Saturday, 20 May 2017

।। রূপচর্চা ।।

(লেবুপূরাণ)
অতঃপর সুজি দিয়া পায়েস রন্ধন করিয়া রোগীনির খাবার পরিবেশন করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। রোগীনি আমার গৃহিনী, তাহার রুগ্ন হইবার যথাযথ কারণ রহিয়াছে সর্বপ্রথম কারনটি অবশ্যই আমি তাহার ভর্তা। আনুষ্ঠানিক ভাবটি অন্য, কয়েকদিন যাবৎ শ্রীমতী বিঘ্নেশ্বরী দেবী আটা-ময়দা-সুজি ইত্যাদি না মাখিতে পারিয়া, আমার উপর অভিমান স্বরূপ আহারাদি পরিত্যাগ করিয়াছেন। না খাইবার সেই তুমুল প্রচেষ্টার কারনে ক্রমশই সে অসুস্থতার দিকে ধাবিত হইতেছে এদিকে আমি মরিয়া যাই অভাবের তাড়নায়, খাদ্যের প্রয়োজনে আটা-ময়দা-সুজির সংস্থান করিতে না পারিয়া; আর সে মরিতে চায় সেই সকল খাদ্য দ্রব্যাদি মুখমন্ডল ও গ্রাত্রে মাখিতে না পারিয়া।
সে যত পারে গলাধঃকরণ করুক, তাহার খাবার প্রতি আমার কোনো আপত্তি নাই; কিন্তু সেই খাদ্যদ্রব্য মাখিবার নামে অপচয়ের প্রতি আপত্তি রহিয়াছে, এবং ঘোরতর প্রবল আপত্তি। এখন ঘোর গ্রীষ্মকাল, বয়স বাড়িইয়াছে; প্রত্যুষ ১০ ঘটিকার পর রুদ্র রবির দহন তেজে মাথার ব্রহ্মতালু অবধি শুকাইয়া কাষ্ঠলন্যায়, উচ্চরক্তচাপজনিত কারনে এই প্রখর তপ্ত দিবসে বীমাপত্রের মুৎসুদ্দি গিরি করিলে, নামোল্লেখন বলে অচিরেই শ্রীময়ী আমাকৃত বীমারাশির যে মালকিন হইবেন, তাহা বলাই বাহুল্য। অর্থের অনটনে যখন তাহার রূপচর্চার নিমিত্তে আটা-ময়দা-সুজি, মুসুরডাল, বেসন, অন্ড ইত্যাদি প্রভূত দ্রব্য খরিদারি করিতে অসমর্থ হইলাম; তখনই সে অভিমান করিয়া, না খাইয়া, ঝগড়া-ঝাটি করিয়া দিনাতিপাত করিতে লাগিল সাফল্যের সহিত।
সপ্তাহান্তের অভ্যন্তরেই জামাইষষ্ঠী, সুতরাং সেই হেতুই যে এই বায়না তাহা সহজেই অনুমেয়। নাভিকুন্তল উদ্গমের পরবর্তী অধ্যয়ে পুরুষের বয়স উক্ত বস্তুর সমহারে বাড়িতে থাকে, এক্ষেত্রে স্ত্রীধনটি স্বামীর প্রতি যত্নশীল হইলে তাহা পরিচর্যাগুনে দৃশ্যত নিয়ন্ত্রণে থাকে, অন্যথা সমবয়সী হইবা সত্বেও অকাল বৃদ্ধের ন্যায় চেহারার রংরূপ পরিবর্তিত হয়। আমি শ্রী দর্পনারায়ন মল্লিক, ওরফে হাড়কাটা গলির সুবিখ্যাত মল্লিক বাড়ির জ্যেষ্ঠ সন্তান লেবু। বছর দুয়েকের মধ্যেই ধরাভুমে অবতীর্ণ হওয়ার অর্ধশত বৎসর পূর্ণ করিব, গৃহিণী আমা হইতে মাত্র ছয় বৎসরের ফারাকে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, তথাপি আজিকের দিবসে তাহার বয়স ত্রিশের কোঠা অতিক্রম করে নাই ভাবনাতে, মননে যাহা আরো নিন্মমুখী। এদিকে মুংলার কিশোরবেলা মধ্যাহ্নক্রমে। অতএব সহজেই অনুমেয় যে, আসন্ন জামাইষষ্টি উপলক্ষে পিত্রালয়ে গমন হেতু দৃশ্যমান বয়সের মুখে উজ্জ্বল্য আনয়নের ব্যার্থ প্রয়াসের তরে এই সকল মুদিখাদ্যাদ্রব্যাদি বিলাস।
