Monday, 11 February 2019

।। ভালবাসাঃ নিঃশর্ত, হৃদয় এবং মস্তিষ্ক ।।


ভ্যালেন্টাইন ডে'র আগে কিছু উন্মাদীয় প্রেমালাপ
°°°°°°°°°°°°°°′°°°°°°°°°



কাব্যে হৃদয় বললেও, আসলে ভালবাসার সবটাই নিয়ন্ত্রণ হয় আমাদের মস্তিষ্ক থেকে। আমাদের পছন্দ অপছন্দ সবটারই একসেট করে ডেটা স্টোরেজ আছে আমাদের grey cell data sheet এ। যেটার অধিকাংশ মিলে যায় সেটা পছন্দ হয়, পছন্দ ভাললাগাতে পরিনত হয়। ভাললাগার নিত্য অনুশীলন আমাদের সেই গুচ্ছ অনুভুতিকে- ভালবাসাতে convert করে নিতে বাধ্য করে। আর এ জন্যই কবিরা বলেন- হৃদয়ের উপরে নিয়ন্ত্রণ চলেনা। বিষয়টা আসলে নিত্য অভ্যাস আমাদের অভিযোজিত করে তোলে পরিস্থিতির জন্য, যা আজকের সময়কে কালকে দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে। এভাবেই আমরা অনুশীলন দ্বারা পরিচালিত হয়ে - হৃদয় নামক নিরীহ একটা অঙ্গের উপরে কৃতিত্ব বা দোষারোপ করে দিই প্রেমের বিষয়ে। অপরপক্ষে অপছন্দ আমাদের কাছে অস্বস্তিকর, স্বাভাবিক ভাবেই- নিয়মিত অস্বস্তির কারকেরা ঘৃণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাকিছু আমাদের কাছে উন্মোচিত নয়, সেগুলোতেই ভয় লুকিয়ে থাকে, যারা ভয় নিয়ে ভয় দেখিয়ে স্বার্থ হাসিল করে বা করার চেষ্টা করে, তারাও ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠে।
ভালবাসা তাহলে কাকে বলে? এক কথাতে না হলেও এর একটা সংজ্ঞা আমার মত করে দেবার চেষ্টা করলাম।
"ভয়কে অতিক্রম করে নিজের বা অন্য আরেকজনের কাছে, নিজের অস্বিত্বকে অক্ষুন্ন রেখে, যাবতীয় অনুভুতিকে সমর্পন করে, আত্মবিসর্জন না দিয়েও আত্মস্থ হয়ে, পারিপার্শ্বিক চাহিদাকে অনুধাবন করে, অনুভুতির উন্মত্ততায় উদভ্রান্ত না হয়ে, অন্য আরেকটি জীবনধারাতে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, আগামীর জন্য পরিকল্পিত জীবনধারা রচনা করা যায়, তাকেই সম্ভবত ভালবাসা বলে"। এর মাঝে কোনো একটিরও অভাব থাকলেই ভালবাসাতে টান পরবেই পরবে।
অনুভুতিই সবচেয়ে বড় শত্রু মানব সম্পর্কের। এর উপরেই যাবতীয় পছন্দ অপছন্দ নির্ভর করে; কিন্তু অনুভুতি ভীষন রকমের আপেক্ষিক। এই জন্যই ব্যাক্তিভেদে অনুভুতির প্রকাশ সম্পর্কের মাঝে সমস্যা তৈরি করে। নিয়ন্ত্রিত আবেগই যেকোনো সম্পর্কের মূলধন। বিশ্বাস বা ভরষা আসলে পুঞ্জীভূত আবেগের ধ্বণাত্বক উপলব্ধি মাত্র। ভালবাসাতে বিশ্বাস প্রাথমিক মূলধন, একটু একটু করে জমা হওয়া বিশ্বাস- সময়ের আঁচে পরিপাক হয়ে ভালবাসার ছাঁচে দানা বাঁধে ও একটা শারিরীক গঠন লাভ করে।
পছন্দ ও অপছন্দের বেশিরভাগটাই আমাদের জৈবিক। বাকি অবশিষ্ট সকল কিছু আমাদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিমণ্ডলে গড়ে উঠে। আমাদের ভাবনারাও সেই পথেই আবর্তিত হয়ে আমাদের মস্তিষ্কের পছন্দ ও অপছন্দের তথ্যপঞ্জির নিরিবিচ্ছিন্ন ক্রম নবীকরণ করতে থাকে। ভালবাসাও তার ব্যাতিক্রম নয়।
