২
দুপাশে
কিশোর পাটগাছের ক্ষেতের ভয়ানক গুমোট গরম সাথে করে, ধুলোউড়া গ্রামের পথে
যতক্ষনে বাইক চালিয়ে প্রান্তিক নদীয়ার হল্ট স্টেশনটিতে এসে পৌছালাম, ততক্ষনে ডাউন ট্রেনের খবর হয়ে গেছে। ফাঁকা ধু ধু মাঠের মাঝে একটি ছোট্ট
বর্ধিষ্ণু চাষী গ্রাম, আর তার মানানসই আরো ছোট স্টেশনটি।
এখানে
প্রতি বছর বন্যার জল ওঠে, এবং বলা যেতেই পারে গঙ্গা কয়েক হাতের মধ্যে। তাই
স্টেশনটা অদ্ভুত ভাবে মাটি থেকে কমপক্ষে শহুরে ফ্ল্যাটের সাইজের ৩ তলা উপরে।
শুনেছি এই স্টেশনে নাকি জনা চারেক রেলের স্টাফ আছে, আজ
পর্যন্ত আমার দর্শনে ২ জন ছাড়া কাওকে পাইনি। একজন দিনে অন্যজন রাত্রে। যিনি
ডিউটিতে থাকেন তিনিই ঘোষক, টিকিট ভেন্ডার, সিগন্যাল ম্যান ও চেকার। প্রয়োজনে প্রথমিক এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা, হাত দেখা সহ নানান পরিষেবা, তুলনামূলক যুবক চাকুরে
ভদ্রলোকটি শুনেছি দিয়ে থাকেন।
গাড়িটা
স্টেশনের নিচের গ্যারেজে রেখে চাবিটা একটা লোপ্পা ক্যাচে গ্যারাজওয়ালার হাতে
গচ্ছিত রেখে প্রায় দৌড়ে গিয়ে একটা রিটার্ণ টিকিট কাটলাম। দুপুর ১১:১৭ এর ট্রেন, কাঠের
বগি বা কয়লার আমলে এটা নাকি ক্যাশ গাড়ি ছিল, জানিনা বর্তমানে
কি স্ট্যাটাস। স্টেশনে কিছু শব্জি বিক্রেতা দেহাতি মহিলা, কয়েকজন
হকার, কিছু পাশের ইঁটভাঁটা শ্রমিকের ছেলেপুলের দল আর গোটা
তিনেক বাস্তু ভবঘুরে আর হাতে গোনা কয়েকজন প্যাসেঞ্জার রীতিমত ধুঁকছেন। আসে পাশের
গাছ গুলোর মাথা প্ল্যাটফর্ম থেকে ছোঁয়া যায়, তাই ছায়ার
প্রশ্নও নেই, ফুট ওভার ব্রিজের নিচে এক চিলতে ছায়া, সেখানেই গোটা স্টেশন আশ্রয় নিয়েছে। হাওয়া চলছে ঠিকিই কিন্তু সে হাওয়া ভীষন
উষ্ণ। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে একটা সিগারেট জ্বালালাম, সুখটান পর্যন্ত পৌছানোর আগেই হুইসেল দিতে দিতে ১২ বগির অফ হোয়াইট আর
বেগুনীর বর্ডার দেওয়া আধুনিক মডেলের উইন্ডস্ক্রিন যুক্ত নতুন EMU ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল।
হকার
ভাইদের তৎপরতাকে টেক্কা দিয়ে ট্রেনে চড়তেই ট্রেন ছেরে দিল। এই দুপুরের ট্রেনেও বেশ
ভাল ভিড়,
সিট নেই মোটেও। তবে দাঁড়িয়ে যাওয়া যায়। দুপুরের ট্রেনগুলোর সুবিধা
হচ্ছে এখানকার যাত্রীগুলো সব ঘরোয়া মানুষজন, ডেলিপ্যাসেঞ্জার
নামের কলঙ্ক ওই অসভ্যগুলোর প্রাদুর্ভাব থাকেনা। আত্মীয়স্বজন বাড়িগামী বা ঘরমুখো
মানুষজনের সাথে বড় বড় লাগেজে ঠাসা বগি। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরাও আছে, মাঠের মুনিশ আছে, বাউল, ঢাউস
বালতি সহ দুধ বিক্রেতা, আর বেচারামুখো স্বামীতে থিকথিক করছে।
মাথার
ঘাম মেরুদন্ডের নদী বেয়ে ভায়া জাঙ্গিয়া পাছায় পৌঁছে প্যান্ট আর দাপনা ভিজিয়ে
রেখেছিল। ট্রেনটা চলতেই দমকা হাওয়া.... প্রানে নির্মল শান্তি প্রদান করল। কাঁধ
থেকে ব্যাগটা উপরের তাকে রেখে সেই প্যাসেজেই ঢুকে গেলাম। ঘামে মাথাটা ভিজেই ছিল, তীব্র
হাওয়াতে, চোখের পাতাদুটোকে নিয়ন্ত্রনের বাইরে নিয়ে চলে
যাচ্ছিল প্রায়, এমন সময়....
