চলতে চলতে - ৩
একে ছাল ক্যেলানো গরম। সকাল থেকেই মনে হচ্ছে, যে মোমো
প্যানের ভিতর গ্যোঁত হয়ে বসে আছি। আমার সিল মাছের ব্লাডারের গুঁতো, চর্বিতে
চর্বিতে টের পাচ্ছি। বগলে পাওডারের পুরু স্তর প্রবাল প্রাচীরের মত শক্ত হয়ে
যাচ্ছে।
তার উপর সক্কাল সক্কাল ধামাধরা দলের কেষ্টু বিষ্টুদের
আনাগোনা। শ্লাদের সারা বচ্ছরই মোচ্ছোব; আজ রোববার ঠিক জানে বাড়িতে থাকবো, তাই আমার
আপনার মত ম্যাঙ্গো পিউপিলের কাছে চাওয়াটা তাদের তো গনতান্ত্রিক অধিকার। জুত
অবশ্য খুব একটা হলো না, একটু অসম্মানেই বিদেয় হলো। তার মধ্যে একটা ছিনাল ও ছিলো।
ইচ্ছা হচ্ছিলো ওটাকেই একটা কিছু দিই, নিদেনপক্ষে একটা ঝিঙ্গালিলা। কি
উৎকট পোষাক রে বাওয়া; যৌবনের টায়ারের দাগ টাও মিলিয়ে যাবার পথে, কিন্তু সেটাকে
দৃশ্যমান করে রাখার কি আপ্রান প্রচেষ্টা। অন্তত একটা ডিও
দেবার ও ইচ্ছা শেষমেশ হয়েছিলো। যা ঘামের গন্ধ, আঁতুড়ের স্যারেলাক উঠে আসার যোগার।
আমারই বা কম কি!! একবার মাথা মুছলে এক জামবাটি ভর্তি ঘাম বেড়
হচ্ছে, সত্যিকারের হিসু বলতে রাত ছারা গোটাদিনে মোটেই হচ্ছেনা। কিডনির পরিশ্রুত বদ
জল সবটাই ঘামের জন্য ব্যবহার হচ্ছে, হিসির ট্যাঙ্কিতে তাই সাপ্লাই নেই। কাজ শুরুর
কাজ চলছে, সাইটে একবার রাউন্ড দেবো কি; আধা পথে যেতেই পায়ের জুতো ভিজে সপসপ।
অনেকেই লক্ষ্য করছে, সাহস
করে বলতে পারছে না, ভাবছে প্যান্টে মুতেছি।
ওরে পাগলা, ওটা ঘামের গঙ্গা যমুনা। মাথার গড়ানো মাল, বুক
পিঠ থেকে কালেকসন করতে করতে সরস্বতীর ফল্গু ধারা নিচের দিকে নামছে। যার জন্য
অস্বস্তি ঠিকিই আছে, কিন্তু
সে রকম কষ্ট নেই। ওটাই কলেবরকে শীতলতা যোগাচ্ছে; তবে চাঁদি ফাটছে। মাথার চুলও শ্লা
হালকা হয়ে গেলো, জাষ্ট
ঘেমে ঘেমে। লিটার লিটার জল গিলছি, শরবত বৎসর বৎস বাৎসায়ন এক্কেবারে নরকগুলজার। এই গরমেই
কেন জামাইষষ্টি হয়? আর সন্ধ্যের কালবোশেখিতেই যত্ত বিয়ের নেমন্তন্ন। একে তো গাড়িতে
গাড়িতে পথে ঘাটে ট্রেনে বাসে হাঁসফাঁসে জীবন জেরবার, তার ওপর ফোন! কেন যে এটা
আবিষ্কার হয়েছিল কে জানে,
মুষ্ঠিযন্ত্র কম, মিথ্যা
যন্ত্র বেশি... জ্বলে
গেলো জীবনটা।
সকালে উঠে কি খাবো কি খাবো এ একটা ভীষণ
যন্ত্রণা। ঝিঙ্কু মামনি বা ডাম্বেলওয়ালা বীরপুরুষ নিদেনপক্ষে মেনিমুখো স্ত্রৈণ
মাতৃভক্ত নেকুপুসুটিও নই; যে আধ বাটি দুধে বাইশদানা কর্ণফ্লেক্সের সাথে কুচি কুচি
করে কাঁঠালি কলা আর হলুদ কিসমিস ফেলে সাঁটবো। দই চিঁড়ে পোষায়না, মুড়ি চেবানোর সময়
নেই। বাকি ম্যাগি, পাস্তা দিয়ে নাস্তা করার মত পকেট সায় দেয়না। পরোটা খাবো তার