প্রেম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটাই সবচেয়ে চলনশীল বিষয়, যার জন্য প্রতিটি রিপু ও ইন্দ্রিয় কর্মশীল। হতে পারে এ ভালবাসা অন্যের তরে বা নিজের জন্য। কিন্তু ভালবাসা ছাড়া মানুষ অচল। কেউ প্রকাশ করতে পারে কেউ পারেনা, প্রত্যেকের নিজশ্ব ভাষা আছে প্রকাশের। যে বা যারা এটা ধরতে পারে, তারা জুটি বেঁধে নিয়ে একসাথে জীবন উপভোগ করে। যখন এই বুঝতে পারাটা দুর্বোধ্য মনে হয়, তখনই বিচ্ছেদের প্রয়োজন হয়। আত্মহত্যাও আসলে নিজেকে বুঝতে না পারার ফল। নিজের প্রতি ভালবাসা ফুরিয়ে যাবার ফল। উদভ্রান্ত উন্মাদেরও নিজশ্ব বুঝ থাকে, কিন্তু অবুঝের পরিনতি একমাত্র - বিচ্ছেদ বা মৃত্যু। একাকিত্ব আসলে নিজেকে অচেনা করে ফেলারই নাম।
ভালবাসাতে যদি চাহিদা না থাকে? কিম্বা ধরা যাক সবটাই নিঃশর্ত! আসলে নিঃশর্তের মাঝেও একটা শর্ত আছে যা ঋণাত্বক নিঃ শব্দের সাথে জুড়ে। এখানেই বিশাল একটা বিভ্রমের সৃষ্টি হয়।
নিঃশর্ত ভালোবাসা হয়? সেটা কি অপরাধ?
হয়, তবে তা দোষের কিছু না। কিন্তু, নিঃশর্ত ভালোবাসা বুঝিয়ে দেওয়াটা বোকামি। তুমি কারো জন্য পারফেক্ট বলেই সে তোমায় ভালোবেসেছে। পারফেক্ট মানে তোমার কাছে কেউ ১০০% দাবি করেনি। তুমি যেমন তেমনটাই তোমার পারফেকশন, অঙ্কের নিয়মে যা ধরা অসাধ্য। ভালবাসাকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক, এটা আদপেই state of mind, এর বেশি কিছু নয়। ধারাবাহিক চলাটা একসময় অভ্যেসে পরিনত হয়ে যায়। এর জন্য সময় দিতে হয় ও নিতে হয়। যতক্ষণ না একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠা হচ্ছে, ততক্ষণ নিজেকে পরিবর্তন করেছো কি ডুবেছো।
অচেনা কাউকে তুমি ভালবাসতেই পারোনা, সিনেমা গল্পে যা ই দেখাক - যাকে তুমি চেনোনা তাতে নিয়ে খুব বেশিক্ষণ ভাবতেই পারবেনা। যত বেশি দেখবে, জানবে, বুঝবে তত বেশি আগামীর স্বপ্ন দেখবে। এভাবেই যত বেশি বদলাবে অকারনে, তত বেশী অচেনা হয়ে যাবে, তত দূরে সরে যাবে। সদর্থক পরিবর্তনের ভিড়ে কিছু সামান্য ভ্রান্তি অদেখা হয়ে এড়িয়ে গেলেও, নাঞার্থক বা নেতিবাচক বা ঋণাত্বক চারিত্রিক বৈশিষ্ঠে যখন বেশি করে শান দেওয়া হয় তখন যাবতীয় "ভাল" গুলি দৃশ্যান্তরে হারিয়ে যায়। এটা বোঝার জন্য যে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয় সেটার জন্য সম্পৃক পরিমণ্ডল চায়, যেখানে উত্তম বন্ধু মণ্ডল ও মুল্যবোধ যুক্ত পরিবারের সমাহার ঘটবে।
অতীতকে পর্যালোচনা না করে, বারংবার একই "ভুলের" পুনরাবৃত্তি অন্যজনকে হিংস্র করে তোলে। ভালবাসার জন্য ১০০টি গুনকে ছাপিয়ে, ঘৃণার জন্য ১০১ টা জেদ এসে চেপে বসে। যা সমকালকে অন্ধ করে দেয় পর্যালোচনার জন্য। মস্তিস্কের ধুসর কোষের সঞ্চিত তথ্যকে অস্বিকার করে চর্মচক্ষের illusion কে সত্য হিসাবে দ্রুত গ্রহন করে পরিস্থিকে জটিল বানিয়ে তুলি নিজ দায়িত্বে।
