকজনের
সাথে। তিনি মাঝবয়সী কোচবিহারী মহিলা, সাথে একটি কিশোর ছেলে ও
স্বামী। উল্টোদিকে ৬ টা সিট গোটাটাই আলিপুরদুয়ারের একটা পরিবারের দখলে, সাথে একটা কচি বাচ্চা। ব্যাগপত্তর সিটের নিচে চালান দিয়ে টিশার্ট টা খুলে
বসেবসে যেই গা টা এলিয়ে দিয়েছি, ওমনি নিদ্রাদেবী ঢুলুনির
প্রোমো চালিয়ে দিয়েছে।
কতক্ষন
পর জানিনা,
বাঁজখাই গলায় 'উঠুনতো মশাই' আওয়াজ সহ কাঁধে একটা মৃদু ধাক্কা অনুভুত হতেই, মেজাজটা
চিড়বিড়িয়ে গেল। কাঁচা ঘুম ভাঙলে যা হয় আর কি। শকুনিমামা স্টাইলে একটা চোখ খুলেই
মুখ ফসকে যথারীতি খাঁটি বাংলা উবাচ নির্গত হল- ধুর ওয়ারা, খোঁচাচ্চেন
কেনে!!
-কি, আমাকে খিস্তি? টিটি কোথায়
টিটি, টিটি.... পুলিশ...
- কি কেলো, আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম, কি কেলো হল?
ব্যাগ গুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলাম, ওরা
এই ঝামেলার আঁচ পাইনি, শান্তিতেই ঘুমাচ্ছে।
- আপনি জানেন আমি কে? অভদ্র চুয়ার....
এবারে একটু হাসিই পেয়ে গেল, বললাম-
- আপনার পরিচয় পেয়ে পেয়ে ভালই লাগল। তা বলুন কি সাহায্য করতে পারি!
- ওঠ আমার সিট থেকে, আমাকে কিনা খিস্তি! উঠ
আমার সিট থেকে
পাশ
থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, আহা মাস্টারমশাই অপেক্ষা
করুন, এই জাতের লোকজনে আজকাল দেশ ছেয়ে গেছে, আমি রেলের হেল্পলাইনে কল করে দিয়েছি, পুলিশ এলো বলে।
উল্টোদিক থেকে একজন মহিলা বলে উঠলেন ক্ষ্যাপা পাগল নয়ত আবার! কেজানে বাবা
ভদ্রলোকের মতই কাপড় জামা... আরো বহুকিছু বলছিলেন।
মজাটা হল এর পর, আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে আবার
চক্ষু মুদিতেই, ওদের আক্রোশ ফেটে পড়ল। পুরুষটি পুলিশ খুঁজতে
গেছে, মহিলাগুলো রীতিমত উচ্চশ্রবে চেঁচিয়ে আমার চোদ্দগুষ্ঠি
উদ্ধার করার দরুন কম্পার্টমেন্ট মাথায় তুলে বকি যাত্রিদের বিনোদন যোগাচ্ছেন। আমিও
আজন্ম বেয়াড়া ত্যাঁদড়, শিব সেজে জানালাপানে মুখ করে বসে আছি,
কারণ টিটি বাবাজী স্বয়ং নিয়মমাফিক চালান কেটে আমার সিট কনফার্ম করে
এখানে বসিয়েছেন। তাই সে ব্যাটা না আসা পর্যন্ত এই বান্দর বন্দর ছেড়ে নড়ছেনা।
গাড়ি
নিউ ফারাক্কা স্টেশনে পৌছাতেই কিছু হকার উঠল, এক ঝালমুড়ি ওয়ালার থেকে
আমতেল মিশ্রিত ঝালমুড়ি আমেজ নিয়ে খাওয়া দেখে ওই ঝিমিয়ে যাওয়া মহিলারা আবার নতুন
উদ্যোমে সিরিয়াল শুরু করেদিলেন। ট্রেন এতক্ষণ পর্যন্ত ঠিকঠাকই চলছিল, এখানে প্রায় টানা ২৮ মিনিট পর হুইসেল দিয়ে চাকা গড়াতেই দেখি সেই ভদ্রলোক
গোটা দুই RPF আর খান তিনেক TTE নিয়ে
হাজির আমাকে সবক শেখাতে। তারপরে সব কিছু চেকচাক করে কিছু না বলেই এক RPF বাবু আচমকা সেই "আমি কে জানিস" ভদ্রলোকের গালে সটান চড়।
ফারাক্কা ব্রিজের ঝনঝনা আওয়াজকে ছাপিয়ে পুরো ইয়র্করের মত সকলের কানের পাতায় ধাক্কা