উপায়ও নেই, সারাটাদিন বদ ঢেঁকুর উঠবে। পেটে বুদ্ধি না থাক, অম্বলের কমতি নেই।
অগত্যা দুটো মারি বিস্কুট, চিনি ছারা ঘন দুধচা ই সম্বল, সেটাই এক মগ পুরো। ভারী
খাবার মানেই সুজির বিস্বাদ হালুয়া। জলখাবারে লেবু বিট লবন দিয়ে একড্রাম ছাতুর
শরবত। আহা, যতই কোন্ডড্রিংকস, রাসনা, গ্লুকনডি বাজারে আসুক ঘোল বা ছাতুর সরবতের
কোনো বিকল্প নেই।
এরপর আধা ঘন্টার কমোড সাধনা, আগে আনন্দবাজার
নিয়ে ঢুকতাম, সাথে দুটো সিগারেট; এখন মোবাইল। আজ সাদা দাড়ির সুদীপদাকে দেখে বেশ
আমলাশোলের মত লাগছিল, বেশ একটা শান্ত পরিতৃপ্ত হয়ে সুকর্মটি করছিলাম, বাইরে থেকে
শৌচাগারের লাইট আর এক্সহষ্ট টি বন্ধ হতেই বুঝলাম বেড়োতে হবে। ঘড়ির
কাঁটা নটার ঘর ছাড়িয়েছে, হাতে বাজারের থলে। পটল আর উচ্ছেতে মানা, তাজা বাটা বাছ আর
কাটা পোনার হুকুম হল। বাইকে স্টার্ট দিয়ে পিচ রাস্তাতে নামতেই টের পেলাম, জৈষ্ঠ
কাহারে কয়। কোনোক্রমে বাজারের সম্মুখে বাইকটি স্ট্যান্ড করলাম, একটু ছায়া দেখে
রাখলয়াম।
নতুবা
কালো সিট রোদের তাপে পুরো তাওয়া হয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে; আর তাতে নধর
পাছাটি ঠেকলেই ওটি পুড়ে তুন্দুরি হয়ে চকিতেই ওরাংওটাং সদৃশ্য হয়ে যাবে।
ছোটবেলায় দাদুর হাত ধরে বাজারে যাবার
পায়েখড়ি। বাজারে যাবার প্রথম আকর্ষন ছিল প্যাঁদানি পরোটা আর জিলাপি। কারন মায়ের
কড়া শাসনে ঘরে ওগুলোর কোনো এন্ট্রি ছিলনা। দাদুর সামনে মা কাকিমারা যেতেননা, তাই
ওনার সাথে করা যাবতীয় কর্ম মাফ। তখন সপ্তাহে দুদিন বাজার বসত, বাড়িতে ফ্রিজও ছিলনা
তাই কাঁচা শব্জি আর কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছই বাড়িতে আসত। পোলট্রি মাংস দেশে
আসেনি। বাজার থেকে মাংস এসেছে মানেই পাঁঠার মাংস বুঝতাম। বাকি মাছের প্রয়োজনে
পুকুরে জাল ফেললেই হত, সপ্তাহে ২-৩ বার জাল টানা হত ভোরের দিকে। বেশ কয়েকটা পুকুর
ছিল তারাই যাবতীয় মাছের যোগান দিত, ইলিশ আর চিংড়ি ছারা। সব্জিও নিজেদের জমিতেই
মুনিষ দিয়ে সারা বছর চাষ করা হত; কারন তখন একান্নবর্তী পরিবারে কমবেশি একেকবারে
১০০ পাত পড়ত এক বেলাতে কাজের লোক নিয়ে। পথে কত লোকের সাথে আলাপ হত দাদুর, কত কথাবার্তা
আলাপ কুশল বিনিময়। সাথে দুজন লোক, একজন ছাতা ধরে, অন্যজন ব্যাগ আর আমাদের ধরে।
আমরা সংখ্যায় জনা চার পাঁচ তো থাকতামই।
হিরে থেকে জিরে কিনা জিনিস বিক্রি হত বিস্তর দামদড়ের সাথে। বাজারের মাঝে
দাদুর ভুষিমালের গদিঘর, সেখান থেকে বসে বসেই বাজার সারা। সে এক দিন ছিল, আজকাল আর