সম্পর্কের শুরুতে তুমি যা ছিলে তেমনটাই ছিল তার ভালো লাগা। এই সত্যকে আমরা অজান্তেই অস্বিকার করতে শুরু করে দিই। সেটার জন্যই সম্পর্কের শুরু সেগুলোকে আমরা উপেক্ষা করতে শুরু করে দিই। খুব ছোট ছোট বিষয়গুলো তখন নজরে আসে, যেগুলো আকর্ষণ করে ও ক্রমশ সম্পর্কটাকে জমাট বাঁধিয়ে দেয়। তুমি অসংলগ্ন বা পরিপাটি, কালো ফর্সা, মোটা বেঁটে লম্বা সব সব সব কিছু, আসলে ঐ ছিল তোমার পরিপূর্ণতা। সেটাই ছিল একমাত্রিক ভালবাসার রুপ। এটা দেখেই সে মুগ্ধ হয়েছিল।
অধিকাংশ সম্পর্কেই যে বিষয়টা ঘটে সেটা হল, যেটা দেখে একদিন নিজেই মুগ্ধ হয়েছিল সেটাই সে লুকিয়ে ফেলতে চায়। পরিপূর্ণতা আনতে গিয়ে পরিপুরক এনে হাজির করে মৌলিক সত্তাকে না বদলিয়েই। সেক্ষেত্রে কি হয়, পরিপূরক অচেনা হলেও খামতি গুলো বড্ড চেনা হয়ে সামনে একমাত্র পরে থাকে। এক ধরনের identify Crisis তৈরি করে; এবং প্রায় প্রতিটিক্ষেত্রেই শুধরানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আরো জটিল করে তোলে মানবীয় আবেগ গুণ।
কেউই চায় না অন্য কেউ তার সাথীকে দেখে নতুন করে মুগ্ধ হয়ে যাক, যেমনটা সে হয়েছিল। ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে পৃথিবীর সাথে স্বার্থপর হওয়াটা দোষের কিছু না, কিন্তু মানব চরিত্র একবার যেটার অনুশীলন শুরু করে, সেটাই অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়। সেই স্বার্থপরতার ঘাত তার উপরেই বেশি প্রতিফলিত হয়- যার জন্য এই ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়েছিল। একজন ভাবেন সে দূরে সরে যাচ্ছে, অপরজন ভাবে ও কেন বদলে গেল। তখন যুক্তি দূরে সরে যায় আর দুজনকেই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে অনিয়ন্ত্রিত আবেগ। একে অন্যকে Dominan করতে শুরু করি এমন ভাবে যেন অন্যজন একজন পণ্য বা যন্ত্রমাত্র। এগুলো সবটাই fact। দোষটা তখন থেকে শুরু হয় যখন কেউ কাউকে ডোমিনেট করতে করতে নিজেকে প্রায় দেবদূতে পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ভাবি- "এসবই তো আমার স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া ছিল যা তাৎক্ষণিক "। আর এই ভাবনাই সম্পর্ককে মরুভূমি বানিয়ে দেয়।
কেউ যখন এক তরফা ভাবে তোমাকে সম্পূর্ণ জেনে একপৃথিবী ভালোবাসা দিয়ে অবশিষ্ট পৃথিবী থেকে পৃথক করে একটা নতুন দুনিয়া তৈরি করেছিল তোমারই জন্য, সেটা যদি মনে হয় " আজই" রাতারাতি তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল, বা "আমাকে অসহায় করে স্বার্থপরের মত পালালো", তাহলে বুঝতে হবে, খালিটা একদিনে হয়নি। একটু একটু তোমারই উদাসীনতা তোমার উন্নাসিকতা তোমার আত্ম অহংকার তোমার চতুর্দিকে এমন নিশ্চিদ্র বর্ম বানিয়ে রেখেছিল, যে তুমি বুঝতেই পারোনি তোমার পরিপূরক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আসলে তোমাকে একা করে দিয়েছেল। ভালবাসা বিদায় নিয়েছিল ঋতুর মত।
