“সীমানা কাকে বলে। কতদূর হাঁটলে সেই
সীমানার প্রান্তে পৌঁছানো যায়। সীমান্ত মানে কি শেষ? নাকি চেনা পরিধির ঘেরাটোপের
বাইরে অচেনা বৃহত্তর জগৎটা”।
মহালয়ার দুপুরে মধ্যাহ্নভোজন সেরে
বৈঠকখানাতে বসে লেবুদা আজকের খবরের কাগজের সম্পাদকীয়টা পুনরায় পড়ছিলেন। পড়তে পড়তে
একটু ঝিমুনি আসতেই এই ভাবনার সাগরে তলিয়ে যেতে লাগলেন, তবে সুধা বৌদির বাঁজখাই
আওয়াজে সেই তাল কাটতে সময় লাগলনা লেবুদার।
তেতো চোঁয়া ঢেঁকুর পুনরায় গেলার মত মুখটা করে লেবুদা বলল...
- দিলে তো একটা উচ্চকোটির ভাবনা বিনাশ
করে...
- উঁ... মিনসে, বলি চারটে দশের মেট্রো ধরব খেয়াল আছে তো! দত্তজা, মান্না বৌদি সহ
বাকিরাও চলে এলো বলে, আর উনি এখনো বসে বসে খেয়ালী দেশোদ্ধার করছেন।
- তুমি আর কি বুঝবে বলো, আমার জ্বালা আমিই বুঝি। লেবুদা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাসসহ
কথা কটা বলেই, ভিতর ঘরে চলে গেলেন।
শেষ দুটো সপ্তাহ থেকেই লেবুদার মত
কোয়ালা প্রজাতির মানুষের মেজাজও বিগড়ে তিরিক্ষি হয়ে আছে। হবে নাইবা কেন! টিভিতে,
খবরের কাগজে রাতদিন যুদ্ধের খবরে মানুষ যেভাবে ফুটছিল, তাতে করে লেবুদা ভেবেছিলেন,
অন্তত কিছু বুদ্ধিমান আর হুজুগে মানুষ যুদ্ধের ভয়ে কিছু জীবন বীমাপত্র খরিদ করবেন।
আর সেই দরুন পাওয়া অতিরিক্ত দস্তুরীর টাকাটা এবারের পুজোয় বাঘাবৌদি এন্ড কোম্পানীর
শপিং এর নামে, জেহাদি হামলার মুখে কিছুটা এক্সট্রা প্রতিরোধ জোগাবে।
এরই মাঝে কদিন আগেই, মায়ের অসুখ
উপলক্ষ্যে পিত্রালয় থেকে দেড় দিনের ঝটিকা সফর সেরে নিয়েছেন লেবুগিন্নি। ছেলে
মেয়েদের স্কুলেও সেই পঞ্চমী না ষষ্ঠীতে কবে যেন ছুটি পড়বে। এদিকে লেবুদা
সার্জিক্যাল অ্যাটাকের ঘটনাতে চরম উৎসাহিত হয়ে, বড়বাজারের এক মাড়োয়ারি
ক্লায়েন্টের পরামর্শমত, জয়-মা বলে ব্যাঙ্কের সিংহভাগ গচ্ছিত টাকা একটি নিশ্চিত
লাভজনক ব্যবসাতে গোপনে লগ্নি করে দিলেন। আসন্ন মুনাফার পুলকে লেবুদার মেজাজ তুরীয়
আনন্দে টগবগ করে ফুটছিল। এই পঞ্চাশেও শুরুতেও, বিশ বছরের ছোকরার মত আজকাল নাকি জোশ
পাচ্ছেন তিনি।
ওমা কোথায় কি! একদিন গেল, দুদিন গেল
সাতদিন, ১০ দিন গেল, যুদ্ধ আর বাঁধল না। অথচ মহালয়ার আগেরদিনিই দ্বিতীয় দফার শপিং
কমপ্লিট। আজ অবশিষ্ট তৃতীয় দফার জন্য ওই চারটে দশের মেট্রো। যাবতীয় তুরীয় মেজাজে
প্রতিদিন এক পরত করে চোনার লোনা স্তর জমা হচ্ছিল।
ডবল মুনাফার স্বপ্নে বিভোর লেবুদার,
সিংহ হৃদয় বিকশিত হয়ে উঠেছিল। দূর সম্পর্কের কিছু আত্মীয়দের জন্যও কিছু পোষাক কিনে
ফেলেছেন। এমনকি শ্বশুরবাড়ির রান্নার মাসির জন্যও একটা শিফন শাড়ি পাঠিয়েছেন লেবুদা।
তবে আজ এসব ভাবলেই লেবুদার চোখ ফেটে যত না কান্না পাচ্ছে, তার চেয়েও টিভি
চ্যানেলগুলোর প্রতি বেশি রাগ হচ্ছে। কি সব মিথ্যা তথ্য, সব এক একটা ক্রিমিনাল...