সেই দিন নেই, সকলেই ব্যাস্ত, ভীষন ব্যাস্ত। বাইক হাঁকিয়ে এক দৌড়ে কাজ সেরেই ঘরে
ফিরে কাজ আর কাজ, হুম ফেসবুক করাটাও কাজই বটে।
বাজারের মুখেই খারকোন পাতা, কচুর লতি, কচি
নিমপাতা, বুড়ো পাটশাক, ছালউঠা তালের শাঁস, ন্যাতানো লাউ শাক, ব্রাহ্মী শাক, অনাথ পুঁই
ডাটারা যেভাবে স্বাগত করল, তাতে মনে হল কৃপণ বাড়ির ভোজে এসেছি। চার কেজি আলু ৩৬
টাকা, দুকেজি পেয়াজ ২৪ টাকা, আর শুধাইনি, আদা, রসুন, কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা আম,
লালশাক, ঝিঙে, ধনেপাতা, পাতিলেবু, ভেন্ডি, একটা ছাঁচিকুমড়ো, এক ফালি মিষ্টি কুমড়োর
সাথে, টমাটো, বরবটি, বেগুন, কাঁচকলা, বাঁধাকপি, কাঁকরোল, মাচার শশা ও কেজি দুয়েক
কচু। এ দিকের সব্জি বাজার শেষ। মাথার উপরে কালো ত্রিপল চাঁদি ছুঁয়েছে, তার যেন হাত
খানেক উপরেই সূর্য বাবাজীবন রোদের শোরুম খুলেছেন। বাজারের সেই ঠিক এক হাত সরু
হাঁটা পথের দুপাশে ঝাঁকা নিয়ে শব্জি বিক্রেতারদল শব্জি শিকারীদের সাথে অদৃশ্য
যুদ্ধে নিয়োজিত। গোটা চারেক খাসির লাশকে পাশ কাটিয়ে, খাঁচায় বন্দি মুরগী গুলোর
ভবিষ্যতকে অগ্রাহ্য করে, গুণে গুণে ১৯ কদম পর পৌছালাম তীব্র আঁশটে গন্ধ ওয়ালা
মাছের বাজারের দিকে।
মাছের বাজার, পৃথিবীর এক আশ্চর্য শোরুম।
কিনবে লোকে একটিই প্রজাতি, কিন্তু দেখবে গোটা বাজার আর দামদড় করে আর্ধেক বাজারের;
নতুবা বাঙালী বাজুরেদের আত্মা শান্তি হবেই না। শিলভারকার্প আজও যথারীতি সস্তা, ৮০
টাকা কেজি ওটাই বেশি বিকোচ্ছে; তার পরেই লোটে, ভোলা, পাঙ্খা ইত্যাদি । গঙ্গার চিঙড়ি
৩০০ টাকা কেজি, মোটামুটি ৫০-৬০ গ্রাম সাইজের একেকটা ও ছোট মাথাযুক্ত। অন্ধ্রের
রুই, একেকটা ১০-১৫ কেজি সাইজের, ভিড় ওখানেও। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভিড় জ্যান্ত
কাতলার কাছে, একেকটার সাইজ ৬০০ গ্রাম সাইজের। জল থেকে তুলতেই দেখি আমারই মত মুখ হা
করে খাবি খাচ্ছে; সুতরাং স্বজাতীয় ভেবে এদের অগ্রাহ্য করতে পারলাম্না। খান তিনেক
নিলাম, ২০০ টাকা করে কেজি। পাশের মাছওয়ালার আমাকে দেখে হাঁকাহাঁকি শুরু করেছে, তার
কাছে কিছু গঙ্গার মিক্স-চুনো, কিছু ডোবার ল্যাঠা ও শিঙ্গি রয়েছে। একটা মৃদু হাসি
দিয়ে বোঝালাম আজ তোমার দিন নয় আমার জন্য। আরেকটুদুর এগোতেই দেখি ইলিশ... নোলা
ছোঁকছোঁক করে উঠল। পাশে বড় পুঁটি, মৃগেল, চিতলও আছে।
অসময়ের ইলিশের দামদড় করাটা ঠিক স্ট্যাটাসে
খাপ খায় কি খায়না বুঝে উঠতে পারছিলামনা। ‘দে পচা দুটো ইলিশ দে’ বলতেই পচার হাজা
ওয়ালা হাতটা তুলে আমাকে থামানোর ভঙ্গিতে হেসে বলল, কাকা- ইটা ইলিশ লয় গো, চোকটা
দেকোনা কেনে...