-' ও দাদা, কামড়াবেন নাকি! এক্কে বারে কচি দেহ।
ছাল ছাড়িয়ে দিচ্ছি, বিট নুন দিয়ে.....'
ছাল ছাড়িয়ে দিচ্ছি, বিট নুন দিয়ে.....'
তন্দ্রা
ছুটে গেল। বুঝলাম শশা বিক্রেতার বিপণন কৌশল।
-.... ও দাদা, গরমে ঠান্ডা। খাবেন নাকি! পোড়া আম দিয়ে
বানানো ঠান্ডা সরবৎ....
.... জল, সিল প্যাক ঠান্ডা জল, জল......
.... রুমাল সংগ্রহ করবেন নাকি! শান্তিনিকেতন এর তাঁতের কাপড়, পিওর সুতি.....
.... জল, সিল প্যাক ঠান্ডা জল, জল......
.... রুমাল সংগ্রহ করবেন নাকি! শান্তিনিকেতন এর তাঁতের কাপড়, পিওর সুতি.....
নাহ, ঘোড়ার
মত দাঁড়িয়ে ঘুমানোটা আজ আর হচ্ছেনা। হঠাৎ পায়ের উপরে আরেকটা জুতোর চাপ,... আ... করে মুখ দিয়ে ব্রজবুলি বেড় হতে হতে থেমে গেলাম। একটি ৫-৬ বছরের
বাচ্চা তার মায়ের কাছে কিছু একটার জন্য ঝোঁক ধরেছে। সুতরাং অতি উৎসাহে আমার পা
অগ্রাহ্য করাই যায়.....
....পেপসি, দই চিনি আর বারো রকমের লবন ও মশালা দিয়ে,
গরমে আরাম..... মাত্র ৫ টাকায়.... পেপসি....
বাচ্চাটি
পেপসি পান করছে, ট্রান্সপারেন্ট পলিথিনের লম্বা প্যাকে হালকা
হলুদাভ 'পেপসি'। বাচ্চাটি খাচ্ছেনা,
পাছে তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। এর পর দেখলাম সরু স্ট্র করে টেনে কিছুটা
পানীয় মুখে নিল, খানিকক্ষন মুখে সেটা রেখে সম্পূর্ন সুখ নিয়ে
সেই স্ট্র দিয়েই আবার চিকচিকেতে ফিরৎ পাঠালো। দারুন জমে উঠা খেলা। এই মুহুর্তে
কোটি টাকাও ফেল এই অনবিল সুখের কাছে। চিকচিকির বাইরে বিন্দু বিন্দু জল জমা হয়ে
সেগুলো আমারই পায়ে টোপা টোপা হয়ে ঝড়ছে।
আমি
একজনকে ফোনে পাবার চেষ্টাতে ব্যাস্ত। তাকে ফোনে পেতেই শুনলাম তিনি নাকি রাস্তায়
দাঁত কেলিয়ে পরেছিলেন গরমের চোটে। হঠাৎ পায়ে কিছু একটা কিলবিল করছে, এক
ঝটকাতে পাটা সরাতেই আওয়াজ...