শালা... জাষ্ট ভাঁওতা!!... ইত্যাদি ইত্যাদি।
সুধাবৌদি বিঘেশ্বরী মায়ের থানে রূপোর
কানের মাকড়ি গড়িয়ে দেবার মানত করেছিল, যাতে লেবুর কিপটেমি সেরে দেয়। যদিও সেটা
বিয়ের পরপরই, কিন্তু আজ গিয়ে মা মুখ তুলে চেয়েছেন, সুতরাং বাঘাবৌদি ভক্তিতে গদগদ।
অতএব অষ্টমীতে মায়ের নামে একটা কাঙালী ভোজন না করালেই নয়।
লেবুদা এমনিতেই যুদ্ধের দুশ্চিন্তায় (
আসলে যুদ্ধ না হওয়ার দুশ্চিন্তায়) অতশত না ভেবেই স্ত্রীর ইচ্ছাতে ঘাড় শুরুতেই নেড়ে
দিলেন। যথারীতি রান্নার ঠাকুর এসে মুদিদ্রব্য, উনুনের কাঠ, কড়াই নৌকা আর ড্রাম
খুন্তি ঝাঁঝরি ইত্যাদির লিষ্টি করে দিয়ে চলে গেলেন। নির্বিকার লেবুদা গিন্নিকে
ব্যাপারটা শুধাতেই তিনি ফোঁস করে জবাব দিলেন, “আ মোলোযা, তুমি যুদ্ধ নিয়ে ভেবে
ভেবে ভেবরে যাও না, টাকের অবশিষ্ট চুলগুলো খিচে তুলে ফেলো, তোমায় এদিকে মাথা
ঘামাতে হবেনা। বিরুকে একদিন আগেই আসতে বলে দিয়েচি।
আসলে বাঘাবৌদি তার কত্তাকে একটা
অতর্কিতে চমক দিতে চাইছিলেন আরকি।
বুকের ভিতরটা মুচড়ে যাচ্ছে, জ্বলে
যাচ্ছে। লোকসানের উপরে লোকসান। এদিকে বোঝার উপরে শাকের আঁটি হয়ে মূর্তিমান মর্কট
“শ্যালক বীরুর” আগমন বার্তা লেবুদার রক্তচাপ আরো বাড়িয়ে দিল। লেবুদা এই ভরদুপুরে
চোখে ধাঁধাঁ দেখতে লাগলেন। ভাগ্যিস চেয়ারে বসে ছিলেন, নাহলে নিশ্চিত ধপ করে পড়েই
যেতেন। না জানি এ কদিন আরো কত অত্যাচার সইতে হবে !
বরং তিনি এই তুচ্ছ সাংসারিক রোজকড়চা
থেকে বেরিয়ে, হন্যে হয়ে বিভিন্ন খবরেরকাগজ, টিভির খবরের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টাতে
লেগে রইলেন। একবার তো পাড়ার লাইব্রেরিতেও গেছিলেন কোন যুদ্ধ সংক্রান্ত বই আছে কিনা
দেখতে। আসলে তিনি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বিষয়টা গভীর ভাবে বুঝতে চাইছেন। সোজা কথায়
সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ঠিক কতদিন পর আসল যুদ্ধ শুরু হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
অষ্টমির সকাল। সকাল থেকেই হাড়কাটা গলির
মল্লিকবাড়িতে রীতিমত মোচ্ছবের মেজাজ। সবাই সাজো সাজো রব শুধু একজন ছাড়া, তিনি
অবশ্যই আমাদের আদরের লেবুদা স্বয়ং। রাস্তার ধারের দক্ষিনের বারান্দার ইজিচেয়ারে
বসে, একটা বিড়ি ধরালেন। আর ভাবতে লাগলেন, কি করে এই লোকসান উশুল করা যায়। তবে
লেবুদার একটা গুণ হল, উনি বেশিক্ষণ ভাবতে পারেননা। সটান সেই মাড়োয়ারী বন্ধুটিকে
ফোন লাগালেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর খানিকটা স্বস্তি বোধ করলে, এবার তিনি ভিয়ানের
কাছে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। করার মত কাজ অবিশ্যি কিছুই ছিলনা, কারন ততক্ষণে
রান্নার কাজ প্রায় শেষ। ক্লাবের ছেলেরাও মুঙলার সাথে পরিবেশন করবে বলে গেঞ্জি
বারমুডা পরে রেডি। লেবুদার ভায়েরাও আছেন প্রায় সকলেই, কিন্তু সমস্তটাই প্রায় একার
হাতে তদারকি করছেন বাঘাবৌদি স্বয়ং।