খেয়ে বগিময় প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই সুমিষ্ট আওয়াজ।
যেটা
জানলাম,
ওই ভদ্রলোকেরও ৭১ নং সিট, কিন্তু S5, আর এটা S4। আর যেটা
বুঝলাম যে,
হামবড়া ব্যাক্তিটি নির্ঘাত এতো পরিমাণ হম্বিতম্বি করে এনাদেরকে
এনেছিল, সেটারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এই ঊনআশি শিক্কার চড়।
মহিলাগুলো হঠাৎ করেই যেন লজ্জাবতী লতার মত কেমন নেতিয়ে গিয়ে সঙ্গী বীর পুরুষটির
প্রতি কটাক্ষপাত করতে লাগলেন। যথারীতি রাত নটার কাঁটা পার হতেই ট্রেন মালদা টাউনে
ঢুকলো। অতএব খাওয়াদাওয়া শুরু, ৫-৭ মিনিটেই আমার পর্ব শেষ হয়ে
গেল। এদিকে সামনের সেই বৃহদ পরিবারে আরো বেশ কিছু সদস্য জুটেছে খাবার সময়ে,
যারা হয়ত এদিকওদিক ছিটিয়েছড়িয়ে বসেছিল।
মজাটা
আরো দীর্ঘায়িত হল এবারে; মালদা স্টেশন এক্কেবারে হকার শুন্য। বন্ধু Debesh
নিশ্চই আসল কারনটা বলতে পারবে। অতএব জলওয়ালারা ট্রেন থেকে হাপিস।
এদিকে ওই পরিবারের সঞ্চিত জল শেষ। সেই মাঝবয়েসী ভদ্রমহিলা আমাকে অমন একটা পঞ্চাশের
দশক মার্কা বেঢপ জারে করে জল বইতে দেখে বেশ মুখ টিপে হেসেছিলেন, তার মাথাতেই এলো কথাটা।
- বলছিলাম কি দাদাভাই, জল আছে?
জল বলে জল! সেই অবাক জলপানের মত, চোখের জল
নাকের জল, ঘামের জল, ট্রেনের ট্যাঙ্কির
জল... কত জল চাই! নাহ এ কথাগুলো শুধু ভেবেছি, ওনাদের বলিনি।
যেটা বললাম সেটা হল-
- কেন থাকবেনা জল!! আছে তো। বলেই আমিও জারটা ব্যাগ থেকে বেড় করে
দিলাম। এমনিতেই NJP তে ফেলেই দিলাম, যাক
সৎকারে লেগে গেল।
- জলে কি সুগন্ধী দেওয়া আছে দাদা?
আমি
শুনেও অগ্রাহ্য করলাম কথাটা, কারন জানি ওটা আমার মায়ের কীর্তি। উনি
যে, ১০০ লেবুর শক্তি সম্পন্ন ভিম লিকুইড দিয়ে জারটি পরিষ্কার
করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যথারীতি প্রায় নিরুপদ্রবেই
বাকি পথটা অতিক্রম করে, ভোর শোয়া তিনটের সময় নিউ জলপাইগুড়ি
স্টেশনে নেমে এক কাপ চা-পান করে ঘুম তারালাম।
মনের
সুখে একটা মান্নাদের গান গুনগুন করতে করতে দীর্ঘ ফুট ওভারব্রিজ বেয়ে বাইরে ট্যক্সি
স্ট্যান্ডে এসেই বাজটা পড়ল। একটা গাড়িও পাহাড়ে যাবেনা, গুরুঙ
এর নাকি পুরকি আবার চেগেছে। স্বয়ং বড়লাট (স্ত্রীলিঙ্গে পড়ুন) পাহাড়ে অধিষ্ঠান
করছেন ভাইগুলোকে (কি জানি কিসের ভাই!!) নিয়ে, অতএব একটা
হেব্বি থ্রিলিং। অধিকাংশ পর্যটকের দল ডুয়ার্স, গ্যাঙটক,
নেপাল ভুটানের দিকে রওনা দেবে বলে সেই মাঝরাত্রে ডিসিসন নিয়ে অনলাইনে
হোটেল খুঁজে বেড়াচ্ছে।
অনেক
উঁচু থেকে ঠিকরে পরা সাদা আলোতে ধুয়ে দেওয়া হেরিটেজ রেল ইঞ্জিনের কাছে বসে খান
দুয়েক সিগারেটের মুখাগ্নি করে ভাবতে লাগলাম-
যাব্বো
কি যাবো না!!!
........ক্রমশ
No comments:
Post a Comment