এমতাবস্থায় আমার শ্বশুরকুল্যের বোধোদয় ঘটিল, শ্বশুরমহাশয় স্বয়ং আসিয়া নিজ কন্যাকে স্বগৃহে লইয়া গেলেন। ভাবটি এমনতর যেন, সর্বসাকুল্যে আমার দোষ নির্ধারন করিয়া জনসমক্ষে কর্ণ মলিয়া দিতে চান। শ্বশুর আমার অবসরপ্রাপ্ত, তাহার অবস্থা বর্তমানে আমা অপেক্ষাও অতি দীন, তাই তাহার তুলনায় অবস্থাপন্ন আমাকেই তিনি তাহার একমাত্র কন্যাকে পাত্রস্থ করিয়াছিলেন। সুতরাং ধনী স্বামীর নিকটে রূপচর্চার আবদার করাটা স্ত্রীর মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত, এবং সেটা পূরণ করাই যেন স্বামিদিগকের একমাত্র দায়িত্ব  কিন্তু এই চল্লিশ উত্তীর্ণ জীবনে সেই কিশোরী রূপের আনয়ন কিভাবে সম্ভব?
আমার স্ত্রীকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি নিঃসন্দেহে, কিছুটা স্ত্রৈনও বটে; তাই গৃহে তাহার অভাবে অন্তরে অন্তরে কাঁদিয়া-কাঁটিয়া বেড়াইতেছিলামতাহাকে পিত্রালয় হইতে আনয়নের উদ্দেশ্যে যতবার ভেউভেউ করিয়া কাঁদিতাম সেই অকুস্থলে; তৎক্ষণাৎ তিনি রুদ্ররূপিনী সাজিয়া আমাকে ঘেউঘেউ করিয়া তাড়াইয়া দিত। এদিকে গৃহ আমার প্রতিক্ষনে চুরান্ত অগোছালো অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রায় ভাগারে রুপান্তরের দশা উপস্থিত হইল। অবস্থার বেগতিক দেখিয়া আমি বুদ্ধি আঁটিলাম যে, পুরাতন মুখমন্ডল পরিষ্কারক চুঙ্গিতে আমার সমস্ত ক্রন্দনের জল আর তরল নাকের সর্দি জমা রাখিব এবং উহাই ভেষজ ও প্রাকৃতিক উপাদান বলিতা তাহার সম্মুখে উপহার স্বরূপ প্রদান করিব। তাহাই করিলাম, চুঙ্গিটি পূর্ণ হইলে বিদেশী প্রযুক্তির দেশীয় মুখমন্ডল পরিষ্কারক আনিয়াছি ইত্যাদি বলিয়া তাহাকে আনিয়া লইলাম বটে; তবে কথা লইয়াছিল তাহার আটা- ময়দা-সুজির-ডিম্ব-মুসুর দানা ইত্যাদির অভাব অপূর্ণ রাখা যাইবেনা। তৎক্ষণাৎ মনে মনে ভাবিলাম, প্রয়োজনে দশ টাকা দিয়া এক প্যাকেট চক(খড়ি) কিনিয়া তাহা পিষিয়া তাহাতে দুফোটা সুগন্ধী মিশাইয়া পাউডার বলিয়া চালাইয়া লইব। কারন পোড়া মুখে খড়ি হউক বা ল্যকমে , ফলাফল সেই একই। আর বৌ এর রোগটাও যখন মানসিক, সেক্ষেত্রে এটাই যথেষ্ট। অতএব, আমি বলিলাম, আচ্ছা-তাহাই হইবে। যাহাই হউক, বাড়িতে ফিরিয়া মুখমন্ডল পরিষ্কারক পাইয়া অতি খুশিতে বউ আমার লক্ষী হইয়া উঠিল, নিত্যদিন মনের আনন্দে সেই ফেসওয়াস মাখিয়া চলিল; কিছুটা আক্ষেপ ছিল , ইহাতে নাকি কোন খুশবু নেই।
আমি অতি ক্লেশে দিনের খাবার দিনে যোগাড় করিয়া যাই, পায়ের ঘাম মাথায় তুলিয়া সারাদিনে যাহা রোজগার করি, তাহাতে সুজির লোনা পায়েস আর আটা-ময়দার পোড়া রুটিই কেবল গলাধঃকরণ করার জন্য জুটিতে পারে। তবুও ঠিক মতো যোগাড় করিতে পারিনা- দাম অতি চড়া, তুলনায় রোজগার অতি সামান্য। আর রুটিও পোড়াই জোটে, কারন আমার বউয়ের বারবার আয়না দেখিবার জন্য সময়ের বেঘাত ঘটে, অগত্যা...