-এজ্ঞে, আমিমি। ছিলাটা তুমার পায়ে লুংরা ফিলেছে, তাই পুচে দিচ্চি।
- আরে না না, ধুর কি করছেন। পথে ঘাটে চলতে চলতে এমন তো হয়েই থাকে।
-এজ্ঞে, আমিমি। ছিলাটা তুমার পায়ে লুংরা ফিলেছে, তাই পুচে দিচ্চি।
- আরে না না, ধুর কি করছেন। পথে ঘাটে চলতে চলতে এমন তো হয়েই থাকে।
সে
যাত্রায় ভদ্রমহিলা ব্যার্থমনোরথে ক্ষান্ত দিলেন। আমার চোখে সানগ্লাস, সুতরাং
প্রতক্ষ দেখতে মানা নেই, অবশ্য মন পারমিট করলে তবে।
দেখলাম....
সদ্য
কুড়ি পেড়োনো এক উচ্ছল যুবতী। আশ্বিনের নদীর মত ভরা শরীর, অথচ
শান্ত। কর্মঠ অবশ্যই, নতুবা এমনতর নির্মেদ হওয়া সম্ভবপর নয়।
এবারে আমি গোটা কামরাটা একবার প্রদক্ষিণ করলাম চোখ দিয়ে, যতটা
করা সম্ভব। তাতে করে এক আশ্চর্য উপলব্ধি হল।
কামরাতে
শিশু থেক বৃদ্ধা অনেক সুন্দরীর উপস্থিতি, জীবনে কম সুন্দরীদের
সহচর্যে আসিনি, তবুও কেন জানিনা এই মেয়েটিকেই আমার দেখা
অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মনে হল। পাকা জামের মত গায়ের রঙ, তা
সত্বেও কাটারির মত মোটা ভ্রু সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে শতগুণ। নাকটা চাপা, আর নাকের পেটিগুলো ফোলা ফোলা, যেমনটা আমাদের আদিবাসী
রমনীদের হয়, ইনিও তার ব্যাতিক্রম নন। চোখগুলো ছোট ছোট কোটরে
বাই ডিফল্ট ঢোকা। কর্নিয়া অস্বাভাবিক রকমের সাদা, যেমন দাঁত
গুলো। খেয়াল করলাম হাসলে মাড়ি দেখা যাচ্ছে।
এর
সৌন্দর্য আসলে এর সাবলীলতাতে। মুখে নুন্যতম প্রসাধনী কারুকার্য নেই। হয়ত পুকুরে
স্নান করার সময় লাইফবয় সাবান দিয়েই মুখ ধুয়েছে। নাহ এদের নিম ফেসওয়াস লাগেনা।
সম্ভবত হালখাতার মিষ্টির প্যাকেটের রঙিন গাডারে চুলটা বাঁধা। আকর্ষনীয় সাজ, যেখানে
অন্যে কি ভাববে তার বালাই নেই, আত্মাকে শান্তি দিতে নুন্যতম
পরিমান ভাবের ঘরে চুরি নেই। দুনিয়া যা ভাবে ভাবুক, সে তার মত
সেজেছে। শুরুটা পা দিয়েই করি। নিশ্চিত ভবে ইনি স্কুলে যাননি, তবে একটা শখ হয়ত মনে ছিল। পায়ে উজালা দিয়ে নীল করা কাপড়ের ফিতে বাঁধা
কেডস। নাহ, মোজা ছিলনা।
একটা
গোলগলা কলারওয়ালা জয়পুরী প্রিন্টেড ব্লাউজ, হাফ হাতা। এনার
সান্সক্রিমের পরতে মোড়া 'ফর্সা' পিঠ
পৃথিবীকে দেখানোর দায় নেই। পোষাক লজ্জা নিবারণের জন্য, অন্য
সকলকে আকর্ষিত করার জন্য নয়। ইনি সেটা না বুঝেও বোঝেন, বোদ্ধারা
যুক্তির মোমবাতি জ্বালান।
বাজুতে
একটা রুপোর তাগা। বেশ পুরাতন, হয়ত স্মৃতিরক্ষার পরম্পরা ওইটি। পরনে
একটা উজ্জ্বল ডিপ গোলাপি সিফন শাড়ি, যার জমিতে ও আঁচলা জুড়ে
সোনালি জড়ির কাজ। হাতের নখে ঘসে যাওয়া নখপালিশ। সেটা আবার গাঢ় সবুজাভ। হাতের লালচে
সাদা তালুতে সে কি অনবদ্য সুন্দর দৃশ্য।
নাহ, লোকে
কি বলবে সেই ভয়ে এ মেয়ে ভীত নয়। অশ্লীল কিছু নয় এমন সকল শখ সে পূরন করেছে। আত্মাকে
প্রশান্তি দিয়েছে, এ মেয়ে ছারা কে হতে পারে স্বাধীনচেতার
নমুনা!
