যদি বলি, নিম্নলিখিত অংশটা একটু সময়
নিয়ে পড়ুন, বা এই নিম্নলিখিত অংশটাতে একটু সময় দিয়ে পড়ুন।
আপনি পড়বেন কি পড়বেন না সেটা আপনার
রুচীর প্রশ্ন, ওটা আমার বিষয় বা এক্তিয়ার কোনটার মধ্যেই পরেনা। তবে আপনি উপরের
দুটো আলাদা আলাদা বাক্যের মধ্যে কোন ফারাক খুঁজে পাননি সম্ভবত। আমিও পাইনি। কিন্তু
মেলালেন তিনি মেলালেন।
হুম, সময়ের কথা বলছিলাম। যার কাছে
দেওয়া আর নেওয়ার মানে একই। আবার পড়ুন শুরুর লাইন দুটো। সময় বড় গোলমেলে। ব্যাপারটা
দুম করে আজ বা এক্ষুণি কিছু ঘটলো এমনটা নয়, সেই শুরুর সময় থেকেই সময় গোলেমেলে।
সময়কে কে দেখেছে! সময় আসব আসব করে সেই
মুহূর্তটি এসে উপস্থিত হলেই, পরমুহূর্তেই দুম করে সেটা অতীত হয়ে যায়। কি ভয়ানক
ধাপ্পাবাজি ভাবুন। অথচ সকলে পরামর্শ দেন সময়ের সাথে সাথে চলতে। আমরা তো সামনের
দিকে চলি, সময় কি তা চলে? আসলটা হল সময়ই উল্টোদিকে চলছে, নাহলে প্রতিটি মুহূর্ত
পিছনে চলে যাচ্ছে কি করে? আপনি ভাবতেই পারেন এটা উন্মাদের কোন প্রলাপ, তাহলে বলব
পুরোটা পড়ুন তার পর আপনিই বলুন সময় টা ঠিক কি? আরে বাবা, আমরা তো পিছনের দিকে যেতে
পারিনা। কেও কি স্নাতক থেকে শুরু করে শিশু শ্রেনীতে এসে উঠেছে? বুড়ো থেকে একটা
জীবও কচি হয়েছে আজ পর্যন্ত! অতএব সময়ের সাথে চলা মানেই পিছিয়ে পড়া, যেখানে আমাদের
এগিয়ে যাওয়ার অর্থ সময়ের চলমান সিঁড়িতে হাঁটতে থাকা। কেও কেও দৌড়ায়ও অবশ্য। সুতরাং
দুটো উভমুখী গমন বলেই সময়ের সাথে চলাটা বোধহয় এতোটা কঠিন।
সময় বাস্তবিকই এগোতে পারেনা। যদি তাই
হতো, তাহলে আমরা যারা ঘরে বন্ধ থাকি, দীর্ঘ সময়কে সাথী করে, কই তারা তো এগোতে পারি
না। বাকি পৃথিবী এগিয়ে যায়, কারন তারা চলছেন বলে। সময়কে সাথী করলেই স্থবির হয়ে
যেতে হয়। সময়কে ভুলতে পারলে তবেই তার উন্নতি সম্ভব। কিন্তু এই ভুলে যাওয়ার
ব্যাপারটাকে অঙ্কের পরিভাষাতে রপ্ত করতে পারলে, তবেই সাফল্য। কখন ভুলবো কতটা ভুলবো
এটাই আসলে সময়জ্ঞান। যেমন পরীক্ষার হলে চলমান সময়কে ভুলে, সম্পূর্ন নিজের মেধা আর
জ্ঞান কে কেন্দ্রীভূত করে কলমের মাধ্যমে উত্তরপত্রে নামাতে পারলে তবেই সাফল্য। ওই
মুহূর্তে সময়ের কথা চিন্তা করেছো কি উত্তেজনার চোটে পরীক্ষা শিকেয় উঠবে।
পরীক্ষাগৃহে যখন সময়কে নিয়ে ভাবার জন্য পেশাদার মানুষজন থাকেন, তখন সময়কে ভুলে যাবার
মধ্যেই সার্থকতা।
অফুরান সময় বলে একটা কথা শোনা যায়। আমি