আটা-ময়দা-সুজি,হলুদ, অন্ড, বেসন, ফলমাকর আর মুসুরির ডালের দাম কেবলই বাড়িয়া চলিয়াছে। যার অন্যতম কারন নিশ্চিন্তে স্ত্রী জাতীর রূপচর্চা জনিত বাড়তি অপচয়; ফলস্বরূপ দ্রব্য সীমিত হইয়া অর্থনীতির হিসাব অনুযায়ী দাম বাড়িয়া গিয়াছে। আমাদের মতো স্বামীর পক্ষে রূপচর্চা তো দূরে থাকুক; খাইবার জন্যও তাহা কিনিবার সামর্থ্য ক্রমে হারাইতেছি। তাছাড়া খাইবার জন্য যখন এইসমস্ত দ্রব্য কিনিয়া আনি, তখন আমার বউ আর আমার সহদোরা তাহা হইতে অধিকাংশ টাই ঊঠাইয়া আলাদা করিয়া রাখিয়া দেন, আর তাহাতে পোড়া বেগুনের মত ক্ষত ভরা মুখমন্ডলের রূপচর্চা হইয়া থাকে- প্রথমে মাখিবার জন্য ও পরে খাইবার জন্য, যদি অবশিষ্ট থাকে।
আমি যখন বিষয়টা বুঝিতে পারিলাম, বোনকে মৃদু ভর্তসনা করিলাম কারন বৈকে ভর্তসনা করা যায় না এই পরিস্থিতিতে। সহোদরাকে যথাসাধ্য বোঝাইলাম যে, সে যেন এই সকল খাদ্য দ্রব্যের অপচয় করা থেকে বিরত থাকে। ইহাতে সে ক্রুদ্ধ হইল, এবং সে স্বদর্পে তাহার বৌদির নিকট সেই আমাকতৃক মুখমন্ডল পরিষ্কারক তৈরির গোপন ফর্মুলা ফাঁস করিয়া দিল। ব্যাস ভুকম্পের আর কোন কারন অবশিষ্ট ছিল না। সেই যাবৎ না খাইয়া, ঝগড়া-ঝাটি করিয়া আমার স্ত্রী রত্নটি অসুস্থ রহিয়াছে। ভাবিয়াছি- আগামী কাল্য হইতে আমার রুটি- পায়েসের ভাগে যে আটা-ময়দা-সুজি ডাল, ডিম্বপাক ব্যয় হয়, সেসমস্ত তাহাদের রূপচর্চার তরেই ব্যয় করিব। তাহাদিগকে খুশি রাখিতে, প্রয়োজনে আমি না খাইয়া থাকিব তাহাতেও আক্ষেপ নেই, এবং যদি তাহাদের কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহাই আমি ভক্ষন করিব।
কোন কূলবধু হয়তো বলিবেন, স্বামীর সুস্থ থাকার জন্য ইহার অতি প্রয়োজন রহিয়াছে, কারন বেশি খাইলে মেদ বাড়িয়া যাইবার প্রবল ঝুঁকি, সুতরাং কম খাইবার দরুন খেলো না হওয়াই শ্রেয়। এক্ষনে কেহ বলিবে স্বামীর মনে শান্তি না রাখিয়া শুধু রূপ দেখাইয়া সুখ দিতে যাওয়া অনেক নিম্নবর্গের কর্ম, কিন্তু আমি বলি প্রথমে পেটে শান্তি প্রয়োজন মানসিক শান্তি তো পরবর্তী পরিচ্ছদের পাঠ্য। বউ আমাকে ছাড়িয়া বাপের বাড়িতে যাইয়া থাকিতে পারিবে; কিন্তু আটা-ময়দা-সুজি, ডাল, বেসন, ডিম্ব ইত্যাদি ছাড়িয়া রহিতে পারিবে না, এ সত্য প্রমানিত। পাশাপাশি আমিও বউ বিনা রহিতে পারিব না।
একেক সময় ভাবি, কোনটা স্ত্রীজাতির অঙ্গ। শুভ্র সজ্জা বিশিষ্ট বহিরাঙ্গ? নাকি জন্মগত সুত্র প্রাপ্ত চর্ম সম্বলিত একটি কোমল স্ত্রী হৃদয়।

যে যাহাই হউক, পেটে ও মন দুটোই অভুক্ত। কারন ঘরে ও মনে কোথাও আপাতত স্ত্রী নাই, আছে শুধু অনেক অনেক বেশী রোজগারের প্রয়াস। তাহাতে প্রান বাঁচুক আর না ই বা বাঁচুক সেই পায়েস বর্তমানে প্রস্তুত, জামাইষষ্টির পূর্বে বউকে উতসর্গ করিয়া আমিই গ্রাসাচ্ছাদন করি। 

No comments:

Post a Comment