আধা
ঘন্টা পরেই সিট পেয়ে গেলাম। আমি জানালার পাসে, মাঝে বাচ্চাটি তার পাশে সেই
রমনী। চোখের ইশারাতে বাচ্চাকে শাষনে রাখার ব্যার্থ চেষ্টা সযত্নে চালু রয়েছে
মায়ের। আচ্ছা আমরা যারা নাকি আধুনিক বলে দাবি করি, তারা কি
বিশ্বায়নের দাস নই? বিজ্ঞাপণ সর্বস্ব পৃথিবীতে সাজানো চমকের
ফাঁদে তলিয়েও মজন্তালি সরকারের মত জিতে যায়।
সৌন্দর্য
কি বহি:রঙ্গে? মাটির প্রতিমার মত অপূর্ব মুখশ্রীর এক বৌদি ঠিক
আমায় পিছন করে সমুখপানের জানালা দখল করে বসে আছেন। ট্রেন সামনের দিকে চলছে,
স্লিভলেস বৌদির বগলের "সিক্রেট টেম্পটেশন ট্যাল্ক" আমার
কানের পাশ দিয়ে নাকে ঢুকছে। নামার সময় সেই সুগন্ধ প্রদান হেতু তাকে খানিক দেখলাম,
রোদচসমার ফাঁক দিয়েই। জারদৌসি শাড়ি নাভির নিচ থেকে শুরু হয়েছে।
মাঝের উন্মুক্ত লোভনীয় চর্বিযুক্ত পেটিদেশ ও নাভিকূপ এটা পৌষমাস হলেও অনেককেই
ঘামিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।
ভাবছিলাম, তাহলে
ভারতমাতার রূপ কোনটা? সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই যে, ভারত মাতার আধুনিক সন্তানেরা কোন রূপটির আরাধনা করবেন। নির্মল স্বকিয়তাতে
ঠাসা একজন মা, যিনি নিজের রূপ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, তবুও সে নিজের ভাবনাতেই একনিষ্ঠ। নেটের দুনিয়াতে বিভোর এক আধুনিকা মামনি
নুডুলস স্ট্রিপের টপের চারিবেড়ের ঘামাচি চুলকাতে চুলকাতে পাশের বন্ধুটির সাথে
খিল্লি নিয়ে ব্যাস্ত, উদ্দেশ্য অবশ্যই আমার পাশেরজন। তাকে
ঘামাচি লুকাবার জন্য মেকি রূপচর্চার সময় ব্যায় করতে হয়না। উন্মাদের চোখ বলে কিনা
জানিনা, রামকিঙ্কর বেজের কাদা পাথরের ভাষ্কর্য কি এদেরকে
হুবহু নকল করে বানানো নয়?
চলতে
চলতে কোন একটা স্টেশনে নেমে যাওয়ার আগে আরেকবার আমার কাছে অন্যায়কারীসুচক চোখে
তাকিয়ে ভিড়ের মাঝে মিশে গেলেন। আমার মনে ভারতমাতৃকার একটা ছাপ রয়ে গেল।
আজ
গুরুদেবের জন্মদিন, সাধে কি তিনি বলেছিলেন-
"কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি......"
ধন্য কবিগুরু, তুমি নাহলে কোনো শেষটাই শেষ
করতে পাতামনা, এবড়োখেবড়ো করেও।
No comments:
Post a Comment