ভাবি, আমার কাছে সময় গচ্ছিত রেখেছিলটা কে, যে সেটা ফুরাবে না? সময় তো আসলে বিপরীত
মুখী ঘটনাপঞ্জি। পদার্থবিদ্যানুযায়ী বস্তুর উপস্থিতি ত্রিমাত্রিক হলেও বিজ্ঞানীরা
সময়কে চতুর্থমাত্রা হিসাবে গ্রাহ্য করেন, যার নাম স্থানিক মাত্রা। আজ পর্যন্ত কোন
পন্ডিতই সময় সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেননি। সৃষ্টির শুরু থেকে জীব
জগত তথা মানুষ, প্রথমে অনুভব, তারপরে ক্রমান্বয়ে দর্শন, ধর্ম, ও সর্ব শেষে
বিজ্ঞানের মাধ্যমে তাদের নিজেদের ঢঙে সময় কে ব্যাখ্যা করার করেছে, যায় অধিকাংশটাই
পরস্পরবিরোধী।
এই মহাবিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের
অস্তিত্বের একটা মৌলিক কাঠামো খাড়া করতে কোন একটা কিছুকে ধ্রুবক মানতেই হত। আর সময়
হল সেই ধ্রুবক। সুতরাং সময় এমন একটা ‘ইয়ে’, যাকে নিজে থেকে কোন পরিমাপ করা যায়না,
সকল সময় অন্য কিছুর প্রেক্ষাপটে সময়কে পরিমাপ করতে হয়। যেমন বালি ঘড়ি বা সূর্য
ঘড়ি। সূর্য পূব আকাশে উদয় হওয়ার পর থেকে পরবর্তী দিনে সেইখানে আসলে তবেই ২৪ ঘন্টা
সময় হবে। সুতরাং নিজে নিজে হবার জোটুকু নেই। তেমনই সময় নিজে থেকে কোথাও যেতেও
পারেনা, এক্ষেত্রেও সেই অন্য কিছুকে ধরে যাবতীয় এই ভ্রমন বা পরিভ্রমন। শুধিয়ে দেখুন
না তাকে, যিনি পুলিশি হেফাজতে সাতদিন থানায় বন্দি ছিলেন। সময় জ্ঞান সব লোপ পাবে,
কটা বাজে কি বার, কিচ্ছুটি বুঝতে পারবেন না। মানে সময় আপনার কাছে থেকেও নেই, হাওয়া
হয়েছে। সাধে কি আর আইনস্টাইন দাদু সময় চর্চা না করে তার খামখেয়ালীপনা নিয়ে চর্চা
করে গেছে, যার নাম আপেক্ষিকতা। তাঁর e=mc2 সুত্রে সময়ের নামগন্ধটুকু নেই। ভাবুন
খোদ আইনস্টাইন সময়কে ব্যাখ্যা করতে পারেননি, তাহলে আমরা কোন মহারথী!! এতক্ষনে
সময়টাই বুঝতে পারলাম না, ওটা খায় না গায়ে মাখে, তাহলে তার খামখেয়ালীপনা তথা
আপেক্ষিকতা বুঝবো তার সাধ্যি কি!
কখনও ভেবেছেন এতো লক্ষ কোটি মানুষ, আর
তাদের প্রত্যেকের কাছে কত কত সময়। এতো সময় আসে কোথা থেকে? কে যোগান দেয় এই অফুরন্ত
সময়ের? সুসময় আর সুঃসময় কি একই কারখানার উৎপাদন? একই কারিগরের বানানো? তাহলে এদের
প্রকারভেদে মানুষের চরম আচরণ হয় কেন! আচ্ছা নিস্তরঙ্গ সময়ের উপাদান গুলো ঠিক কি কি,
যা কখনই কোথাও তুফান তুলতে পারেনা। খতম হয়ে যাওয়া সময়েরাই বা কোন্ দিকশুন্যপুরে
হারিয়ে যায়? মৃত সময়েরা কোন্ কবরখানাতে সমাধিত হয়? ভেবেছেন কখনও?