এদিকে দেখতে দেখতে বেলাও পড়ে এলো, ভোগ
ভর্তি নৌকার সংখ্যাও ফুরিয়ে এসেছে, আর মাত্র অর্ধেক নৌকা লুচি আছে, সাথে সামান্য
ডাল। লেবুদা কাকে যেন ফোন করলেন। সাথে সাথে দু'জন ভ্যানওয়ালা হাজির। এবার লেবুদা
ধড়ফড় করে উঠে, তাদের সাথে বাড়ির ভিতরের দিকে গেলেন। কয়েক মুহুর্ত পর একটা তীব্র
গোঙানি মিশ্রিত আর্তনাদ শোনা গেল। সকলে হই হই করে বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখল
ভ্যানওয়ালা দুজন বেচারার মত মুখ করে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সে যাত্রায় লেবুদার জ্ঞান আর ফেরে না।
অনেক সাধনাতে জ্ঞান ফিরলে তখন সেই আর্তনাদের কারণ ফাঁস হল।
মাড়োয়ারি বন্ধুর পরামর্শমত লেবুদা
বাজার থেকে কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুদ করেছিলেন। যুদ্ধের বাজারে কালোবাজারি
বহু নাম শুনেছেন, একবার সেটার হাতে কলমে করার প্রবল বাসনা। বাজার থেকে আটা, চিনি,
ডাল, ভোজ্যতেল ইত্যাদি কিনে সিঁড়ির নিচের ভাঁড়ার গুদামে রেখেছিলেন। যেদিন সুধাবৌদি
মায়ের অসুখের জন্য বাপের বাড়ি গেছিলেন সেদিন। ছেলেমেয়েরাও ইস্কুলে কলেজে ছিল, তাই
কেও জানতেই পারিনি।
যুদ্ধ লাগলে, বাজারে হাহাকার পড়বে
নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর। ব্যাস সেই তালে এই মালগুলো চড়া দামে ঝেঁপে দারুন মুনাফা।
এর পরেই লেবুদা কিপটে বদনাম ঘোঁচাতে দিলখোলা হয়ে গেলেন। কিন্তু এদিকে আজও পর্যন্ত
যুদ্ধ আর বাঁধল না। একটা করে দিন যাচ্ছে লেবুদা উদভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন। এরই মাঝে
বাঘাবৌদি ভাঁড়ার পরিষ্কার করতে ঢুকে দেখেন ভাঁড়ার ভর্তি খাদ্য সামগ্রী। তিনি
ভাবলেন লেবুর উপরে মায়ের দয়া হয়েছে, সে কিপটেমি ছেড়ে হাতখোলা হয়েছে। পরের ঘটনা
ক্রম আপনাদের সব জানা।
এদিকে সেই মাড়োয়ারি বন্ধু ফোনে বললেন
ওই মজুদ মাল এবার বেচে দিতে, কারন যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা আর নাই। তাই লেবুদা দুজন
ভ্যানওয়ালা ডেকে আনলেন সেই মজুদ বস্তাগুলোকে কয়েক দফায় বাজারে নিয়ে যাবেন বলে। আর
ভাঁড়ারে ঢুকেই দেখলেন ভাঁড়ার অর্ধেক খালি। কারন বাঘাবৌদির এই সুবিশাল কাঙালী ভোজের
আয়োজনের উৎস আসলে এই মজুত মুদিদ্রব্য। ব্যাস একটা আর্তনাদ করেই সটান জ্ঞান
হারালেন। লেবুদা আজ সম্যক বুঝে গেলেন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ঠিক কাকে বলে।
অবশিষ্ট যা মালপত্র ছিল সেটাই দুটো
ভ্যানে চড়িয়ে তাদের বিদেয় দেওয়ার কালে, বৌদি তাদের ভোগ খেয়ে যাবার অনুরোধ করলেন।
তারা হাত ধুয়ে এসে রোয়াকে খেতে বসল। এদিকে সুধাবৌদি দেখলেন লেবুদাও একটা শালপাতা
নিয়ে তাদের পাশে এসে বসে পরল।
সকলে হা হা করে মানা করতেই মুচকি হেসে
লেবুদার জবাব-
- ওরে আজ অন্তত কেউ আমায় মানা করিসনে,
আজ আমার থেকে বড় কাঙাল এদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই ।
No comments:
Post a Comment