তোমাকে যে ভালোবাসে সে যদি সারা দুনিয়া থেকে তোমায় আলাদা করে ফেলে, তাকে ছাড়া একদিন তুমি অচল হয়ে যাবে।এটাই মানুষের ধর্ম কেউ যদি বুঝে ফেলে তাকে ছাড়া কেউ অচল হয়ে আছে সে এক তরফা শর্ত জুড়ে দেয়। হাজারটা নিয়মে বেঁধে ফেলে অসহায় মানুষটাকে। অথচ শুরুতেই লিখেছি নিঃশর্ত ভালোবাসা দোষের কিছু না তবে বুঝিয়ে দেওয়াটা বোকামি।
শর্তের বদলে শর্ত জুড়ে দেওয়াটা আর যাই হোক ভালোবাসার নাম হতে পারেনা। "আপস" মানুষটাকে ধরে রাখার কৌশল হিসাবে পরিক্ষিত, কিন্তু সেটা খুবই ক্ষণস্থায়ী। গোটা দুনিয়ার মাঝে তোমরা এককাছে এসেছিলে শুরুর দিনের তোমাদের সেই মিল্গুলোর জন্য, যেগুলোকে আজ ভুলে গেছো বা জলাঞ্জলি দিয়েছো। সময়ের নিজশ্ব শর্ত আছে তার দাবি আমরা মানতে বাধ্য। এর উপরে যখন আমাদের অহং শর্ত, তার পরিবর্ত শর্ত- এভাবে পাল্টা পাল্টি শর্তে কেউ আত্মসমর্পণ করে তো পরবর্তী সময়ে 'শোধ' নিতে নিতে ভালবাসাটা একটা বদলে যাওয়া নিকৃষ্ট ঘৃণ্য খেলাতে পরিনত হয়ে যায়।
ভালোবাসতে গিয়ে ভালবাসাটাই মূল্যহীন হয়ে হারিয়ে যায় সময়ের আবর্তে। শুরুহয় Blackmail নামক চুরান্ত এক মারন খেলার, তখন প্রতিশোধ নেওয়াটাই মুখ্য হয়ে যায়। উভয় জনই নিজের মূল্য ধরে রাখতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। যে মানুষটা তোমাকে ভালবেসে আপন করেছিল, তাকে বদলে দিয়ে অদৃষ্টের উপরে দায় চাপিয়ে প্রেমিক যুগল থেকে উন্মাদে পরিনত হয়ে গেলেন। এটা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য।
বদলের অনেক প্রতিশ্রুতি থাকে প্রতিটি ভালবাসার পরতে পরতে, কিন্তু মূল মানুষটার চরিত্রটা অক্ষুন্ন রেখে যেটা দেখে ভালবেসেছিল। নতুবা বহমান সময়ের নিরন্তর স্রোত ভালবাসার কঙ্কালটুকুও অবশিষ্ট রাখেনা।
প্রেম ছাড়া বন্ধনের যাবতীয় যুক্তিই বড্ড একপেশে ও খেলো। প্রেমে যুক্তি লাগেনা, আবেগ লাগে, আর অনিয়ন্ত্রিত আবেগ প্রেমের সলিলসমাধি ঘটায় শুষ্ক মরুভুমিতেও। তখন হরেক যুক্তি সাজিয়েও, নিত্যনতুন পরিপূরক আমদানি করেও "ভালবাসা" reload বা recharge করা যায়না। নিজেকে অন্যের মাঝে দেখিতে গেলে আপস নয়, সমর্পন নয়, সময়কে অনুধাবন করে, নিজেকে চাহিদার উপযোগী করে তোলার নামই সংসার।
যেখানেই শর্তহীন আপস, জানতে হবে রোগ অনেক গভীরে। রোগ নির্নয়ের আগে রোগীর মৃত্যুই বহুলাংশে ঘটে থাকে। I am the best, এ মহামারী চিকিৎসা নেই কোনো চিকিৎসক এর কাছে, উপলব্ধি বিনা। আর এ উপলব্ধি আসে অভিজ্ঞতা থেকে। তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেকটা জীবন নিংড়ে অনিচ্ছাতে সঞ্চয় হয়। তাই ভালবাসাটা জিইয়ে রাখাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় শর্ত। আঁধারের আধার চাইলেই হাসিল করা যায়, যেখানে সবটাই অন্যের ইচ্ছাধীন। মৌলিকতাকে অপরিবর্তিত রেখে সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটাই জীবনের একমাত্র achievement। ওই খানেই সকল কিছু বৈধ, কারন-
ভালবাসার আধারে আসলে সকল কিছুই ঐচ্ছিক।
__________
১০/০২/২০১৯

No comments:

Post a Comment