অনেকে হামেশাই বলেন, আসল সময়েই কাজ
হাসিল করতে হয়। আচ্ছা তাহলে নকল সময় টা কি? আবার অনেকে বলেন -দিন গুণতে থাক, তোর খারাপ
সময় চলে এসেছে। আমি তো ভাবি সময় কীসে চেপে আসে! সময় কীসে চেপে চলে মানে তার বাহন
কি? তার সঙ্গী সাথী কে কে? সামনের জনকে কে খবর দিল আমার খারাপ সময়ের ব্যাপারে। বড়
গোঁজামিলে বিষয় সন্দেহ নাই।
ঘটনাটা হল আমরা আমাদের নিজেদের ছন্দে
বাঁধার জন্য সময়ের কল্পনা করে নিয়েছি। যেটা বর্তমানে সর্বজনীন। আমাদের জাগার সময়,
কাজের সময়, খাওয়ার সময়, পড়ার সময়, খেলার সময়, হুল্লোড়ের সময় কত্তো রকমের ভাগে আমরা
সময়কে ইচ্ছামত ভাগ করেছি। কোনদিনও কি সময়কে শুধিয়েছি, যে তুমি কি জানো হে! তোমাকে
আমরা আমাদের মর্জি মত ভাগ করেছি? অবশ্যই না। কারণ সময় সে সব ভাগের ব্যাপার জানেই
না। যদি জানত, তাহলে যেটা ধনীর ছেলের কাছে পড়ার সময় সেটাই গরীবের ছেলের কাছে
ক্ষুধা অন্বেষণের সময়। যখন নাগরিকের কাছে উৎসবের সময়, তখন আইনের রক্ষকদের কাছে
দায়িত্ব পালনের সময়, যাতে নাগরিকগণ সুষ্ঠভাবে আমোদ উদযাপন করতে পারে। মানুষ ছাড়া
বাকি অবশিষ্ট প্রানীকুল মোটেই সময়ের খুঁটে বাঁধা নেই। তাদের খিদে লাগলে খায়, ঘুম
পেলে ঘুমায়, আমোদ লাগলে হুল্লোড় করে।
তাহলে হয় সময় একচোখো, নতুবা সময়েরই
সময়জ্ঞান বা আক্কেল হয়নি।
নাস্তিকেরা অস্তিত্ব নেই বলে ঈশ্বরের বিশ্বাস করেননা। তাহলে সময়েই বা বিশ্বাস কেন
বাবা? যদি বলি একটা ভাল বেতনের চাকুরি করি আমি, ঘরে আমার ভরা সংসার, অতএব আমায় সময়
ভাল। এখন চাকুরির পরীক্ষায় আমার থেকে কোন জ্ঞানবান ছেলে যদি প্রতিযোগীতাতে থাকত,
আমি নিশ্চিত চাকরি পেতামনা, একটা মারণ ব্যাধিতে যদি আমি ব্যাতিরেকে সংসারের সকলেই
মারা যায়, তাহলে বলব সময় খারাপ। আচ্ছা এখানে সময়ের কি দোষ? এটা তো তাৎক্ষণিক
পরিস্থিতি দোষ। খামোখা সময়কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া। আদতে সময়ে নামক অলীকের ঘাড়ে
দোষ চাপিয়ে নিজেকে নির্দোষ রাখার কূট প্রচেষ্টা।
সুতরাং আমরা কেউই জানিনা সময় কি! তাই
সময় চলে যাচ্ছে, বা সময় নষ্ট হচ্ছে ইত্যাদি এই জাতীয় বেফালতু ভাবনা না ভেবে, অযথা
রক্তচাপ না বাড়িয়ে জীবনকে উপভোগ করুন, কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আর লক্ষ্যে অবিচল
থাকুন। সময় দেখবেন আপনার সদর দরজার বাইরে তাবু খাটিয়ে অপেক্ষা করছে। প্রসঙ্গত
উল্লেখ্য, ঘড়ি একটা যন্ত্রমাত্র ওটা সময় নয়।
No comments:
Post a Comment