সত্যিই তো মড়া মাছ গুলো আমাকে বেশ বড় বড় করে
চোখ দিয়ে ভর্তসনার ভঙ্গিতে দেখছে, ইতি মধ্যেই পচার ভাই উজো বলে দিয়েছে এটা খয়রা
মাছ, কিন্তু বড় সাইজের। যাই হোক ওটাও নিলাম দু পিস, সাড়ে আটশো গ্রাম। ধনেপাতা দিয়ে
পোড়াপোড়া চচ্চড়ি বেশ জমে এই মাছের। ঘেমেনেয়ে বাজার সেরে বেড়োচ্ছি, এক্কেবারে গেটের
মুখে পাকরাও করল মাতাল সাহেব। আগে ও ছিঁচকে চোর ছিল, পুলিসের ক্যালান খেয়ে আজকাল
আর ছুটতে পারেনা। তাই আম বাগান পাহাড়ার কাজ করে, তাদের হয়েই সম্ভবত আম বেচতে
এসেছে।
ভাইপো তুমি বাজারে? ছেলেটা আসেনি বুঝি?
বুঝলামনা বাজারে আসতে আমার মানা কোথায়। সে আমার বাবার বয়সী, বাপকে নিয়ে একগাদা
কথার ফাঁকেই বেশ কয়েক কেজি আম আমার থলেতে দিল। বেছে বেছে কিছু আঁটির আম আর
হিমসাগর; এক্কেবারে গাছপাকা। একটা আমের একটা সাইড কালোহয়ে পচ ধরেছে, সেটাকে হাতে
দিয়ে বলল, ভাইপো এটা খা; কোকিলেপাদা আম। আমি বুঝে পেলামনা কোকিলের পাদে এমন কালো
হয়ে যাবার কারনকি? আর কোকিল বেছে বেছে আমেই বা কেন পাদ দিতে আসবে? অদৌ কি কোকিল
পাদ দেয়? বললাম ব্যাগে দাও খুড়ো, হেব্বি গরম, বাড়ি ফিরে খাবো। কুড়ি টাকা কেজি আম,
সাথে একগাদা ঝাড় পাতা সমেত লিচুও আছে। টাকা মেটাতে গয়ে প্রমাদ গুনলাম। টাকা শেষ,
মুখ দেখে খুড়ো বলল বাড়ি যা, আমি বিকালে গিয়ে নিয়ে আসব।
বাড়ির মহিলাদের এ এক চিরন্তন কীর্তি। সুযোগ
পেলে পকেট মারাটা যেন জন্মগত অধিকার, আর তারই ফলাফল উপরের ঘটনা। বাইকে স্টার্ট
দিয়ে গিয়ে একটা সিগারেট মুখে নিলাম, তাতেই আবিষ্কার করলাম পকেটে দেশলাই নেই। ছাতা
সাইকেলের পর এই দেশলাই। আমার চিরাচরিত অভ্যাস, দেশলাই হারাবেই। শ্লা দরকারের সময় আর খুঁজে
পাবো না। যে পকেটেই হাত দিই সিগারেট ১-২ প্যাকেট বেড়োবেই। কিন্তু দেশলাই বা লাইটার!!!! কোন মতেই না।
কোথায় যে ফেলি, না কি
যে হয় কিছুই জানি না। ওদিকে নেশা মাথায় চড়ে নেত্ত করছে, বাড়িতে অপিসে সর্বত্র
লোকে খিস্তি খাচ্ছে......
সারমর্ম:- দেশলাই না হারানোর কৌশল জানা আছে কারো?
Please
help me, এবার মনে হচ্ছে উন্মাদই হয়ে যাবো।
No comments:
Post a Comment